বাবার স্বপ্ন পূরণ করার আনন্দ আফঈদার
স্বপ্নটা অনেক বড় ছিল খন্দকার আরিফ হোসেনের। সাতক্ষীরা জেলা দলে খেলতেন, তবে চেয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলার হতে। ঢাকার ফুটবলে আবাহনী, মোহামেডানের মতো ক্লাবে তো বটেই, পরতে চেয়েছিলেন জাতীয় দলের জার্সিও।
কিন্তু সব স্বপ্ন কি আর পূরণ হয়? আরিফ হোসেনের সে স্বপ্নও হয়নি। তবে এখন তাঁর আনন্দের সীমা নেই। তাঁর সেই অপূর্ণতা যেন তিনি পূরণ করে ফেলেছেন মেয়ে আফঈদা খন্দকারকে দিয়ে। মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলে খেলছেন আরিফ হোসেনের কন্যা। তাঁর অধিনায়কত্বেই মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
গত সপ্তাহে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টের মহানাটকীয় ফাইনালের পর আরিফ হোসেন কন্যা আফঈদাকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলছিলেন, ‘আমি নিজে বড় ফুটবলার হতে চেয়েও পারিনি। কিন্তু আমার মেয়ে জাতীয় দলের জার্সি পরেছে, ওর নেতৃত্বেই দেশ জিতেছে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টের শিরোপা। আমার অপূর্ণতা মেয়েটা মিটিয়ে দিয়েছে। আমি যে কত খুশি, সেটি বলে বোঝাতে পারব না। আমি আফঈদার বাবা, কিন্তু দলের সবাই আমার সন্তান, খুব আদরের সন্তান।’
কাল বাফুফে ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি। ৮ ফেব্রুয়ারি ঘটনাবহুল ফাইনালের পর বাংলাদেশ, ভারত—দুই দলকেই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হলে ট্রফিটা ভারতকেই দিয়ে দেয় বাংলাদেশ। শিরোপার উৎসব তাই করা হয়নি আফঈদাদের। নতুন ট্রফি বানিয়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলকে সেই উৎসবই করার সুযোগ করে দেওয়া হয় কাল। অধিনায়ক আফঈদা উঁচিয়ে ধরেন গর্বের ট্রফি।
এমন আনন্দের দিনে বাবা আরিফ হোসেনের কথাই সবার আগে মনে পড়ল আফঈদার, ‘বাবা সব সময়ই চেয়েছেন আমি ফুটবল খেলি। অনেকেই বাঁকা চোখে তাকাত। কিন্তু বাবা সেসব পাত্তা দেননি। তিনি নিজে সাতক্ষীরা জেলা দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকায় বড় ক্লাবে খেলবেন, জাতীয় দলে খেলবেন। সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আমাকে ফুটবলার বানাতে চেয়েছিলেন সে কারণেই।’
আফঈদা জানান, ছোট বেলায় ফুটবলের প্রতি আগ্রহটা বাবার মাধ্যমেই চলে আসে তাঁর মধ্যে, ‘বাবা টেলিভিশনে খেলা দেখতে বসলে আমাকে নিয়ে বসতেন। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। নিয়মিত জাতীয় দলে খেলে আমি বাবাকে আরও গর্বিত করতে চাই।’
তাহলে আফঈদার সবচেয়ে বড় কোচ বাবাই? উত্তরটা সরাসরিই দিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক, ‘বলতে পারেন তিনিই। এখানে এসে ছোটন স্যার (গোলাম রব্বানী), লিটু স্যার (মাহবুবুর রহমান), টিটু স্যারদের (সাইফুল বারী) পেয়েছি। কিন্তু আমার ফুটবলে হাতেখড়ি বাবার কাছে। প্রতিটা ম্যাচের আগেই তিনি আমাকে পরামর্শ দেন। বলতে পারেন, তিনি আমার গৃহশিক্ষক।’
অনূর্ধ্ব-১৯ দলের রক্ষণে বড় স্তম্ভ অধিনায়ক আফঈদা। দলের অন্যদের চেয়ে কিছুটা লম্বা হওয়ায় রক্ষণভাগের মূল ভরসা তিনি। তবে আফঈদার কথা, ‘দলের বাকি ডিফেন্ডাররাও দুর্দান্ত। ইতি, জয়নাব, সুরমা, রুমা—সবাই দারুণ খেলেছে। সে কারণেই রক্ষণটাকে নিশ্ছিদ্র করতে পেরেছি। ওপরের দিকে সাগরিকা দারুণ; উমহেলা, স্বপ্না, পূজাসহ অন্যদের মিলিত পারফরম্যান্সেই আমরা ভালো করেছি।’ তবু একটা আক্ষেপ আফঈদার রয়েই যাচ্ছে, ‘যুগ্ম শিরোপা জিতেছি ঠিকই, কিন্তু মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁত থেকেই যাচ্ছে। ভারতকে হারিয়ে এককভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে ভীষণ ভালো লাগত।’
ফাইনালে টস-বিতর্কের খুব কাছের চরিত্র আফঈদা। টাইব্রেকারে ১১-১১ সমতার পর লঙ্কান ম্যাচ কমিশনার যখন ‘সাডেন ডেথে’ না গিয়ে টসের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন নাকি আফঈদার সঙ্গে কথাই বলেননি তিনি, ‘আমি বুঝতেই পারিনি টসটা কী কারণে হচ্ছে, টস নিয়ে বিতর্ক হওয়ার মধ্যেই ম্যাচ কমিশনার আর রেফারি আমাকে ডেকে নিয়ে টস করে ফেলেন। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। রেফারি কিন্তু প্রথমে আমাকে সাডেন ডেথ চলবে বলেই বলেছিলেন।’
ঘটনাবহুল নাটকীয় ফাইনালের পর যে শিরোপায় ভাগ রাখতে পেরেছেন, আফঈদার বড় তৃপ্তি এই জায়গাতেই। তবে আফঈদার আরেকটা গর্ব, দেশের হয়ে খেলে বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছেন। তবে পথচলার সবে শুরু এটি। আফঈদা জানেন, পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। নিয়মিত হতে হবে জাতীয় দলে। বাবা আরিফ হোসেনকে আরও গর্বিত করার এই সুযোগ ছাড়বেন কেন আফঈদা!