বিপর্যস্ত কোচিং–সংস্কৃতিই কি ডোবাচ্ছে ব্রাজিলকে
এক রোববারে যাঁকে তাঁরা মাথায় নিয়ে নাচেন, পরের রোববারে তাঁকে তাঁরা মৃত্যুর অভিশাপ দেন—কোচদের জীবনের উত্থান–পতন নিয়েই বলা হয় এই কথাগুলো। পৃথিবীতে যত অনিশ্চিত চাকরি আছে, ফুটবল কোচের চাকরি বোধহয় তার অন্যতম। এক রোববারে হারা ম্যাচেই নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে একজন কোচের ভাগ্য। এরপরও অবশ্য এই চাকরির প্রতি আগ্রহী মানুষের সংখ্যা কম নয়।
বিশ্বসেরা কোচদের নিয়ে মাতামাতিও কি কম হয়! হয়তো সেই গ্ল্যামারের টানে কিংবা কাজটির প্রতি ভালোবাসাই কিছু মানুষকে নিয়ে আসে পেশাটির দিকে। যাঁদের মধ্যে কার্লো আনচেলত্তি, পেপ গার্দিওলা, ইয়ুর্গেন ক্লপ কিংবা লিওনেল স্কালোনিরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে বিশেষ মর্যাদাও পেয়ে থাকেন।
এই কজনের বাইরেও আবার এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কোচিংয়ের জগতে নিজেদের জায়গা তৈরি করেছেন। তবে কোচদের নিয়ে নানামুখী এ আলাপে বিশেষ একটি দেশের আশ্চর্য নীরব উপস্থিতি। হ্যাঁ, বলছি ব্রাজিলের কথা। আধুনিক ফুটবলে কোচিংয়ের যে বিকাশ ও স্বরূপ, সেখানে ব্রাজিলিয়ানদের যেন কোনো জায়গায় নেই। যার প্রভাব নিশ্চিতভাবে পড়েছে ব্রাজিলের বর্তমান ফুটবল–মানচিত্রেও।
ফুটবল–যাত্রা মূলত নন্দন থেকে বন্ধনের দিকে। প্রায় প্রতি মৌসুমে নানা ধরনের পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় খেলাটিকে। একসময়ের বাঁধনহারা ফুটবলকে ধীরে ধীরে পরানো হয়েছে নিয়মের শিকল। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিপক্ষকে ঠেকিয়ে নিজেদের এগিয়ে নিতে কৌশলগত পরিবর্তন নিয়েই হাজির হতে দেখা যায় দলগুলোকে।
এই শতকের শুরুর দিকে ফুটবল যখন পেট্রো–ডলারের আশীর্বাদে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে, তখন ফুটবলও গতিময় হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্যের অঢেল অর্থ খেলাটি আশ্চর্যভাবে গতিময় করে তুলে। যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয় কোচদেরও। এটি শুধু ক্লাবের কোচদের মানিয়ে নেওয়া ব্যাপার ছিল না, জাতীয় দলের কোচদেরও সেই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজেদের বদলাতে হয়েছে। দল তৈরির জন্য পাওয়া সময়ের কোটাও ক্রমাগত স্বল্প থেকে স্বল্পতর হয়েছে। এই গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে আশ্চর্যজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন ব্রাজিলিয়ান কোচরা। গত ২০ বছরে ব্রাজিলিয়ান কোচদের উত্থানের দিকে তাকালেও চিত্রটা বেশ স্পষ্ট হবে।
২০০২ সালে লুইস ফিলিপ স্কলারির অধীন বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। রোনালদো নাজারিও, রোনালদিনিও এবং রিভালদোদের নিয়ে বিশ্বকাপ জেতার পর বিদায় নেন এই কোচ। এরপর ব্রাজিলের দায়িত্বে আসেন কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা। কিন্তু ব্রাজিল দলকে সাফল্য এনে দিতে ব্যর্থ হন ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া এই কোচ। এরপর দীর্ঘ মেয়াদে ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক দুঙ্গা। কিন্তু রক্ষণাত্মক কৌশলের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন সাবেক এই ডিফেন্ডার। এমনকি অভিযোগ আছে, তাঁর অধীন ব্রাজিল নিজেদের নান্দনিক ফুটবলের ডিএনএও হারিয়ে ফেলেছে।
এরপর মানো মেনেজেস, দ্বিতীয় মেয়াদে স্কলারি, দুঙ্গা ও তিতেরা ব্রাজিল দলকে আর সাফল্যের পথে ফেরাতে ব্যর্থ হন। এমনকি জয় কিংবা হার বাদ দিলেও ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের হারিয়ে ফেলা সৌন্দর্যও আর ফেরেনি। সাম্প্রতিক সময়ে দায়িত্ব নেওয়া দরিভাল জুনিয়রও বদলের বিশেষ কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেননি। উল্টো কোপা আমেরিকায় ব্যর্থতা ও প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হার ব্রাজিলের ফুটবলকে যেন আরও অন্ধকারেই ঠেলে দিয়েছে। তবে ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে কোচদের ব্যর্থতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এ ব্যর্থতা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সামগ্রিক কোচিংয়ের দুরবস্থারই প্রতিচ্ছবি।
ব্রাজিলের ক্লাব ফুটবলের কথাই ধরা যাক। বেশির ভাগ সময়ে কয়েকটি ম্যাচ হারলেই ক্লাবগুলোকে কোচ ছাঁটাই করতে দেখা যায়। আবার অনেক সময় কোচদের নিয়োগই দেওয়া হয় স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে। মূলত ক্লাবের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কোচের চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর সেই কোচ যদি কঠিন পরিস্থিতি কোনো রকমে পার করেও ফেলেন, তিনি নিজেই আর ক্লাবে থাকেন না। অথবা প্রতিপক্ষ কোনো দলই বেশি দামে কিনে নিয়ে যায় তাঁকে।
ইএসপিএন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে ক্লাবগুলো এ ধরনের প্রবণতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিল, এই ক্লাবগুলো বোর্ড সদস্যরা ও সভাপতি আসেন নির্বাচিত হয়ে। যে কারণে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হয় তাঁদের। তাই সমর্থকেরা যখন কোনো কোচ নিয়ে আপত্তি তোলেন, তখন কালবিলম্ব না করেই ছাঁটাই করা হয় সেই কোচকে।
এর মধ্যে ২০২১ সালে সামনে আনা নতুন আইন ক্লাবগুলোকে লাভজনক স্বত্বা ও প্রাইভেট শেয়ারহোল্ডার হওয়ার পথকে আরও সহজ করে দিয়েছে। এর ফলে লাভ এবং ক্ষতি দুটোই হয়েছে। যেখানে বড় ক্ষতি হচ্ছে, দলগুলো এখন খেলা বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়েই বেশি নজর দিচ্ছে।
একদিকে ক্লাবগুলোর অভ্যন্তরীণ সংকট, অন্যদিকে অল্পতেই ছাঁটাই হওয়ার সম্ভাবনা যোগ্য কোচদের উঠে আসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মেধাবী, প্রতিভাবান ও সাবেক তারকা ফুটবলাররাও এখন কোচ হওয়ার পথে হাঁটছেন না। কোচের চাকরির সহজাত অনিশ্চয়তার বিষয়টি ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোতে রীতিমতো নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রাজিলের আলোচিত দুই ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গো ও ভাস্কো দা গামার কথাই ধরা যাক।
ফ্ল্যামোঙ্গো ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত কোচ বদলেছে ১৪ জন। জাতীয় দলের সাবেক কোচ তিতে বর্তমানে দলটির ১৫তম কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভাস্কো দা গামার অবস্থা অবশ্য আরও শোচনীয়। এই ক্লাব ২০১৯ সাল থেকে কোচ বদলেছে ২৩ জন, যা ইউরোপিয়ান দলগুলোর সঙ্গে তুলনায় রীতিমতো অবিশ্বাস্যই বলতে হয়! এমন পরিস্থিতিতে খুব কমজনই এখন কোচিংয়ে আগ্রহী হচ্ছেন। আর যাঁরা আছেন, তাঁরাও ট্যাকটিশিয়ান হওয়ার চেয়ে ম্যান ম্যানেজার হওয়াতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে চটজলদি কিছু সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে একটি দল ও খেলোয়াড়কে গড়ে তোলার বিষয়টি থেকে যাচ্ছে অবহেলিত। যা একই সঙ্গে একজন কোচের তৈরি হওয়ার পথও রুদ্ধ করে রেখেছে।
লম্বা সময় ধরে ইউরোপিয়ান ফুটবলে ব্রাজিলিয়ান কোচদের অবস্থান তেমন নেই বললেই চলে। হুটহাট দুই একজন এলেও সেটা শুধুই ব্যতিক্রম। কারণটাও অবশ্য অনুমেয়। জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য নেই, ঘরোয়া লিগগুলোর অবস্থাও যাচ্ছেতাই এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে কোচ গড়ে তোলার কোনো তাগিদও নেই। এমনকি তারকাদের মধ্যেও কোচিং নিয়ে তেমন কারও কোনো আগ্রহ নেই। এর বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা ইউরোপিয়ান ফুটবলের যে দর্শন তা ধারণ করতে পারছেন না। ফলে সামগ্রিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির ফুটবল।
ব্রাজিলিয়ান কোচদের জন্য ইউরোপিয়ান মানসিকতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা ভাষাগত সংকট। বেশির ভাগ ব্রাজিলিয়ান কোচ ইংলিশ কিংবা স্প্যানিশ বলতে পারেন না। এই বলতে না পারাও লম্বা সময় তাঁদের সামনে বাধার দেয়াল তৈরি করে রেখেছে। এর আগে ভাষাগত সমস্যার কারণে ব্রাজিলের কোচ দ্বিতীয় ভূমি হিসেবে বেছে নিতেন পর্তুগালকে। কিন্তু পর্তুগাল নিজেরাই এখন যথেষ্ট মানসম্পন্ন কোচ তৈরি করছে, যে কারণে চাহিদা কমেছে ব্রাজিলিয়ান কোচদের। খুব দ্রুত এই ভাষা সমস্যা নিরসনে ব্রাজিলের কোচরা নিজেরা উদ্যোগী হবেন তেমন কোনো ইঙ্গিতও কোথাও নেই। ফলে এই তিমির থেকে মুক্তিও সুদূর পরাহত।
শুধু ব্রাজিলই নয়, ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো সামগ্রিকভাবেই এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নন–ইউরোপিয়ান কোচদের কাছ থেকে। গত মার্চে ইএসপিএনের করা একটি প্রতিবেদন বলছে, সে সময় ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগের ৯৬ ক্লাবের মধ্যে নন–ইউরোপিয়ান ছিলেন কেবল ৮ জন। যেখানে আধিক্য ছিল আর্জেন্টাইনদের। তিনজন আর্জেন্টাইন কোচ—মরিসিও পচেত্তিনো, দিয়েগো সিমিওনে ও মরিসিও পেলেগ্রিনি ছিলেন এ তালিকায়। আর ব্রাজিলের ছিলেন একজন, থিয়াগো মোতা। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবেই নন–ইউরোপিয়ান কোচরা ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোয় তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন।
এরপরও আর্জেন্টাইন কোচরা একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিজেদের এগিয়ে নিচ্ছেন। বিশেষ করে সাবেক তারকা খেলোয়াড়দের বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে মূল দলের কোচিং স্টাফে যুক্ত করেছেন তাঁরা। যেমন আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব–২৩ দলের কোচ এখন হ্যাভিয়ার মাচেরানো। আর মূল দলে স্কালোনির সহকারী হিসেবে আছেন পাবলো আইমার ও রবার্তো আয়ালারা।
সাবেক এই ফুটবলাররা ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়ই পার করেছেন ইউরোপের ক্লাবগুলোয় এবং তাঁরা নিজেদের সময়ের অন্যতম সেরাও বটে।। ফলে ইউরোপিয়ান ফুটবলের বদলে যাওয়া যে চরিত্র, সেটা তাঁরা ভালোই বুঝতে পারেন। যে কারণে বিভিন্ন ক্লাব থেকে ফুটবলাররা যখন জাতীয় দলে যোগ দেন, তখন তাঁরা দলের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে নিতে পারেন।
এখানে অবশ্য স্কালোনির ব্যক্তিগত দক্ষতার কথাও আলাদাভাবে বলতে হয়। গত কয়েক বছরে লিওনেল মেসিকে ঘিরে অসাধারণ একটি দল তিনি গড়ে তুলেছেন। যা একাধিক বিশ্বমানের তারকা থাকা সত্ত্বেও পারেনি ব্রাজিল ফলে ব্রাজিলের ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো ও রাফিনিয়া একে অপর থেকে অনেক দূরে দাঁড়ানো বিচ্ছিন্ন নক্ষত্র হয়েই থেকে গেছেন। দরিভাল ও তাঁর অখ্যাত সহকারীরা যে খুব শিগগির এ দূরত্ব ঘোচাতে পারবেন, সেই সম্ভাবনাও যেন এখন সুদূর পরাহত।