গরুর হাটের আয়ে চলে যে ক্লাব
পুরান ঢাকার চকবাজার মোড়ের ভিড়–হট্টগোল ঠেলে এগিয়ে গেলে তিন মাথার একটি মোড়। ডান দিক ধরে সোজা গেলে রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির মাঠ, পাশেই ক্লাব ভবন। বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত খেলা মাঝারি শক্তির এই ক্লাবের মাঠে এখন চলছে ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর হাট।
ঈদের এখনো কয়েক দিন বাকি, এরই মধ্যে বিশাল মাঠটি ভরে গেছে নানা রং আর আকৃতির গরুতে। এলাকাতেও যেন একটা উৎসবের আমেজ। রহমতগঞ্জ ক্লাবের জন্য বছরে একবার বসা এই পশুর হাট খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারও। এই হাটই যে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির আয়ের প্রধান উৎস। একসময় অবশ্য কোরবানির পশুর হাট আয়ের উৎস ছিল ঢাকার আরেক ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়নেরও। গোপীবাগে ব্রাদার্স ক্লাব–সংলগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক মাঠে আশি ও নব্বইয়ের দশকে প্রতি ঈদুল আজহাতেই হাট বসত। এখন সেটি আর বসে না।
সোয়ারীঘাটের পাশে রহমতগঞ্জ ক্লাবের মাঠটা তৈরি করেছিলেন মইনুল ইসলাম নামের এক ক্রীড়ানুরাগী। ষাটের দশক থেকেই এই মাঠ রহমতগঞ্জ ক্লাবের। শতবর্ষ আগে পুরান ঢাকায় বসত গরু বেচাকেনার গনি মিয়ার হাট।
হাতঘুরে সেই হাটই ১৯৬৭ সাল থেকে পরিচালনা করে আসছে রহমতগঞ্জ ক্লাব। গরুর হাটের আয় ছাড়া রহমতগঞ্জ ক্লাব ফুটবল দলই বানাতে পারবে না। প্রতি মৌসুমে ক্লাবটি ঘরোয়া ফুটবলের জন্য যে দল গড়ে, সব মিলিয়ে তার খরচ দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মতো। খরচের বড় অংশই মেটে কোরাবানির গরুর হাট থেকে আসা আয়ে। এ ছাড়া ক্লাবের আশপাশে থাকা গোটা কয়েক দোকান ও কারখানার জায়গা ভাড়া দিয়েও কিছু টাকা আসে। সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুদান। সবকিছুর পরও রহমতগঞ্জকে যে নিয়মিত দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে দেখা যাচ্ছে তাতে মূল অবদান এই গরুর হাটের।
সম্প্রতি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ হামিদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গরুর হাট ছাড়া রহমতগঞ্জ ক্লাবের টিকে থাকাই মুশকিল। প্রতিবছর হাট ইজারা দিয়ে ক্লাব দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা আয় করে। এটাই আমাদের আয়ের প্রধান উৎস। খরচটরচ বাদ দিয়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা থাকে তহবিলে। এই টাকা দিয়েই আমরা প্রতি মৌসুমে দল গড়ি।’
দেশের ফুটবল বেশির ভাগ ক্লাবেরই নিজেদের মাঠ নেই। মোহামেডানের মতো বড় ক্লাবও অনুশীলন করে এদিক–সেদিক ঘুরে। রহমতগঞ্জ ছাড়া নিজস্ব মাঠ আছে শুধু বসুন্ধরা কিংস, আবাহনী লিমিটেড, শেখ রাসেল ও শেখ জামাল ধানমন্ডির। রহমতগঞ্জ এই তালিকায় আছে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে।
অবশ্য প্রতিবছর গরুর হাট বসিয়ে রহমতগঞ্জ মাঠ ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। মাঠে বসা গরুর হাট ক্লাব ভবনটিকেও অপরিষ্কার–অপরিচ্ছন্ন করে তোলে। ক্লাব ভবনের একটি অংশ ব্যবহার করা হয় গরু ব্যবসায়ীদের থাকা–খাওয়ার জন্য। তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষ মনে করে, বৃহত্তর স্বার্থে এটুকু ক্ষতি স্বীকার করাই যায়। সাধারণ সম্পাদক আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন, ‘আগেই বলেছি, গরুর হাটই আমাদের টিকে থাকার মূল অবলম্বন। এটিই আমাদের স্থায়ী আয়। আমরা এটিকে বৃহত্তর লাভের জন্য খানিকটা স্বার্থ ত্যাগ হিসেবেই দেখি। গরুর হাটের সময় মাঠ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্লাবের পরিবেশ নষ্ট হয়, সবই মানছি। তবে আমরা হাটের পর দ্রুত মাঠ ঠিক করে ফেলি। ক্লাবের পরিবেশও আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনি। এ জন্য আলাদা বরাদ্দও থাকে।’
কোরবানির সময়ে ফুটবল মৌসুম চললে গরুর হাট বড় সমস্যাই হয়ে দাঁড়ায়। গত মৌসুমে যেমন ঈদুল আজহার পরেও এক মাস ফুটবল লিগ চলেছে। ক্লাবের ফুটবলারদের জন্য ওই সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এমন পরিবেশেই থাকতে হয়েছে অনেককে, অনুশীলনের জন্য ঘুরে বেড়াতে হয়েছে এ–মাঠ থেকে সে–মাঠ। তবে সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, গত বছরের হাটের টাকাতেই ক্লাবের দোতলায় জিম তৈরির কাজ চলছে। তাঁর আক্ষেপ অন্য জায়গায়। আবাহনী, মোহামেডান বা অন্য ক্লাবগুলো পৃষ্ঠপোষক পেলেও রহমতগঞ্জ, ফরাশগঞ্জের মতো ক্লাবগুলোর দিকে কোনো প্রতিষ্ঠান ফিরেও তাকায় না। ফুটবলের পেশাদারির এ যুগেও দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা একটি ক্লাবকে তাই টিকে থাকতে হচ্ছে গরুর হাটের ওপর।