‘রক্ত ও দুর্নীতিতে নোংরা’ আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ

ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না–হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ১৯৭৮ বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।

খেলাধুলায় সাফল্যের আফিমে বুঁদ করে দেশের মানুষকে ভুলিয়ে রাখার কৌশল চিরন্তন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় আসর বিশ্বকাপ ঘিরেও এই চেষ্টা চলেছে। স্বৈরশাসকেরা নিজের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করে যেকোনোভাবে জিততে চান। তাঁদের আশার জায়গা, জয়ে সমস্ত অপশাসন ঢাকা পড়বে। এ জন্য কোনো কিছু তোয়াক্কা করতে তাঁদের বয়েই গেছে।

আর্জেন্টিনাকে ১৯৭৮ বিশ্বকাপের স্বাগতিক নির্বাচিত করা হয় ১৯৬৬ সালে, লন্ডনে। মেক্সিকো ১৯৭০ সালের আয়োজন করবে বিধায় আর্জেন্টিনা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই নির্বাচিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিলেও শেষ দিকে ঝামেলা বাধে। কারণ, টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র দুই বছর আগে সাবেক সামরিক শাসক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনবেকে সামরিক ক্যুয়ের মাধ্যমে অপসারণ করে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ভিদেলা। গোটা দেশ পরিণত হয় মৃত্যু উপত্যকায়। হাজার হাজার লোক গুম হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই নদীর পানিতে লাশের দেখা মিলত।

পশ্চিমাদের কেউ কেউ গাঁইগুঁই করছিলেন; মানবধিকার লঙ্ঘন, হেনতেন কথা বলে। কিন্তু ব্যবসাপাতির কারবার থাকায় শেষতক হালে পানি পায়নি। একটা হিসাবেও দেখা গেছে, ওই টুর্নামেন্টে ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো লোকসান হয়, যা শিয়ালের পিঠা ভাগের মতো আর্জেন্টিনার জেনারেল ও তাঁর বিদেশি বন্ধুরা ভাগাভাগি করে নেন।
খেলোয়াড়দের মধ্যে কেবল পশ্চিম জার্মানির পল ব্রেইটনারই সামরিক জান্তার গুম–খুনের প্রতিবাদে বিশ্বকাপ বর্জন করেন।

ঘরের মাঠে সেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা
ফাইল ছবি: এএফপি

সুইডেনের রনি হেইলস্ট্রেম পরে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মায়েদের গড়া সংগঠন ‘লাস মাদ্রেস দে লা প্লাজা দে মায়ো’র সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ করেন। এই প্লাজা মায়োর মায়েরা মানুষের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অনন্য সংগঠন। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মা আর দাদিরা একটা প্রশ্ন ‘আমাদের সন্তানেরা কোথায়?’—নিয়ে হাজির হতেন প্রতি সপ্তাহে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন স্বৈরাচার পতনের বড় প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।

তবে এই দুই খেলোয়াড়ের বাইরে সবচেয়ে বড় যে নামটি অনুপস্থিত থাকে, তা হচ্ছে ইয়োহান ক্রইফ। তখন নানা ধোঁয়াশা থাকলেও বছর তিরিশেক পরে জানা যায়, বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে ক্রুইফ ও ক্রুইফের পরিবারের সদস্যদের কিডন্যাপ করার চেষ্টা হয়, আর এতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন।

যেমনটা বহুদিন পর আর্জেন্টাইন সাংবাদিক এজকিয়েল ফার্নান্দেস মরিসের তদন্তে জানা যায়, জার্মানিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবাদ থাকলেও মার্সিডিজ-বেঞ্জ, সিমেন্স আর টেলফুনকেনের মতো কোম্পানির লোকসানের ভয়ে সে দেশের সরকার দল পাঠাতে দ্বিধা করেনি। মুরিস আরও দেখান, টুর্নামেন্ট চলাকালে ডাচ সরকার আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তাকে এবিএন ব্যাংকের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল, অস্ত্র ও ফকার প্লেন বিক্রি করেছিল।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চাপ বাড়লে ফিফা প্রেসিডেন্ট হোয়াও হাভেলাঞ্জ জেনারেল ওমর একটিসকে পরিকল্পনার দায়িত্ব দেন। ভিদেলার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রতিবাদী এই জেনারেলের পাল্টা যুক্তি, ঝাঁ–চকচকে নতুন স্টেডিয়াম আর তাতে আধুনিক টেলিভিশন বসানোর চেয়ে জনতার করের টাকা দিয়ে আরও অনেক জরুরি কাজ করা দরকার। এই কথা বিশ্ববাসীকে জানানোর আগেই তিনি বোমায় উড়ে যান, আর দোষ পড়ে মার্ক্সবাদী মন্তেনারো বিদ্রোহীদের।

ফাইনালে ডাচদের জালে গোল করছেন মারিও কেম্পেস
ফাইল ছবি: এএফপি

পরদিন তিনজন বিদ্রোহীর হাত-পা আলাদা করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আর সেদিনই অ্যাডমিরাল লাকোস্তে দায়িত্ব নেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি বিশ্বকাপের খরচ ১০০ মিলিয়ন থেকে ৭০০ মিলিয়নে উন্নীত করেন।

সেই টাকায় স্টেডিয়াম হয়, ধনীদের পাড়াগুলোয় আলোর ব্যবস্থা করে পাশের গরিব বস্তিগুলো ঢেকে রাখার ব্যবস্থা হয়। ১২ বছর পর যখন আদালতে প্রমাণিত হয়, লাকোস্তে অন্তত চার মিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন, তখন তাঁর বন্ধু হাভেলাঞ্জ দাবি করেন, তিনি আসলে সেই টাকা ধার দিয়েছিলেন, যেন লাকোস্তে উরুগুয়েতে একটা ভালো বাড়ি কিনতে পারেন। এই লুটপাট আর স্বৈরতন্ত্রের গল্প নিয়ে দিস্তা দিস্তা লেখা সম্ভব। তার চেয়ে খেলার মাঠে থাকাই ভালো।

বিশ্বকাপ শুরু হলো:

ভিদেলার আমন্ত্রণে হাজির ছিলেন মার্কিন কূটনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জার (৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার সক্রিয় সমর্থক)। দুজনে ‘মৈত্রী ও সম্প্রীতি’র বার্তা দিয়ে টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেন, ভিদেলা সব ‘দেশপ্রেমিক আর্জেন্টাইনকে জাতীয় পতাকার নিচে’ আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘২৫ মিলিয়ন আর্জেন্টাইন এই বিশ্বকাপে প্লে (খেলবে) করবে।’

সেবার টুর্নামেন্টের ফরম্যাটটা ছিল অদ্ভুত। প্রথমে ১৬টা দল ৪ গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে। সেই চার গ্রুপের আট দল আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে দুই গ্রুপে ভাগ হবে। এই দুই গ্রুপের সেরা দুই দল খেলবে ফাইনাল আর রানার্সআপে তৃতীয়-চতুর্থ স্থান নির্ধারণী ম্যাচ।

শুরুর ম্যাচটা আর্জেন্টিনা জেতে হাঙ্গেরির সঙ্গে। হারের পর হাঙ্গেরি কোচ লাজোস বারোতি বলেছিলেন, ‘সবকিছু, এমনকি বাতাসও আর্জেন্টিনার পক্ষে।’

১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফটোসেশনে মিশেল প্লাতিনি
ছবি: টুইটার

ফ্রান্সের সঙ্গে পরের ম্যাচে মিশেল প্লাতিনি নামক এক তরুণের নৈপুণ্যে হিমশিম খায় আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধে ফরাসি উইঙ্গার দিদিয়ের সিক্সের পেনাল্টি বক্সে ফাউলটা এড়িয়ে যান রেফারি। একজন ফরাসি খেলোয়াড়ের বয়ানে জানা যায়, সুইস রেফারি জ ডুবাস নাকি আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় ডেনিয়েল পাসারেলাকে বলেছিলেন, ‘পরেরবার কিন্তু সত্যি সত্যি পেনাল্টি দিয়ে দিব।’ তিনি আসলেই দিয়েছিলেন, তবে মাঠের উল্টা প্রান্তে। ফরাসি খেলোয়াড় মারিয়েস ট্রেসর পা পিছলে বলের ওপর পড়লে রেফারি ঘোষণা দেন, এটা হ্যান্ডবল, অর্থাৎ পেনাল্টি! গোল দেন প্যাসারেলা।

প্লাতিনি দুর্দান্ত এক গোল দেন, কিন্তু সিক্স তাঁর মোয়ার মতো বানানো বলে গোল দিতে পারেননি। শেষতক লুকের গোলে আর্জেন্টিনা জেতে।

বছর পঁচিশেক পর ২০০৩ সালে এই ম্যাচ নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়। ফ্রান্সের এক রেডিও অনুষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে গলার স্বর বিকৃত করে একজন বলেন, তিনি সেই টুর্নামেন্টে ফ্রান্স দলের খেলোয়াড় ছিলেন এবং খেলা শুরুর আগে তিনি দেখেন, বেশ কয়েকজন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় নীল রঙের বড়ি খেয়ে খেলতে নামেন। অ্যামফিটামিনের প্রভাবে তাঁরা এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ধরে চেচামেচি করেছেন। ওই টেলিফোনকারী আরও অভিযোগ করেন, ফিফার কর্মকর্তারা একজন বিখ্যাত আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়কে সেদিন বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্ট থেকে রেহাই দেন। এ নিয়ে কয়েকজন ফরাসি প্রতিবাদ করলে এক কর্মকর্তা উত্তর দেন ‘বোঝোই তো!’

ফরাসি ওয়েবসাইটগুলো অনুমান করেছে, সেই টেলিফোনকারী ছিলেন গুয়াদোয়েলপায় জন্ম নেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ সুইপার ব্যাক মারিওস ট্রেসর। এই দুর্দান্ত খেলোয়াড় ‘রহস্যজনক’ ইনজুরির কারণে সেই ম্যাচে খেলেননি। তবে ফোনদাতার পরিচয় কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।

অবশ্য অ্যামফিটামিনের প্রভাব থাকুক বা না থাকুক, লুকের গোলটা অতিমানবীয় ছিল। আর এর চেয়েও বেশি ছিল ৩০ গজ দূর থেকে করা গোলটার পর পুরো স্টেডিয়াম ফেটে পড়ার আওয়াজ।

সেই আওয়াজ শোনা গিয়েছে কয়েক কিলোমিটার দূরে আর্জেন্টিনার নেভি মেকানিক্যাল স্কুলেও। জায়গাটা তখন ব্যবহার করা হতো বন্দিশিবির ও অত্যাচারকেন্দ্র হিসেবে। ভিদেলার বাহিনী সেখানে ছেলেদের খোঁজা করে দিত, নারীদের ধর্ষণ করত। কুকুর, ইলেক্ট্রিক শকসহ নানা জিনিস দিয়ে ‘উন্নয়নবিরোধীদের’ শায়েস্তা করত।

১৯৭৮ বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে রাস্তায় এভাবেই প্রতিবাদ হয়েছে
ছবি: টুইটার

সেখানে একজন বন্দী ছিলেন ম্যানুয়েল কেলমেস, যাঁকে ধরে আনা হয়েছিল জান্তাবিরোধী লেখা প্রচারের দায়ে। ‘আমি সেখানে কয়েক সপ্তাহ ছিলাম, আমার মাথার ওপর একটা ব্যাগ রাখা হয়েছিল। কারণ, প্রহরীরা ভয় পেত, আমি অন্য বন্দীদের সঙ্গে পালানোর পরিকল্পনা করতে পারি। সেদিন লুকের গোলটার পর আমার কারা প্রকোষ্ঠে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, অবিরত ‘লুকে, লুকে’ ধ্বনি। এমনকি অন্য বন্দীরাও উল্লাসে যোগ দেয়। আর প্রহরীর প্রতিক্রিয়া ছিল অদ্ভুত। আমরা শুনতে পেলাম, সে জেলকক্ষের চারদিকে নেচে বেড়াচ্ছে আর কুকুরের মতো উল্লাস করছে। তবে হুট করেই সে চুপ হয়ে যায়, আমার কাছে চলে আসে এবং ফিসফিস করে বলে, “ জীবনের শেষ গোলের উল্লাস করে নে।” সে সময় ওর এই হুমকিকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না’—বলেছিলেন কেলমেস।

দ্বিতীয় রাউন্ডে গ্রুপ ‘এ’ থেকে সেমিফাইনালে যায় নেদারল্যান্ডস আর ইতালি। গ্রুপ ‘বি’তে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নিজ নিজ খেলায় জেতে। এর ফলে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর পরস্পরের মধ্যে পরের খেলাটা হয় অলিখিত সেমিফাইনাল। খেলার শৈলীর বদলে উত্তেজনা বেশি হওয়ায় গোলশূন্যভাবে ম্যাচটা শেষ হয়।

পরের খেলায় ব্রাজিল পোল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারায়। এর ফলে একই দিনে পেরুর সঙ্গে ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে অন্তত তিন গোলে জিততে হতো ফাইনালে উঠতে। ১৯৭৮ সালের ২১ জুন, রোজারিওতে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচ বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিতও।

কী হয়েছিল আর্জেন্টিনা বনাম পেরু ম্যাচে?

ম্যাচটা নিয়ে প্রথম সন্দেহ জাগে, যখন এর সময় পিছিয়ে ব্রাজিলের খেলা শেষ হওয়ার পর শুরু করা হয়। এর ফলে স্বাগতিকেরা নিশ্চিত হন, তাঁদের কয় গোলে জিততে হবে।
রোজারিওতে কেম্পেসের এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর আলবার্তো তারানতিনির গোলে প্রথমার্ধ স্বাগতিকেরা শেষ করে ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে। দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় দাঁড়িয়ে থাকা পেরুর বিরুদ্ধে দুটি গোল দেন লুক, কেম্পেস আরও একটি এবং হাউসম্যান একটি গোল করলে স্কোর দাঁড়ায় ৬-০।

পেরু দলের খেলোয়াড় রাউল গোরিত্তি সেদিনের অভিজ্ঞতা বয়ান করেন এভাবে, ‘খেলা শুরুর মিনিট পনেরো আগে প্রবল চেঁচামেচি আর উত্তেজনায় আমাদের কোনো কোনো খেলোয়াড় কাঁপছিল, কেউ কেউ শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে ভিদেলা আসলেন তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে এবং বললেন, ‘মনে রেখ, তোমাদের লাতিন ভাই কারা, আমরা এক হয়ে থাকব, ঠিক আছে তো? এরপর তিনি সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে একে একে হাত মেলান, কোচের সঙ্গে ফিসফিস করে কী যেন বলেন। পরিস্থিতিটা ছিল অদ্ভুত। আমার বিশ্বাস হয় না, আমাদের কেউ সেদিন ঘুষ নিয়েছিল। তবে এটাও ঠিক, পেরু একটা গরিব দেশ। এ কারণে ভিদেলার পক্ষে সহজ হয়েছিল আমাদের টার্গেট করা।’

বিতর্কিত আর্জেন্টিনা–পেরু ম্যাচের একটি মুহূর্ত
ছবি: ফিফা

আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া পেরুর গোলরক্ষক কুইরোগা এই ম্যাচের কিছুদিন পর সংবাদমাধ্যমে ঘুষ নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। পরে অবশ্য তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। ১৯৮৬ সালে সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে মারিয়া লোওরা আভিগনোলা দাবি করেন, আর্জেন্টিনা ও পেরুর মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী, আর্জেন্টিনা পেরুকে বিনা মূল্যে ৩৫ হাজার টন শস্য পাঠায় এবং সম্ভবত অস্ত্রও। একই সময়ে আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেরুর পাঁচ কোটি ডলার পরিমাণ ঋণ মওকুফ করে দেয়।

ভিদেলার আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন:

ফাইনাল শুরুর আগে বাসে বহু পথ ঘুরিয়ে বিরক্ত করা নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড়দের দর্শক–উন্মত্ততায় ছেড়ে দেওয়া হয়। পাঁচ মিনিট পর মাঠে ঢোকেন স্বাগতিকেরা। শেষ মুহূর্তে ইসরায়েলি রেফারি আব্রাহাম ক্লাইনকে বদলে ইতালিয়ান রেফারি সার্জিও গোনোলাকে দিয়ে খেলা পরিচালনা করানো হয়।

আর্জেন্টিনা নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জিতল। ছেলে হারানো প্লাজা দো মায়োর এক মা এই জয় নিয়ে বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা জিতল, কী দারুণ ব্যাপার, কিন্তু কাপটা নোংরা করে দিল রক্ত আর দুর্নীতিতে।’

ভিদেলার কাপ হাতে ছবি নয়, বরং ডিফেন্ডার তারানতিনি আর গোলরক্ষক ফিলোল যা করলেন, সেটাকেই বলা হলো জয়ের আসল প্রতীক। তাঁরা দুজন দুই হাত হারানো এক বাচ্চা ছেলেকে উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন কাপের মতো করে, আর এই ছবিটার নাম হয়েছিল, ‘আত্মার আলিঙ্গন’।

ফাইনালে গোলের পর কেম্পেসের উদ্‌যাপন
ছবি: ফিফা

তারানতিনির মতো আরেক বিপ্লবী কেলমেসের কথায় শেষ করা যাক। ২৫ জুন কেলমেসকে বন্দিশিবির থেকে নেওয়া হয় বুয়েনস এইরেসের মাঠে। দূর থেকে বন্দুক উঁচিয়ে বলা হয়, ‘উদ্‌যাপন করো, পালানোর চেষ্টা করলে গুলি খাবে।’

কেলমেস পালাননি, উদ্‌যাপনও করেননি। হয়তো ভাবছিলেন, কেম্পেসদের মতো নায়কদেরও সাহস হলো না ভিদেলার বিরুদ্ধে বলার। যেমনটা নাৎসি জার্মানিতে সব জানলে, সব বুঝলেও লোকে বলতে পারত না। কেলমেস হয়তো অবাক হয়ে ভাবছিলেন, কী অদ্ভুত এই মানবচরিত্র! এর মধ্যেও ওরা আনন্দ–উল্লাস করছে।

মানুষ সত্যিই বিচিত্র!