আলোনসো ও লেভারকুসেন ‘অমরত্ব’কে যেভাবে আলিঙ্গন করল
এমন দিন কদাচিৎ আসে কিংবা আসেই না। এমন একটি দিনের জন্য মানুষ তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকে। আসবে নিশ্চয়ই? বেশির ভাগ সময়ই আসে না। এমন একটা মুহূর্তের আনন্দ কেমন হতে পারে, তা বেশির ভাগ মানুষ জানতেই পারে না। তবে কোনো একদিন ভাগ্যদেবীর কৃপা হয়। উপহারের ডালা নিয়ে আসেন ভাগ্যবানদের জন্য। সেই সব মানুষের জন্য, যারা জানে না উৎসবের আনন্দ কেমন হতে পারে! যারা জানে না উদ্যাপনের মানে কিংবা আনন্দের রং কী!
সাফল্য যখন তাঁদের পায়ে লুটোপুটি খেতে শুরু করল, মানুষগুলো যেন বুঝতে পারছিল না, কীভাবে সেই সৌভাগ্যকে আলিঙ্গন করতে হয়। তারা ভুলে গেছে কখন হাসতে হয়, আর কখন কাঁদতে হয়! ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই লাইনগুলোর মতো—‘তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—/না জানে বেদন, না জানে রোদন…।’
তাই তাদের আবেগ হয় বাঁধনহারা, তাদের উদ্যাপন হয় পাগলপারা। যে কারণে ম্যাচ শেষ হওয়ার অপেক্ষা তারা আর করতে পারে না। আগেই নেমে আসে মাঠে। তাদের উদ্যাপনে বাধা না দিতে রেফারিকেও ৯০ মিনিটের কিছুক্ষণ আগেই বাজিয়ে দিতে হয় শেষ বাঁশি। দিনের পর দিন হারতে হারতে ‘নেভারকুসেন’ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে একটু আগেই সুযোগ করে দিতে হয় উদ্যাপনের।
এমন উদ্যাপন কে কবে দেখেছে আগে! এমন উদ্যাপন কেউ হয়তো স্বপ্নে ভাবতে পারে। সেই স্বপ্নকেই গতকাল রাতে বাস্তবতায় রূপ দিয়েছিল লেভারকুসেন। স্বপ্নও অবশ্য এতটা নিঁখুত হয় না, এতটা অপ্রতিরোধ্য হয় না, হয় নাকি! এটা এমন স্বপ্ন, যা কেউ কখনো দেখার সাহসও করে না। তাই এটি যখন সত্যি হয়, তখন হাসি-কান্না কিংবা আনন্দ-বেদনাও আর এক রকম থাকে না। ‘সুখের মতো ব্যথা’য় উন্মাতাল মানুষগুলো কাঁদতে কাঁদতে হাসে, হাসতে হাসতে কাঁদে।
জীবন এমনই সুন্দর, ফুটবলও কি আর জীবনের চেয়ে কম সুন্দর। এমন দৃশ্য মাথায় রেখেই হয়তো জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘আমরা যাইনি ম’রে আজও, তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়।’ হ্যাঁ, গতকাল রাতে বেঅ্যারেনায় যে দৃশ্যের জন্ম হয়েছে, তা নিশ্চিত করেই ফুটবল ইতিহাসের অমর দৃশ্যগুলোর অন্যতম।
চলতি মৌসুমের শুরু থেকে লেভারকুসেন নিয়ে বেশ স্তবগাথা রচিত হয়েছে। উত্থান-পতনের সব মুহূর্তের দিনলিপি তাতে লেখা আছে। তবু আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। জেরার্দো সিওয়ানের অধীনে গত মৌসুমে মাত্র ৮ ম্যাচের একটি জিতে লেভারকুসেন যখন ধুঁকছিল, তখনই ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসেন জাবি আলোনসো।
কোচ হিসেবে অপরীক্ষিত আলোনসোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মূলত দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। কোনো রকমে শীর্ষ লিগে টিকে থাকাই ছিল লক্ষ্য। সে সময় এর বেশি ভাবারও উপায় ছিল না লেভারকুসেন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কে জানত, যাঁকে তারা মান বাঁচানোর ঢাল হিসেবে এনেছিল, তিনি আসলে এক আশ্চর্য জাদুকর।
আলাদিনের চেরাগের ইচ্ছাপূরণ-দৈত্য বা রূপকথার নায়ক। ধুঁকতে থাকা লেভারকুসেনকে পয়েন্ট তালিকার ছয়ে রেখে মৌসুম শেষ করেন আলোনসো।
বলা হয়, সকালের সূর্য নাকি দিনের পূর্বাভাস দেয়। আপ্তবাক্যটিকে আলোনসো ঠিক প্রমাণ করতে থাকেন মৌসুমের শুরু থেকেই। প্রথম চার ম্যাচে চার জয়ের পথে ৩ গোল হজম করার বিপরীতে লেভারকুসেন গোল দেয় ১৯টি। এমন পারফরম্যান্সের পরও লেভারকুসেনকে নিয়ে সন্দেহ কম ছিল না।
একে তো বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের টানা ১১ মৌসুমের রাজত্ব, তার ওপর অনভিজ্ঞ ক্লাবগুলোর অধারাবাহিক পারফরম্যান্স। ফলে মৌসুমের কোনো এক পর্যায়ে ‘চোক’ করাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল অবধারিত। এ মৌসুমে যেমনটা ফ্রান্সে করেছে নিস, লা লিগায় জিরোনা এবং প্রিমিয়ার লিগে অ্যাস্টন ভিলা। কিন্তু আলোনসোর লেভারকুসেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। ভিক্তর বোনিফেইস, গ্রানিত শাকা, ফ্লেরিয়ান রিটজ, প্যাট্রিক শিকরা যেন অন্য এক জগতের মানুষ! অথচ কয়েক মাস আগেও তাঁরা ছিলেন বড্ড সাদামাটা, সাধারণ।
এই খেলোয়াড়দের হাত ধরে একটি–দুটি করে মৌসুমজুড়ে ৪৩টি ম্যাচে অপরাজিত লেভারকুসেন। ৫ ম্যাচ হাতে রেখে নিশ্চিত করে ফেলল লিগ শিরোপা। এ শতকে কেবল জুভেন্টাসই সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৩ ম্যাচে অপরাজিত ছিল। এই রেকর্ড ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর যাওয়ার সুযোগ আছে লেভারকুসেনের। দলটির সামনে এখন আছে ঐতিহাসিক ট্রেবল জয়ের সুযোগও। জার্মান কাপের ফাইনালে ওঠার পাশাপাশি ইউরোপা লিগের সেমিতেও এক পা দিয়ে রেখেছে তারা।
লেভারকুসেনের এ শিরোপা জয়কে তুলনা করা যায় সাম্প্রতিক সময়ের লেস্টার সিটির রূপকথার সঙ্গে। ২০১৬ সালে অবিশ্বাস্য এক গল্প লিখে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছিল লেস্টার। তবে মাহাত্ম্য বিবেচনা করলে লেভারকুসেনের এ শিরোপা ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে স্বতন্ত্র ও অনন্য এক অধ্যায় হয়ে থাকবে। ‘নেভারকুসেন’ তকমা পাওয়া একটি দল, যাদের ট্রফি ক্যাবিনেটে ধুলো জমতে জমতে রীতিমতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হয়ে উঠেছিল, তারাই এখন ‘ইনভিনসিবল’ হওয়ার পথে।
যে কারণে ম্যাচ শেষ হতেই লেভারকুসেনের ভবিতব্যকে যেন সিলগালা করে দিলেন ধারাভাষ্যকার নিজেই। বলে উঠলেন অমর কবিতাখানি, ‘নেভার সে নেভারকুসেন এভার এভার অ্যাগেইন।’ এই কথাগুলোকে তুলনা করা যায় লিওনেল মেসির বিশ্বকাপ জয়ের পর পিটার ড্রুরির দেওয়া সেই ধারাভাষ্যের সঙ্গে। ড্রুরি যখন বলে উঠেছিলেন, ‘লিওনেল মেসি শেকেন হ্যান্ডস উইথ প্যারাডাইস…’।
ধারাভাষ্যকার যখন লেভারকুসেনের শিরোপা জয়ের উচ্ছ্বাসে গলা ফাটাচ্ছিলেন, মাঠের আবেগ তখন রাইনের তীর ছাপিয়ে গোটা ফুটবল দুনিয়াকে প্লাবিত করছিল। লেভারকুসেনের সেই আবেগ আর শুধুই লেভারকুসেনের থাকেনি, হয়ে গেছে যেন ফুটবলের সর্বজনীন আবেগ। সে আবেগকে ভাষায় প্রকাশ করে, সাধ্য কার!
একজন আলোনসো তাই যখন দুই হাত উঁচিয়ে জনতার ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে আসতে থাকেন, তখন তিনি মহানায়ক। বহু, বহু বছর ধরে মার খেতে থাকা, মরতে থাকা মানুষেরও নায়ক। ফুটবল তো শুধু আনন্দময় কোনো খেলা নয়, এটি তার চেয়েও বেশি কিছু। যেখানে শত বছর ধরে মার খেতে খেতে একদল মানুষের কদাচিৎ জেগে ওঠার গল্পও আছে। আর তারা যখন জেগে ওঠে, তখন লেখা হয় নতুন ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে অমরত্ব পান আলোনসোর মতো কেউ। একদল ‘ইনভিনসিবল’ মানুষের সুপারহিরো!