অথচ ফুটবলারই হওয়ার কথা ছিল না সাফের সেরা গোলকিপার আনিসুরের
‘আমার আসলে ফুটবলারই হওয়ার কথা ছিল না। আমি প্লেয়ার হব কখনো চিন্তাই করিনি। কক্সবাজারে নিজের এলাকায় খেলতাম। একটু মোটা ছিলাম, ওপরে খেলতাম। কিন্তু মোটা হওয়ায় সেভাবে খেলতে পারতাম না। তাই গোলকিপারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় আমাকে। পরিবার অবশ্য সমর্থন করত না আমার খেলা। পরিবার চাইত লেখাপড়া করব। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আমি, ভীষণ খুশি।’
আনিসুর রহমান ( জিকো) একনিশ্বাসে বলে যান। একটু পর বসুন্ধরা কিংসের অনুশীলন শুরু হবে। ফোনের ও–প্রান্তে আনিসুরের ব্যস্ততা বোঝাই যায়। কিন্তু মনের ভেতর আনন্দের বন্যা বইছে আজ তাঁর। দেশের ফুটবলে সেরা গোলকিপার হয়েছেন আগেই। জাতীয় দলের ১ নম্বর জায়গাটা বছর তিনেক ধরে তাঁর দখলে। সেই আনিসুর এবার দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলেও সেরা গোলকিপার!
গতকাল বেঙ্গালুরুতে শেষ হওয়া ১৪তম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা গোলকিপারের পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের আনিসুর। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার টুর্নামেন্ট হলেও এবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছে মধ্যপ্রাচ্যর দুটি দেশ লেবানন ও কুয়েত। সাফের মানের চেয়ে যারা বেশ এগিয়েই। লেবানন, কুয়েতের গোলকিপারদের ছাপিয়ে গেছেন আনিসুর। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে টাইব্রেকারে ভারতকে জেতানো গুরপ্রীত সিংও পেছনে পড়ে গেছেন তাঁর।
যাওয়ার আগে কি এমন কিছু ভেবেছিলেন? ‘বেঙ্গালুরু যাওয়ার আগেই আমার স্বপ্ন ছিল, সেরা গোলকিপার হব। স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে। সেরা গোলকিপার হয়েছি সাফে। এটা আমার জন্য অনেক বড় সম্মানের, আনন্দের। খবরটা জানার পর থেকেই ভীষণ উজ্জ্বীবিত লাগছে’ বলেন আনিসুর।
বেঙ্গালুরু সাফে চার ম্যাচে ৫ গোল হয়েছে আনিসুরের বিপক্ষে। লেবানন ম্যাচে ২ গোল। পরের তিন ম্যাচে ১টি করে। স্মরণীয় সেভ আছে বেশ কয়েকটি। একটি সেভ বেছে নিতে বললে আনিসুর কুয়েত ম্যাচের দিকে ফিরে তাকান, ‘কুয়েতের সঙ্গে অনেকগুলো সেভ করেছি। তবে একটা সেভ আলাদাভাবে মনে আছে। সেটি ছিল নির্ধারিত সময়ের। ওরা ক্রস করেছিল, তা থেকে ওরা পোস্টে শটও নেয়। আমি সেই শটটি আটকেছি। এই সেভটা অনেক দিন মরে রাখব।’
কুয়েত ম্যাচটাই এখন পর্যন্ত স্মরণীয় ম্যাচ আনিসুরের কাছে। ২০২০ সালে দোহায় বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কাতারের কাছে বাংলাদেশের ৫–০ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচটিও আনিসুরের কাছে স্মরণীয়। কাতারের কাছে ৫ গোল খেলেও আনিসুর বাঁচান আরও অন্তত ৫টি গোল।
ঢাকায় ২০১৮ সাফে বাংলদেশ দলে তৃতীয় গোলকিপার ছিলেন আনিসুর। শহিদুল আলম তখন প্রথম পছন্দ কোচ জেমি ডের। তাই সেবার সুযোগ মেলেনি। ২০২১ সালে মালদ্বীপ সাফে আনিসুর ছিলেন বাংলাদেশের পোস্টের নিচে। সেবার নেপালের সঙ্গে শেষ লিগ ম্যাচে জিতলেই ফাইনাল—এমন ম্যাচে এক গোলে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ শেষ দিকে নাটকীয় পরিস্থিতির শিকার হয়ে ১–১ গোলে ড্র করে ফাইনালে উঠতে পারেনি। রাকিবের একটা ভুল ব্যাকপাস ধরে নেপালের ফরোয়ার্ড ফাঁকা জায়গা পেয়ে যান। তাঁকে আটকাতে পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসে ফাউল করে লালকার্ড দেখেন আনিসুর।
এএফসি কাপে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে সেরা গোলকিপার হয়েছেন। দলকে অনেকবার জিতিয়েছেন। কখনো ৯০ মিনিটে, কখনো টাইব্রেকারে। ২০১৮ সালে স্বাধীনতা কাপে দুটি ম্যাচে শুট-আউটে কিংসের নায়ক আনিসুর। হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারও। ২০১৯-২০ এএফসি কাপে মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টসের বিপক্ষে তিনবার পেনাল্টি আটকে হয়েছেন সেরা গোলকিপার। সর্বশেষ স্বাধীনতা কাপে ফাইনাল সেরা। ২০১৯ সালে সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ এ ছিলেন সেরা গোলকিপার। কক্সবাজার লিগেও হয়েছেন সেরা গোলকিপার।
সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশ দলকে নির্ভরতা দিচ্ছেন আনিসুর। সাবেক গোলকিপার আমিনুল হকের মতো হয়ে উঠেছেন নির্ভরযোগ্য। জায়গা পাকা করেছেন দলে। আমিনুলের সমকালীন গোলকিপার বিপ্লব ভট্টাচার্যের মুখে শুধু মুগ্ধতা আনিসুরকে নিয়ে, ‘কোথায় গোলকিপার দাঁড়াবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন ম্যাচে কখন বের হবে এটাও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জিকো এসব ভালো বোঝে। সদা সতর্ক থাকে, দ্রুত পজিশন নিতে পারে। উপস্থিত বুদ্ধি অনেক ভালো। জিকোর ( আনিসুর) এই গুণগুলো আছে। চাপের মুখে সে ভেঙে পড়ে না। যে কারণে সে এত দূর উঠে এসেছে।’