ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ—গ্যালাকটিকোসের স্বপ্নদ্রষ্টা থেকে রিয়ালের সফলতম প্রেসিডেন্ট

রিয়ালের সফলতম সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজএক্স

১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে লা লিগা এবং ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি লরেনজো সাঞ্জের তখন পোয়াবারো অবস্থা। মাঠে এমন সোনা ফলানো একজন মানুষকেই তো সমর্থকেরা ক্লাবের হর্তাকর্তা হিসেবে দেখতে চাইবেন। ২০০০ সালে নতুন করে সভাপতি নির্বাচিত হতে এ সাফল্য তাই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ ফুটবল অঙ্গনে তেমন কোনো পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কিন্তু ব্যবসায়িক বুদ্ধিকেই নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগালেন পেরেজ। যা পেরেজকে তো বটেই, বদলে দিয়েছিল রিয়ালের ভাগ্যকেও।

দুটি নির্দিষ্ট বিষয়কে সে সময় সামনে নিয়ে এসেছিলেন পেরেজ। একটি ছিল ক্লাবের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং অন্যটি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা থেকে লুইস ফিগোকে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি। মাঠের ফুটবলে সাফল্য পেলেও মাঠের বাইরে আর্থিকভাবে ধুঁকছিল রিয়াল। আয় কমে আসছিল। এমনকি স্টেডিয়ামের অবস্থাও ছিল যা–তা। ফলে পেরেজের প্রচারণা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগে এবং এই দুটি বিষয়কে পুঁজি করে প্রথমবারের মতো রিয়ালের সভাপতি হয়ে যান পেরেজ। শুরু হয় রিয়ালের অন্য এক পথচলা।

আরও পড়ুন

কেউ চাইলে রিয়ালের ইতিহাসকে দুই ভাগেও ভাগ করে দেখতে পারে—পেরেজ–পূর্ববর্তী রিয়াল ও পেরেজ–পরবর্তী রিয়াল। আর সেই পেরেজই এবার স্প্যানিশ সুপার কাপ জয়ের মধ্য দিয়েজ ছাড়িয়ে গেলেন কিংবদন্তি রিয়াল সভাপতি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে। সুপার কাপের ট্রফিটি ছিল রিয়াল মাদ্রিদের সভাপতি হিসেবে পেরেজের ৩৩তম শিরোপা। যাঁর নামে রিয়ালের স্টেডিয়ামের নাম, সেই সান্তিয়াগো বার্নাব্যু সভাপতি থাকার সময় রিয়াল জিতেছিল ৩২টি শিরোপা। ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর রিয়ালের সভাপতি ছিলেন বার্নাব্যু। সময়ের হিসাবেও পেরেজ তাই অনেক বেশি সাফল্য দাবি করতেই পারেন।

২০০০ সালে প্রথমবার দায়িত্ব নিয়েই পেরেজ হাত দেন ‘গ্যালাকটিকো’ প্রকল্পে। ক্লাবের ভাবমূর্তি উদ্ধার ও বৈশ্বিক জনপ্রিয়তাকে চূড়ায় তুলতেই মূলত তাঁর এই উদ্যোগ। শুরুতে নিজের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রেখে নিয়ে আসেন পর্তুগিজ মহাতারকা ফিগোকে। এরপর ২০০১ সালে জিনেদিন জিদান, ২০০২ সালে রোনালদো নাজারিও। তবে ক্লাবের জনপ্রিয়তা প্রত্যাশার পারদ ছাড়িয়ে যায় সে সময়ের বৈশ্বিক আইকন ডেভিড বেকহাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রিয়ালে আসার পর।

শিরোপা–ভাণ্ডার সঙ্গে নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ
এক্স

তারকাপুঞ্জের উপস্থিতিতে ক্লাবের বাড়ন্ত এই জনপ্রিয়তাকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই পেরেজের বুদ্ধিতে রিয়াল প্রাক্‌–মৌসুমে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে শুরু করে। সে সময়ে রিয়ালের খেলোয়াড়দের আগের চেয়ে বেশি বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করতে দেখা যায়, যা ছিল মূলত পেরেজের ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ।

রিয়াল মাদ্রিদের ভক্ত-সমর্থক বেড়ে যাওয়ায় বড় ভূমিকা ছিল এই ‘গ্যালাকটিকোস’। তারকা খেলোয়াড়েরা চলে যাওয়ার পরও সেই সমর্থকদের হারায়নি রিয়াল। বরং এ ধারায় প্রতিনিয়ত বৈশ্বিকভাবে বিশাল এক সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করেছে ‘লস ব্লাঙ্কোস’ শিবির। পেরেজ কখনোই খেলোয়াড়দের জনপ্রিয়তাকে ক্লাবের ভাবমূর্তির ওপর চেপে বসতে দেননি। যা ক্লাবের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য ধরে রাখার ব্যাপারে যেমন সহায়তা করেছে, তেমনি ক্লাবের প্রতি সমর্থকদের বিশেষ আকর্ষণও তৈরি করেছে।

আরও পড়ুন

মাঠের খেলাতেও গ্যালাকটিকোদের হাত ধরে সাফল্য পেতে শুরু করে রিয়াল। জেতে একাধিক লিগ শিরোপা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ। কিন্তু এত এত মহাতারকা একসঙ্গে থাকার যে বিপদ, তা উঁকি দিতে বেশি সময় লাগেনি। একপর্যায়ে ক্লাবের মধ্যে শুরু হলো অহমের দ্বন্দ্ব। টানা তিন মৌসুম কোনো ধরনের শিরোপা ছাড়াই কাটাল রিয়াল। ২০০৬ সালে পেরেজ সরে যেতে বাধ্য হলেন এ কারণে। সে যাত্রায় পেরেজকে ব্যর্থতা নিয়ে দায়িত্ব ছাড়তে হলেও রিয়ালের ভবিষ্যৎ-দর্শন ও ছবিটা কিন্তু তিনিই এঁকে দিয়ে যান।

মাঠের পারফরম্যান্সে দল ভালো না করলেও রিয়াল তখন আর্থিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি আয় করছিল, বৈশ্বিকভাবে রিয়ালের পরিচিতিও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। নিজেদের স্টেডিয়ামও আরও আধুনিক রূপ পেয়েছিল। পাশাপাশি ব্যবসায়ী পেরেজের হাত ধরেই রিয়াল একটি অরাজনৈতিক ও অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা যখন ‘মোর দ্যান আ ক্লাব’–এর বোঝা নিয়ে কাতালুনিয়ার জাতীয়বাদী আন্দোলনসহ নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের ভূমিকা রাখছিল, রিয়াল সে সময় সবকিছু থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে ফুটবলে মনোযোগ দিচ্ছিল।

পেরেজের সময়ে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের কট্টরপন্থী ‘আল্ট্রাস’দেরও নিষিদ্ধ করে রাখে। কারণ সেই সমর্থক গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত ক্ষতিকারক কার্যক্রমে মেতে থাকত এবং চরমপন্থী রাজনৈতিক আদর্শকেও টেনে খেলার মাঠে নিয়ে আসত। এমন নয় যে বৈশ্বিক অন্যায়–অবিচারগুলোর বিরুদ্ধে রিয়াল নিজেদের অবস্থান জানাত না। মূলত যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় তারা। কে জানে, পেরেজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা এতে কোনো ভূমিকা রেখেছে কি না।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় একজন পুর প্রকৌশলী হলেও একসময় রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন পেরেজ। কিন্তু ভোটের মাঠে ভরাডুবি তাঁকে আবার ব্যবসার জগতে নিয়ে আসে, যা পরে তাঁকে চালিত করে রিয়ালের সভাপতি হওয়ার দিকেও।
প্রথম মেয়াদে রিয়ালের ভাবমূর্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিলেও সভাপতি হিসেবে অনভিজ্ঞতা পেরেজের জন্য কাল হয়েছিল।

আরও পড়ুন

ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিই হয়তো তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যে ফুটবলে সব সাফল্যের মানদণ্ড হচ্ছে মাঠের অর্জন। তবে পেরেজ সেখানেই থেমে যাননি, হারও মানেননি। নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০০৯ সালে আবার ফিরে আসেন রিয়ালের দায়িত্বে। এবার তিনি বাইরের বিষয়াদির সঙ্গে মাঠের সাফল্যেও সমান গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। সেরা খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সেরা কোচ আনার দিকেও চোখ দেন।

তবে প্রথমবারের মতো কেবল প্রতিষ্ঠিত তারকাদেরই নন, উদীয়মান তারকাদের দিকেও হাত বাড়ান পেরেজ। দ্বিতীয় মেয়াদে পেরেজের বৈপ্লবিক সাইনিং ছিল ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে তরুণ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে আসা। পর্তুগিজ মহাতারকার আগমন মাঠে ও মাঠের বাইরে রিয়ালকে সাফল্যের চূড়ায় তুলে দেয়। এরপর অনভিজ্ঞ জিনেদিন জিদানকে দলের প্রধান কোচ করার সিদ্ধান্তও দারুণভাবে কাজে লাগে।

সাবেক কোচ জিদান ও খেলোয়াড়দের সঙ্গে পেরেজ
এএফপি

২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে রিয়ালকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে দেন জিদান। রোনালদো-জিদানের বিদায়েও অবশ্য ম্লান হয়ে পড়েনি রিয়াল। সাফল্য যে একটা সামগ্রিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার ফলাফল, সেটিই প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছে মাদ্রিদের ক্লাবটি। খেলোয়াড়-কোচ এলে–গেলেও রিয়াল নিজেদের পদ্ধতি বদলায়নি। বড় খেলোয়াড় হারিয়েও হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। ফলে প্রজন্মের বদলও রিয়ালের সাফল্যে মরিচা ফেলতে পারেনি। এটি পেরেজের সাফল্যের দর্শনও বটে।

আরও পড়ুন

রিয়ালের এমন চোখধাঁধানো সাফল্যের পরও পেরেজ অবশ্য সব সময় রহস্যময় এক চরিত্র হিসেবেই থেকে গেছেন। এমনকি রিয়ালের সমর্থকেরাও তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেন না। মূলত ক্লাব ও দলের স্বার্থে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও কুণ্ঠিত হন না ৭৬ বছর বয়সী এই স্প্যানিয়ার্ড। খেলোয়াড়দের নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেও এসেছেন আলোচনায়।

ইউরোপিয়ান সুপার লিগের উদ্যোগের কারণে এখনো প্রতিনিয়ত সমালোচকদের তীক্ষ্ণ বাণ সইতে হচ্ছে তাঁকে। ‘ফুটবল মাফিয়া’ হিসেবেও অনেকে সমালোচনা করেন তাঁর। কিন্তু পেরেজ এরপরও পেরেজই থেকে গেছেন, বদলাননি। জনপ্রিয়তা বা জনমতও কখনো টলাতে পারেনি তাঁকে। তাতে গায়ের কালো কোটে কিছুটা দাগ লাগলেও পেরেজ তা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন।