শুভ জন্মদিন বিশ্বজয়ী মেসি
লিওনেল মেসি এখন কোথায় আছেন? ক্লাব ফুটবলে এখন বিরতি। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচটি খেলেননি। লম্বা বিশ্রাম নিতে চান বলে আর্জেন্টিনা দল থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। এরপর একবার খবর এসেছিল, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক বার্সেলোনায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুনিয়াটা এখন হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল নামের যন্ত্রটায় বন্দী থাকলেও এ লেখার লেখকের মেসির অবস্থান জানার সুযোগ নেই। মেসির সঙ্গে তো আর এই প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই, তাই সাত সাগর আর তেরো নদীর এপারে বসে মেসি কোথায় আছেন, সে খবর নেওয়ার সুযোগও নেই!
এত এত বিশেষ জন্মদিন কাটানো মেসি অপেক্ষায় ছিলেন একটি অতি বিশেষ জন্মদিন পালনের। শুধু মেসি কেন, মেসির একটি অতি বিশেষ জন্মদিন পালনের স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছে বিশ্বজোড়া তাঁর কোটি কোটি ভক্তও।
বার্সেলোনার ইবিজা দ্বীপের সুনীল সাগরের তীর অথবা বুয়েনস এইরেসে নিজের ছিমছাম গোছানো বাড়ি, মেসি যেখানেই থাকুন—আজকের সূর্যোদয়টা তাঁর জন্য অন্য রকমই। ফুটবল মহাতারকার জন্মদিনের সকাল বলে কথা! প্রতিটি মানুষের জীবনেই জন্মদিন কতটা সুন্দর আর মহান, সেটা বোঝাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু পঙ্ক্তি স্মরণ করা যেতে পারে—‘জন্মদিন আসে বারে বারে/ মনে করাবারে/ এ জীবন নিত্যই নূতন/ প্রতি প্রাতে আলোকিত/পুলকিত/দিনের মতন।’
রবীন্দ্রনাথ যদিও বলেছেন, জন্মদিন প্রতিটি সকালে আলোকিত আর পুলকিত দিনের মতো, কিন্তু মেসির ক্ষেত্রে তাঁর ৩৬তম জন্মদিনটা তার চেয়েও বেশি কিছুই হওয়ার কথা। এর আগে জন্মদিনে দেখা সকালের চেয়ে আজকের সকালটি একটু বেশিই আলোকিত লাগার কথা মেসির কাছে। শুধু মেসির কাছেই নয়, তাঁর ভক্তদের জন্যও মেসির আজকের জন্মদিনটা বিশেষ। যে মহাতারার জন্মদিন এত দিন তারা পালন করে এসেছে, সেই মহাতারা যে এখন বিশ্বজয়ী!
১০ বছর বয়সে হরমনজনিত সমস্যা ধরা পড়ে মেসির। ছোট্ট দুটি পায়ে, বিশেষ করে জাদুকরি বাঁ পায়ের কারিকুরিতে নিওয়েলস বয়েজ ক্লাবের প্রাঙ্গণ মাতিয়ে রাখা শিশুটি আর কখনো ফুটবল খেলতে পারবে কি না, তা নিয়েই শঙ্কা জাগে। সেই শঙ্কার অবসান হয় ২০০০ সালে বার্সেলোনা অসামান্য এই প্রতিভাকে নিজেদের একাডেমিতে নিলে। মেসির চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি। এরপর ক্যাম্প ন্যু থেকে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু অথবা স্তদ দি ফ্রান্স থেকে ওয়েম্বলির সবুজে ছোট্ট দুটি পায়ে মেসি যা রচনা করেছেন, সেগুলোকে রূপকথা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়!
৩১ থেকে ৩২, সেখান থেকে ৩৩, ৩৪, ৩৫—গাণিতিক হিসাবে মেসি একটু একটু করে ‘বুড়ো’ হচ্ছিলেন, কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্স বলছিল বয়স যেন তাঁর থমকে আছে একই জায়গায়! দুর্দান্ত সেই পারফরম্যান্সটা নিয়ে গেলেন কাতারে। একের পর এক ম্যাচে অসাধারণ ফুটবল খেলে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে এনে দিলেন পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই বিশ্বকাপ ট্রফি। এখন তিনি বিশ্বজয়ী! আজ একজন বিশ্বজয়ীর জন্মদিন।
ক্লাব ফুটবলে অর্জনের ডালিটা কানায় কানায় পূর্ণ করেছেন অনেক আগেই। ২০০৫ সাল বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন প্রথম লা লিগা। সেবারের জন্মদিনটা নিশ্চয়ই বিশেষ ছিল মেসির। এরপর ২০০৬ সালের মে মাসে জিতেছেন প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। সেবারের ২৪ জুন মেসি উদ্যাপন করেছেন ১৯তম জন্মদিন। এরপর এমন অনেক শিরোপা জয়, এমন অনেক বিশেষ জন্মদিন গেছে মেসির। ২০২১ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জিতেছেন ৩৪তম জন্মদিন পালনের পরের মাসে। কিন্তু ২০২২ সালে ইতালিকে হারিয়ে লা ফিনালিসিমা জিতে পালন করেছেন ৩৫তম জন্মদিন।
কিন্তু ‘শিশিরে কি ফোটে ফুল বিনা বরিষনে’! এত এত বিশেষ জন্মদিন কাটানো মেসি অপেক্ষায় ছিলেন একটি অতি বিশেষ জন্মদিন পালনের। শুধু মেসি কেন, মেসির একটি অতি বিশেষ জন্মদিন পালনের স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছে বিশ্বজোড়া তাঁর কোটি কোটি ভক্তও। সেই অতি বিশেষ জন্মদিনের ভাবনায় মেসির বয়স যেন বাড়ছিল না! মেসি তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছেন ২০০৬ সালে, ১৯ বছর বয়সে। এরপর ২৩ বছর বয়সে ২০১০ বিশ্বকাপ, ২৭ বছর বয়সে ২০১৪ আর ৩১ বছর বয়সে ২০১৮ বিশ্বকাপ।
ব্রাজিলে হওয়া ২০১৪ বিশ্বকাপে একদম তিরে গিয়ে তরি ডুবেছে। স্বপ্নের বিশ্বকাপ শিরোপা ছুঁতে পারেননি ফাইনালে জার্মানির কাছে ১–০ গোলে হেরে যাওয়ায়। সেবার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছিলেন মেসি। কিন্তু পুরস্কারটি হাতে নিয়ে সেদিকে তাকাচ্ছিলেনও না আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। ভাবখানা ছিল এ রকম, ‘কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম!’
২০১৪ বিশ্বকাপের পর ২০১৫ কোপা আমেরিকার ফাইনালেও চিলির কাছে হারে আর্জেন্টিনা। পরের বছর ছিল কোপা আমেরিকার শতবর্ষী আসর। আবারও ফাইনালে চিলির সামনে পড়ে আর্জেন্টিনা। ফাইনালের দুই দিন আগে ছিল মেসির জন্মদিন। চিলিকে হারিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে আর্জেন্টিনার সিনিয়র দলের জার্সিতে প্রথম শিরোপা জয়ের আনন্দে ভাসতে চেয়েছিলেন মেসি, জন্মদিনটা পালন করতে চেয়েছিলেন ফাইনালের পর। কিন্তু কোথায় কী! আর্জেন্টিনার হারের পর কী বিষাদময় কিছুদিনই না কেটেছে তাঁর। অন্তর্দহন সহ্য করতে না পেরে আন্তর্জাতিক ফুটবলকেই বিদায় জানিয়ে দিয়েছিলেন!
১২টি লিগ আর ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ক্লাব ফুটবলে অনেক আগেই শিখরে ওঠা মেসি এখন বিশ্বকাপ জয়ীও। হৃদয়ের সব তৃষ্ণা মিটিয়ে এবার হয়তো জীবনের সেরা জন্মদিনটা পালন করবেন মেসি।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা থেকে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট—সবার অনুরোধে আর্জেন্টিনার প্রয়োজনেই মেসি অবসর ভেঙে আবার ফিরেছেন ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে। কিন্তু সেবার দারুণ নৈপুণ্যে দলকে বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে নিয়ে গেলেও জন্মদিনটা বিশেষ করে তুলতে পারেননি। কারণ, আর্জেন্টিনা যে ছিটকে গিয়েছিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই। এর পর থেকেই মেসি দিন গুনে গেছেন। তখন মেসির বয়স হয়ে গিয়েছিল ৩১ বছর। কিন্তু আরেকটি বিশ্বকাপ খেলা আর শিরোপা জয়ের ভাবনায় তাঁর বয়স যেন বাড়ছিলই না!
৩১ থেকে ৩২, সেখান থেকে ৩৩, ৩৪, ৩৫—গাণিতিক হিসাবে মেসি একটু একটু করে ‘বুড়ো’ হচ্ছিলেন, কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্স বলছিল বয়স যেন তাঁর থমকে আছে একই জায়গায়! দুর্দান্ত সেই পারফরম্যান্সটা নিয়ে গেলেন কাতারে। একের পর এক ম্যাচে অসাধারণ ফুটবল খেলে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে এনে দিলেন পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই বিশ্বকাপ ট্রফি। এখন তিনি বিশ্বজয়ী! আজ একজন বিশ্বজয়ীর জন্মদিন।
১২টি লিগ আর ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ক্লাব ফুটবলে অনেক আগেই শিখরে ওঠা মেসি এখন বিশ্বকাপ জয়ীও। হৃদয়ের সব তৃষ্ণা মিটিয়ে এবার হয়তো জীবনের সেরা জন্মদিনটা পালন করবেন মেসি। এই জন্মদিনে মেসি হয়তো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলবেন, ‘আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা/ আমি চাহি বন্ধুজন যারা/ তাহাদের হাতের পরশে/ মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে/ নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ...দিয়েছি উজাড় করি/ যাহা-কিছু আছিল দিবার/ প্রতিদানে যদি কিছু পাই।’
মেসির ভক্তরাই–বা এই জন্মদিনে কীভাবে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাবে? স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় তারা হয়তো ৩৬টি মোমবাতি জ্বালিয়ে একসঙ্গে গেয়ে উঠবে—আমরা তোমাকে ভালোবাসি, প্রিয় লিওনেল মেসি। বাহ্, ৩৬টি মোমবাতি—আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের খরা কাটানো মহানায়কের ৩৬তম জন্মদিনে এর চেয়ে ভালো শুভেচ্ছা আর কীভাবে জানানো যায়!