জিরোনা—বার্সার বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী থেকে শিরোপার দাবিদার
বার্সেলোনা আক্রমণভাগের খেলোয়াড় জুলস কুন্দ গোলের ৫০-৫০ সুযোগ নষ্টের পর জিরোনায় জন্ম নেওয়া ভ্যালেরি ফার্নান্দেজ ব্যবধান ৩-১ করলেন। বার্সেলোনার সমর্থকেরা ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, ঘরের মাঠে এই ম্যাচ যথেষ্ট দেখা হয়েছে, আর না!
ম্যাচে তখনো শেষ বাঁশি বাজতে প্রায় ১০ মিনিট বাকি। কিন্তু বার্সেলোনার কিছু সমর্থক গ্যালারি ছাড়তে শুরু করেছিলেন। এই প্রস্থানের মধ্য দিয়ে অনুচ্চারে তাঁরা একটি বিষয় যেন স্বীকার করে নিলেন। জিরোনা—স্পেনের কাতালান অঞ্চলের এ ক্লাবকে একসময় পুঁচকে প্রতিবেশীর নজরে দেখেছে বার্সেলোনা। একটু বন্ধুত্বপূর্ণ চোখে ছোটদের যেভাবে দেখা হয় আরকি! সেই ক্লাবই কিনা রীতিমতো পর্যুদস্ত করল বার্সাকে! আর খেললেও এমনভাবে যা এই মৌসুমে জাভি হার্নান্দেজের দলও মাঠে অনূদিত করতে পারেনি।
যোগ করা সময়ে ক্রিস্টিয়ান স্টুয়ানি ম্যাচের শেষ গোলে বার্সার হারের ব্যবধান ৪–২ বানিয়েই ছুটলেন। কোথায়? বার্সার এই মৌসুমে ঘরের মাঠ এস্তাদিও অলিম্পিক লুইসে যেখানে ‘অ্যাওয়ে’ সমর্থকেরা (জিরোনার সমর্থক) বসেছেন সেদিকে। জিরোনার বেঞ্চে বসে বদলির অপেক্ষায় থাকা খেলোয়াড় থেকে কোচিং স্টাফ—কেউ তখন আর নিজেদের ধরে রাখতে পারেননি। দৌড়ে নিজেদের অর্ধ পেরিয়ে যোগ দিয়েছেন স্টুয়ানির উদ্যাপনে। ‘কাতালান ডার্বি’ ততক্ষণে জিরোনার। লা লিগার শীর্ষ স্থানও। স্টেডিয়ামের ৪২ হাজার আসনে তখনো বার্সার কিছু সমর্থক অবশিষ্ট ছিলেন। জিরোনার সমর্থকেরা তাঁদের মধ্যেই লাফালাফি ও নেচে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। বার্সার সমর্থকদের খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু জিরোনার ভক্তদের আনন্দটাও বুঝতে হবে। ক্লাবের ইতিহাসে এই জয় যে এক ঐতিহাসিক মোড়!
এ ম্যাচের আগে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে জিরোনা কোচ মিচেল সানচেজ বলেছিলেন, ‘বার্সেলোনায় আমরা জিতলে ক্লাব অবশ্যই নতুন এক মাত্রা পাবে।’ শেষ বাঁশি বাজার পর কিন্তু সেটাই হলো। জিরোনা এখন লা লিগা শিরোপার সত্যিকার এবং বাস্তবসম্মত দাবিদার।
৪৮ বছর বয়সী জিরোনা কোচের কণ্ঠে সেই আত্মবিশ্বাসটাই ঝরল একটু অন্যভাবে, ‘লা লিগা জয় আমাদের লক্ষ্য নয়। আর আমি আমার দলকে অন্য কোনো দলের সঙ্গে তুলনা করতে চাই না, কিন্তু আমরা সত্যিই খুব ভালো খেলেছি।’
জিরোনা কোচ বলে চললেন, ‘লা লিগার জন্য এটা দারুণ বিজ্ঞাপন। দুই দল আক্রমণাত্মক করতে চেয়েছে, গোল করতে চেয়েছে। যেকোনো ফুটবল সমর্থকই এই ম্যাচ দেখলে জিরোনোর প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করবে। আমরা শেষ পর্যন্ত লা লিগা জিততে পারব কি না জানি না, তবে আজ রাতে (পরশু) টের পেয়েছি, আমরা যেকোনো দলকেই হারাতে পারি।’
১৬ ম্যাচে ৪১ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে জিরোনা। লিগের এ পর্যায়ে এসে এটি চতুর্থ সর্বোচ্চ পয়েন্ট সংগ্রহের নজির। ১৬ বছর আগেও স্পেনের চতুর্থ বিভাগে ছিল জিরোনা। আর ২৪ মৌসুম পিছিয়ে তাকালে দেখা যাবে পঞ্চম বিভাগে ছিল ক্লাবটি। সেটা ছিল আঞ্চলিক লিগ, যেখানে কাতালান অঞ্চলের স্থানীয় ক্লাবগুলোর মুখোমুখি হতো জিরোনা। তখন ঘরের মাঠে ম্যাচে মেরেকেটে প্রায় দুই শ সমর্থক হতো।
ক্লাবটির সভাপতি ডেলফি জেলি দুই সপ্তাহ আগে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’কে বলেছেন, ‘জিরোনার (অঞ্চল) নাগরিকেরা মূলত বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ এমনকি এস্পানিওলের সমর্থকেরাও আছেন। এটাই আমাদের বাস্তবতা এবং সর্বোচ্চ এতটুকুই আমরা অভিজাতদের কাছাকাছি আসতে পেরেছি। এই শহরে একসময় বাস্কেটবল দল ছিল, যারা শীর্ষ লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, কিন্তু ফুটবলে...আপনাকে অন্য কোথাও তাকাতে হবে।’
জিরোনার ২৬ বছর বয়সী অধিনায়ক অ্যালেক্স গার্সিয়া এই সপ্তাহেই জানিয়েছেন, শৈশবে তিনি ছিলেন বার্সেলোনার সমর্থক। ক্লাবটিতে খেলার স্বপ্ন দেখতেন। বার্সা থেকে এ মৌসুমে ধারে জিরোনায় যোগ দেওয়া এরিক গার্সিয়ার উদাহরণও দেওয়া যায়। সেই ৫ বছর বয়স থেকে বেড়ে উঠেছেন বার্সার ‘ফুটবল–খামার’ লা মাসিয়ায় এবং সব সময়েরই জন্যই বার্সার সমর্থক। আসলে কাতালান অঞ্চলের বাচ্চারা জিরোনাকে সমর্থন দিতে অভ্যস্ত নয়। স্পেনের ফুটবল মানচিত্রে জিরোনা যে জায়গা বড় করতে পারেনি। ২০১৭ সালে লা লিগায় প্রথমবারের মতো উঠে আসার আগে জিরোনা একবারই বার্সার মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু পরশু রাতে জিরোনা এমনভাবে সেই বার্সাকে হারাল, দেখে বার্সার কোনো সোনালি প্রজন্মের দলের জয় তুলে নেওয়ার স্মৃতি মনে পড়তে পারে।
বার্সার সঙ্গে বলের দখলে (জিরোনার ৪৭ শতাংশ) বলতে গেলে কাঁধে কাঁধে টক্কর দিয়েছে জিরোনা। তবে দেখার মতো বিষয় ছিল নিজেদের অর্ধ থেকে তাদের খেলা তৈরি করা, সেটা বার্সার হাই প্রেসিং খেলাও আটকাতে পারেনি। কৌশলগত খেলায় পুরো মার খেয়ে গেছে জাভির পরিকল্পনা। তাতে রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক প্রকল্প থেকে উঠে আসা মিগুয়েল গুতিরেজ আলাদা করে নজর কেড়েছেন। এই লেফট ব্যাক কাট ইন করে ঢুকে কখনো কখনো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারও বনে গেছেন!
বার্সেলোনা কিন্তু বাজে খেলেনি। তাদের প্রত্যাশিত গোলের হার ছিল ৪.০৬। জিরোনার ছিল ২.৪০। অর্থাৎ জিরোনার চেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করেছে বার্সা। কিন্তু জিরোনার ভয়ডরহীন খেলার সামনে বার্সা বারবার খাবি খেয়েছে। অথচ বার্সার কাছ থেকে এই ভয়ডরহীন ফুটবলই দেখতে চান তাদের সমর্থকেরা!
জিরোনার স্কোয়াডের বাইরেও অনেকেই বার্সার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাদের সভাপতি ডেলফি জিল লা মাসিয়ায় ফুটবল–দীক্ষা পেয়েছেন। ক্রীড়া পরিচালক কিকে কারসেলও একই জায়গা থেকে উঠে এসেছেন। ক্লাবটির অন্যতম সহমালিক পেরে বার্সেলোনার সাবেক এবং ম্যানচেস্টার সিটির বর্তমান কোচ পেপ গার্দিওলার ভাই। কোচ মিচেল সানচেজকে নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ফুটবল নিয়ে ক্লাব যে স্বপ্ন দেখছে তার সঙ্গে মিল পাওয়া। বাকিটা আস্থা, সময় দেওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্নের গল্প।
মিচেল কোচ হয়ে আসার পর তাঁর প্রথম ১০ ম্যাচে স্পেনের দ্বিতীয় বিভাগে অবনমন অঞ্চলে ধুঁকছিল জিরোনা। মাত্র দুই বছরের মধ্যে সেই দলটাই এখন দেশের শীর্ষ লিগে শীর্ষস্থানীয়! জিরোনা এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপক্ষ, যাদের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ভালোভাবে ‘হোমওয়ার্ক’ করতে হয় বার্সাকে।
ক্যাম্প ন্যুর ক্লাবটির সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা এর আগে বলেছেন, জিরোনার সঙ্গে সম্পর্কটা তাঁরা আরও ভালো করতে চান। ধারে তাদের সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় সরবরাহ করে দুই পক্ষেরই উপকার করতে চান। যদিও দুই মৌসুম আগেও জিরোনা বার্সার উইঙ্গার আবদে এজ্জালজৌলিকে ধারে চেয়ে পায়নি। গত মৌসুমের শুরুতে অবশ্য তারা বার্সার ২০ বছর বয়সী তরুণ পাবলো তোরেকে ধারে চেয়ে পেয়েছে। বার্সাও কিন্তু এখন জিরোনার সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের প্রতি আগ্রহী। ওরিওল রোমেউর কথাই ধরুন। গত মৌসুমে জিরোনার সেরা খেলোয়াড়টি যোগ দেন বার্সায়। পরশু রাতে তাঁকে মাঠে নামায়নি বার্সা। বেঞ্চে বসেই সাবেক দলের শীর্ষে ওঠা দেখতে হয়েছে।
শুধু রোমেউ নয়, ১৯ বছর বয়সী জিরোনা উইঙ্গার সাভিওর কথাই ধরুন। বার্সার ক্রীড়া পরিচালক এই তরুণকে নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত। তবে জিরোনা–বার্সার সম্পর্কে এই যে নতুন বাঁক, সেখানে এরিক গার্সিয়ার চেয়ে ভালো গল্প আর হতে পারে না। লা লিগার বেঁধে দেওয়া বেতন–সীমায় থাকতে ২২ বছর বয়সী গার্সিয়াকে ছেড়ে দিতে রাজি হয় বার্সা। জাভি তাঁকে চাইলেও গার্সিয়া পর্যাপ্ত খেলার সুযোগ না পাওয়ায় থাকতে রাজি হননি। রিয়াল বেতিস ও জিরোনার সঙ্গে তাঁর কথা চলছিল। জিরোনা কোচ মিচেলের সঙ্গে কথা বলার পর আর অন্য কিছু ভাবেননি গার্সিয়া। ক্লাবটির নির্বাহী পদে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র ‘দ্য অ্যাথলেটিক’কে বলেছেন, ‘গার্সিয়া (আমাদের ব্যাপারে) পুরোটাই বোঝে...সে প্রতিপক্ষকে নড়াচড়া করতে বাধ্য করে। বল পেয়ে একটি সহজ পাসে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে। এতে চাপটা কমে। এটা তো বার্সারই খেলার ডিএনএ। এই ফুটবলই আমরা খেলতে চাই। এটা কত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য, সেটা সে জানে।’
স্থানীয় ক্লাবের কাছে বার্সা শেষ কবে পরশু রাতের মতো পর্যুদস্ত হয়েছে, তা গবেষণার বিষয়। জিরোনার সমর্থকদের মনের মুকুরে স্বাভাবিকভাবেই এই ম্যাচটি অনেক দিন গাঁথা থাকবে। ম্যাচ শেষে বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজ নিজেই বলেছেন, ‘জিরোনা এখন শিরোপার জন্য লড়াই করতে পারে। তারা লা লিগার দাবিদার। মিচেল যা করেছে, তাতে আমি শুধু তাদের প্রশংসাই করতে পারি।’