‘উসাইন বোল্ট’ সালমা যেভাবে স্পেনের স্বপ্নপূরণের নায়ক
অ্যালেক্সিয়া পুতেয়াসের বদলি হিসেবে ৫৭ মিনিটে সালমা পারায়উয়েলোকে মাঠে নামিয়েছিলেন স্পেন কোচ। স্কোরবোর্ডে দুই দল তখন ০–০ গোলে সমতায়। একটা গোলের খোঁজে হন্যে ছিল স্পেন। স্পেন কোচ হোর্হে ভিলদা তাই হয়তো সালমার দ্বারস্ত হয়েছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালের স্মৃতিটা তখনও টাটকা। ৭১ মিনিটে আলবা রেদোন্দোর বদলি হয়ে নেমে অতিরিক্ত সময়ে (১১১ মিনিট) তাঁর গোলেই জিতেছিল স্পেন। সেই সালমা ‘ম্যাজিক’ দেখালেন এবারও।
টানা দুবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী পুতেয়াসের বদলি হিসেবে সালমা নামার সময়ই বোঝা যাচ্ছিল, গোলের জন্যই জুয়াটা খেলছেন কোচ হোর্হে ভিলদা। আর সালমাও সুযোগটা নিয়েছেন দু হাত ভরে। ৮১ মিনিটে খুলেছেন গোলের তালা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ততক্ষণে ‘সুপার সাব’ তকমা জুটে গেছে সালমার। পরে স্পেন ২–১ গোলের জয়ে প্রথমবারের মতো নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠায় সালমার বৃহষ্পতি তুঙ্গে থাকাই স্বাভাবিক।
বার্সেলোনার এই উইঙ্গার যেন স্পেনের নারীদের সোনালি সময়ের সারথি। নারী ফুটবলের ইতিহাসে স্পেন প্রথম দল হিসেবে বয়সভিত্তিক পর্যায়েও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সিনিয়রদের বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছে। কথাটা আরেকটু বুঝিয়ে বলা উচিত। ফিফা অনূর্ধ্ব–১৭ ও অনূর্ধ্ব–২০ পর্যায়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেন। বয়সভিত্তিক এ দুটি পর্যায়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সিনিয়রদের বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা প্রথম দল স্পেন। মজার ব্যাপার, সালমা পারায়উয়েলো স্পেনের হয়ে এ দুটি বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। চাই আর একটি জয়। তাহলেই স্পেনের এই অন্যরকম ‘ট্রেবল’ জয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবেন সালমাও।
কিন্তু সালমার পথটা এত সহজ ছিল না। গত বছর ২৪ আগষ্ট ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সালমা শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের গল্প। মাঠে বল পায়ে তাঁর দুর্দান্ত গতিটা কিন্তু শৈশব থেকেই ছিল। সেই সময় বাড়ির আশপাশে বড় ভাই কিংবা বোনদের সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দিয়েছেন। স্কুলেও দৌড়ে তাঁকে পেছনে ফেলা কঠিন ছিল বাকিদের জন্য। আর জীবনের এক পর্যায়ে সালমা নিজেকে আবিস্কার করেন ‘দুই খেলায় পা’ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন!
সালমা ৭ বছর বয়সে গিনিয়ান মাকে রেখে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বাবা সে সময় চাকরি হারিয়েছিলেন। সংসার টিকিয়ে রাখতে কাজ করার বিকল্প ছিল না। একহারা শরীর নিয়ে জন্মগত অ্যাথলেট হওয়ায় সে বয়সেই একসঙ্গে দুটি খেলা খেলেছেন সালমা, ‘সাত বছর বয়সে আমি দুটি খেলাই শুরু করি।’ ওহ, বলাই হয়নি সেই দুটি খেলার নাম—অ্যাথলেটিকস ও ফুটবল। ওই যে দৌড়াতে পারতেন খুব ভালো, তার ফলাফল হিসেবে অ্যাথলেটিকস ও ফুটবল ধরা দেয় তাঁর জীবনে।
ফিফায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে সালমা জানিয়েছিলেন, পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্ট ভুলেছেন তিনি খেলার মাঠে। এক পর্যায়ে তা জিদে রুপান্তরিত হয়। প্রতিদিন সকালে দৌড়ানোর সময় মনের মধ্যে জিদ নিয়ে দৌড়াতেন যে জিততে হবে! সালমা এই পথে স্পেনে ৩০০ মিটার ট্রিপল জাম্প, ৬০ মিটার হার্ডলস ও ৩০০ মিটার হার্ডলসেও জিতেছেন স্পেনের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। অ্যাথলেটিকসে প্রতিনিধিত্বও করেছেন দেশের। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই স্প্যানিশ ক্রীড়াঙ্গনে সালমা চিনতে শুরু করেন সবাই। তখনও অ্যাথলেটিকসের পাশাপাশি জারাগোজায় ফুটবল খেলছেন। কিন্তু সেখান থেবে পরের গল্পে শিরোনাম হয়ে দাঁড়ায় একটি প্রশ্ন—সালমা কোন খেলা বেছে নেবেন? ফুটবল না অ্যাথলেটিকস?
সালমার কোনো তাড়া ছিল না। দুটি খেলাই উপভোগ করছিলেন, ‘আমি খুব ভালো কিছু মানুষের সাহচার্য পেয়েছি। এক খেলার লোকজনের দাবি ছিল আমি যেন এটার সঙ্গেই থাকি, অন্য খেলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও দাবি ছিল একই। কিন্তু আমার নিজের ভাবনাটা পরিস্কার ছিল। পরিবার তা জানত। যতদিন পর্যন্ত উপভোগ করছি দুটোই চালিয়ে যাবো।’ এ নিয়ে সালমার ব্যাখ্যা ছিল, ‘অ্যাথলেটিকস দিয়ে আমি নিজেকে চিনেছি। জানতাম এই যে এত অনুশীলন করছি সবই নিজের জন্য। আর ফুটবলে আমি দলীয়ভাবে, নিজের আশপাশের মানুষের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি।’
কিন্তু সালমা বেশিদিন এভাবে থাকতে পারেননি। তাঁর বয়স যখন ১৬ বছর, স্প্যানিশ ফুটবলে প্রথম বিভাগের দলগুলো আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। জারাগোজার বয়সভিত্তিক দল থেকে সালমা যোগ দেন ভিয়ারিয়ালে। এভাবে পেশাদার ফুটবলে জড়িয়ে পড়েন এবং ভিয়ারিয়ালের (২০১৯–২২) সেসব দিনগুলোতে বাবা–মায়ের সঙ্গে পুনর্মিলনীও হয় ১৯ বছর বয়সী এই উইঙ্গারের। তার আগেই অবশ্য ২০১৮ অনূর্ধ্ব–১৭ বিশ্বকাপে স্পেন দলে ডাক পেয়েছিলেন। সেবার স্পেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে সতীর্থদের কাছ থেকে একটি তকমা পেয়েছিলেন সালমা—‘উসাইন বোল্ট’! পরের বছর ইউরোপিয়ান ইয়ুথ অলিম্পিক ফেস্টিভালে ৪০০ মিটার হার্ডলস ও ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে স্বর্ণপদক জিতে তকমাটি যথার্থ প্রমাণও করেন।
সালমা নিজের অ্যাথলেটিজমের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘আমি সব সময় সব খেলাতেই সেরা হতে চেয়েছি। আমাকে বলা হয়েছে, আমার শরীরটা অ্যাথলেটিকসের জন্য। আবার ফুটবলের লোকজন বলেছেন, আমার ফিটনেস অসাধারণ এবং অনুশীলনে সবকিছু শেখার সামর্থ্য আছে।’ গত বছরই অনূর্ধ্ব–১৭ ও অনুর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপজয়ী সালমা দুটি খেলা একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়ায় চোটেও পড়েছেন বেশ কয়েকবার। গত বছর মেয়েদের ইউরোয় জাতীয় দলে ডাক পেলেও চোটের কারণে খেলতে পারেননি। এরপর বার্সেলোনা তাঁকে সই করিয়ে অ্যালেক্সিয়া পুতেয়াসের সতীর্থ বানিয়ে দিল। ততদিনে সালমার চোখেমুখে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ভর করেছে, ‘সবাই বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে চায় আর আমরা সেটার জন্যই লড়াই করব।’ আর সালমা এটাও বুঝে গিয়েছিলেন ফুটবল বেছে নিয়ে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, ‘ফুটবল আমার জীবন। এটা আমার জীবনধারা। নিজেকে আমি ফুটবল দিয়েই প্রকাশ করে আনন্দ পাই।’
স্পেন এখন নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে। নিজেকে প্রকাশের সেরা মঞ্চটা ফাইনালেই পাবেন সালমা।