যেমন গেল মেসির গোল করার দুই দশক

এল গ্যালাক্সির বিপক্ষে ম্যাচের একটি মুহূর্তে মেসিএএফপি

মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সির বিপক্ষে ম্যাচটা ইন্টার মায়ামির হাত থেকে প্রায় ফসকে গিয়েছিল। ৭৫ মিনিটে ডেজান জোভেলিচের করা গোলে হার দেখছিল লিওনেল মেসির মায়ামি। কিন্তু মেসি যখন দলে আছেন আর চিন্তা কী! আরও একবার দলের ত্রাণকর্তা হলেন ‘এলএম টেন’। ৯২ মিনিটে নিজে আক্রমণ তৈরি করে পরে ফিনিশও করেছেন দারুণ এক গোলে। এই গোলে দলের হার এড়ানোর সঙ্গে টানা ২০ বছর গোল করার অনবদ্য এক কীর্তিও গড়লেন মেসি।

পারানা নদীতে ধীর গতিতে ভেসে যাওয়া জাহাজ দেখে পথচলা শুরু করা ছোট্ট লিও (মেসি) পেশাদার ফুটবলে গোলের পথে যাত্রা শুরু করেন ২০০৫ সালের মে মাসে। লা লিগায় আলবাসেতের বিপক্ষে করেন নিজের প্রথম গোল। সেদিন কে ভেবেছিল, গোল দিয়ে যে প্রাসাদ তিনি গড়তে শুরু করলেন, একদিন তার উচ্চতা দেখে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে! ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ম্যাচের পর ম্যাচে গোল করলেও তাঁর মূল কাজটা কিন্তু গোল করা ছিল না।

আরও পড়ুন

বার্সেলোনাসহ যেসব ক্লাবে খেলেছেন এবং জাতীয় দল আর্জেন্টিনায় মেসি ছিলেন মূলত প্লেমেকার। কিন্তু তাঁর মতো মহাতারকার জন্য পজিশনিংয়ের এসব ‘জার্গন’ কি আর খাটে! যখন যেভাবে মন চেয়েছেন গোল করেছেন। গোল করা যেন তাঁর কাছে ছেলের হাতের মোয়া! হোক সেটা গোলরক্ষকসহ পাঁচজনকে কাটিয়ে কিংবা গজফিতা দিয়ে মাপা কোনো ফ্রি–কিকে অথবা গোলরক্ষকের মাথার ওপর চিপ করে।

ধরন যেমনই হোক, গোল করার ধারা থেকে কখনো সরে আসেননি মেসি। মেসির গোলের পরিসংখ্যান তাই যেকোনো জাত স্ট্রাইকারকেই লজ্জায় ফেলে দিতে যথেষ্ট। এমনকি ২০১২ সালে তাঁর করা ৯১ গোলের সুউচ্চ মিনারে আদৌ কেউ কখনো চড়তে পারবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

মেসির গোল উদ্‌যাপন
ইনস্টাগ্রাম

২০০৫ সালে পেশাদার ফুটবলে মেসির অভিষেক—সে বছর মেসি গোল করেছিলেন ৩টি। ২০০৬ সালে সংখ্যাটি ছিল ১২। পরের বছর সেই সংখ্যা ছিল ৩১। ২০০৮ সালে অবশ্য কিছুটা শ্লথ ছিল গোলের ধারা। সে বছর তিনি করেন ২২ গোল। ২০০৯ সাল থেকে গোলসংখ্যা বাড়তে শুরু করে বল্গাহীনভাবে। সে বছর মেসি ৪১ গোল করেন। আর ২০১০ সালে সে সংখ্যাটাই ছাড়িয়ে যায় পঞ্চাশের ঘর। বছরজুড়ে মেসি করেন ৫৯ গোল। ২০১১ সালে সেটি ছিল ৬০।

আরও পড়ুন

আর ২০১২ সাল ছিল গোলের দিক থেকে মেসির ‘ম্যাগনাম ওপাস’ বা শ্রেষ্ঠতম বছর। সে বছর মেসি করেন ৯১ গোল। যা এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট বছরে কোনো খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ গোল। এরপর অবশ্য আর কোনো বছরেই গোলের সংখ্যা ৬০ ছাড়াতে পারেননি মেসি। তবে প্রতি মৌসুমে গোলের দিক থেকে ধারাবাহিকতা ধরে রেখে অক্ষুণ্ন রেখেছেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব।

এর মধ্যে লা গিলায় মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের পিচিচি ট্রফিও ঝুলিতে ঢুকেছে সর্বোচ্চ ৮ বার। লা লিগায় মেসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এ পুরস্কার জিতেছেন মাত্র ৩ বার। অদূর ভবিষ্যতে এই রেকর্ড অন্য কেউ ভাঙতে পারবেন, তেমনও কোনো ইঙ্গিতও নেই।

শুধু লিগেই নয়, ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চেও গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন মেসি। চ্যাম্পিয়নস লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২৯ গোল তাঁর। এ তালিকায় মেসির ওপরে আছেন কেবল ১৪০ করা রোনালদো। মেসির হাত ধরেই তিনবার ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি জিতেছে বার্সা। আর ফুটবল ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮২১ গোল করার কীর্তিও তাঁর। এখানে তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল রোনালদো (৮৭৬)। আর ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি ব্যালন ডি’অরও মেসির হাতে উঠেছে সর্বোচ্চ ৮ বার।

গোল করা মেসির জন্য আসলে নৈমিত্তিক একটি কাজ। বল পায়ে গেলে জাদুকরি ছোঁয়া এবং অবিশ্বাস্য সব গোল করাই যেন তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত। গত দুই দশকে ফুটবলের অলৌকিক কাণ্ডকীর্তিকে স্বাভাবিক স্তরে নামিয়ে এনেছেন মেসি। পাঁচজনকে কাটিয়ে মেসির গোল করাও তাই যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অবশ্য এটাও সত্য যে অতিমানবীয় কাজগুলোকে মানবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনাই মেসিকে আজকের মেসি হিসেবে গড়ে তুলেছে। এ জন্যই তিনি অনন্য।

আরও পড়ুন

এরপরও এলএ গ্যালাক্সির বিপক্ষে মেসির গোলটি নানা দিক থেকে একটু বিশেষ। এই গোল দিয়েই গোল করার দুই দশক ধরে গোলের ধারা অব্যাহত রাখলেন বিশ্বকাপজয়ী মহানায়ক। পাশাপাশি মেসির এই গোল এমএলএসের শিরোপাপ্রত্যাশী দলগুলোর জন্য একটি বার্তাও। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র তিনি শুধুই পিকনিক করতে আসেননি। এখনো বল পায়ে তিনি আগের মতোই ক্ষুরধার এবং গোল করতেও আগের মতোই মরিয়া। এখানে তাঁর প্রধান লক্ষ্য মায়ামিকে শিরোপা জেতানো। আর বছর বছর শিরোপা জেতাও তো মেসির জন্য ডালভাত। তাহলে হয়ে যাক মেসিময় আরেকটি মৌসুম!