ব্রাজিলের ‘নতুন রোনালদো’কে এত দামে কেন কিনতে চাইছে বার্সেলোনা
খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবল। কাতার বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর পুঁচকে দলগুলোর সঙ্গেও নাকাল হচ্ছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। গত ডিসেম্বরের পর মরক্কো ও সেনেগালের মতো দলের কাছেও হেরেছে ব্রাজিল। এমনকি বিশ্বকাপ শেষে এখন পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদে কোনো কোচও নিয়োগ দিতে পারেনি তারা। যে নেইমারের ওপর গত প্রায় এক দশক ধরে ভরসা করে আছে ব্রাজিলের ফুটবল, তাঁর বয়স ও ফিটনেস ইতিবাচক কোনো বার্তা দিতে পারছে না।
এমন পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের দরকার নতুন কোনো ত্রাতা। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র-রদ্রিগোরা এরই মধ্যে নিজেদের সম্ভাবনা জানান দিয়েছেন। সে দলে এবার যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা শোনা যাচ্ছে ভিতর রকিরও। তাঁর জন্য ৩৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে প্রস্তুত হয়েছে বার্সেলোনাও। কিন্তু ১৮ পেরোনো রকির মধ্যে এমন কী আছে, যাঁর পেছনে বার্সা এত টাকা খরচ করতে রাজি?
ফুটবলের নতুন পেলে কিংবা নতুন ম্যারাডোনার আগমনের কথা একসময় বেশ শোনা যেত। লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর উত্থানের পর সেই রব অনেকটাই কমে আসে। তবে এখন এসে কৈশোর পেরোনোর তারকাদের মধ্যে পড়ন্ত বেলায় থাকা মেসি কিংবা রোনালদোর ছায়া খোঁজা হচ্ছে। তবে রকির মধ্যে মেসি বা পর্তুগিজ রোনালদোর নয়, তাঁর মধ্যে অনেকে দেখছে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো ‘ফেনোমেনন’–এর ছায়া। আর রকির স্বপ্ন নেইমারের সঙ্গে খেলা।
এর আগেও অনেকের মধ্যে রোনালদোকে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আর সে মানে পৌঁছতে পারেননি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রকি কি পারবেন নিজেকে রোনালদো নাজারিওর মানে নিয়ে যেতে? সে প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতেই তোলা রইল। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কৈশোরেই নিজের ঝলক দেখিয়েছেন বলেই রকির নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে রোনালদোর নাম। সেই ঝলকটুকু কেমন, তা এবার জেনে নেওয়া যাক।
প্রতিবছরই ব্রাজিলের শীর্ষ পর্যায়ের মেধাবী কিশোরেরা ইউরোপে পাড়ি জমায়। দক্ষতা, দ্রুততা এবং প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন হওয়ার কারণে তাদের নিয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর বেশ আগ্রহও থাকে। কিন্তু সবাই যে নিজেদের প্রমাণ করতে পারেন, তা নয়। কেউ কেউ অকালেই ঝরে পড়েন। কেউ হয়তো শুরুটা ভালোভাবে করেও পরে সেটা আর ধরে রাখতে পারেন না।
আবার কেউ হয়তো যতটা সম্ভাবনা নিয়ে আসেন, ততটা দেখাতে পারেন না। গড়পড়তা মান নিয়েই ক্যারিয়ার শেষ করেন। খুব অল্পজনই আছেন যাঁরা নিজেদের নেইমার, রোনালদিনিও কিংবা রোনালদো হতে পারেন। সর্বশেষ যে ব্রাজিলিয়ানের মধ্যে এ পর্যায়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে, তাঁর নাম রকি। তাঁর খেলায় রোনালদোর ছায়া দেখেই হয়তো বার্সেলোনার মতো শীর্ষ ক্লাব তাঁকে পেতে উঠেপড়ে লেগেছে।
রোনালদোর মতো ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ক্রুজেইরোর হয়ে যাত্রা শুরু করেন রকি। ১৬ বছর বয়সে নিজের প্রথম গোলটিও করেন ক্লাবের হয়ে। দারুণভাবে বলের নিয়ন্ত্রণ রেখে ক্রুইফ টার্ন, স্টেপওভার এবং দুর্দান্ত কাটে চমকে দিতে পারেন রকি। সবকিছু হুবহু ফেনোমেননের মতো না হলেও অনেক কিছুতেই তাঁর ছাপ রয়েছে। তাই ফেনোমেনোনের সঙ্গে তুলনা শুরু হতেও সময় লাগেনি।
ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের শহর তিমোতেওর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছেন রকি। বাবা অপেশাদার ফুটবলার ছিলেন, খেলেছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে। নিজে ফুটবলে ভালো কিছু করতে না পারলেও ছেলের প্রতিভাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন এবং তাঁকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। রকি শুরু থেকেই সহজাত সৃষ্টিশীল ফুটবলার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ১০ বছর বয়সে আমেরিকা মিনেইরোর হয়ে ফুটবলের হাতেখড়ি তাঁর।
তারপর ২০১৯ সালে চলে যান ক্রুজেইরোতে। মাত্র দুই মৌসুম বয়সভিত্তিক দলে খেলার পর ২০২১ সালে ক্লাবের হয়ে অভিষেকও হয়ে যায় তাঁর। শুরুতে বাবার মতো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও এরপর ধীরে আক্রমণভাগে খেলতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত থিতু হন স্ট্রাইকার হিসেবে। এখন গোল করতেই বেশি পছন্দ রকির। এর মধ্যে ব্রাজিলের জার্সিতেও ইতিহাস গড়েছেন রকি। মরক্কোর বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার পর রকি এখন এ শতাব্দীতে ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষিক্ত সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। সেই ম্যাচ দিয়ে রোনালদোর পর সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবেও ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয়েছে রকির।
ক্রুজেইরোতে নিজেকে পরিণত করে তোলা রকি ক্লাবটিতে নিজের প্রথম পেশাদার চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন ২০২১ সালের মে মাসে। ৯ মাস পরেই মূল দলের হয়ে প্রথম গোল করেন এই ফুটবলার। দলের এপ্রিল ২০২২–এর মধ্যে ১৬ ম্যাচে ৬ গোল করেন রকি। রকির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে গত বছরের এপ্রিলে অ্যাথলেটিকো পারানায়েনসে নিজেদের দলবদলের রেকর্ড ভেঙে ৪.৪ মিলিয়ন ইউরোতে রকিকে দলে ভেড়ায়। এই ক্লাবের হয়ে শুরুতে একাদশে জায়গা পেতে কষ্ট হয়েছে তাঁর। কিন্তু মাঠে যখনই নামার সুযোগ পেয়েছেন প্রমাণ করেছেন নিজেকে।
২০২২ মৌসুমে ৭ গোল এবং ৩টি অ্যাসিস্ট করেছেন রকি। যেখানে কোপা লিভার্তাদারোসের কোয়ার্টার ফাইনালে করা গোলও আছে। একই সময়ে ব্রাজিলের বয়সভিত্তিক দলেও নিয়মিত খেলেছেন রকি। সে সময়টাতেই ব্রাজিলের ফুটবল পণ্ডিতরা তাঁকে ‘নতুন রোনালদো’ তকমা দেন।
লাতিন আমেরিকা থেকে তাঁর দ্যুতির খবর ইউরোপে ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আগস্ট হতে না হতেই লা লিগা ও প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো নড়েচড়ে বসতে শুরু করে। বিশেষ করে ফেনোমেননের সঙ্গে তুলনা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে সে পরিস্থিতিটা বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন রকি। এ ব্যাপারে কিংবদন্তি কোচ লুইস ফিলিপ স্কলারির দারুণ সহায়তাও পেয়েছেন বেশ। রকিকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের সময়টাতে পারানায়েনসের তখনকার কোচ স্কলারি অনেকটা সচেতনভাবেই রয়েসয়ে রকির প্রশংসা করেন। গত বছরের জুলাইয়ে স্কলারি বলেছেন, ‘সে আরও ভালো করবে। যদি সে নিজের উন্নতি ধরে রাখতে পারে তবে এমন একজন খেলোয়াড় হবে, যার কাছ থেকে ব্রাজিল অনেক আনন্দ পাবে।’
এরপর প্রায় এক বছরের মধ্যে ক্যারিয়ারে নতুন বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছেন রকি। এরই মধ্যে ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়েছে তাঁর। বার্সেলোনার দুয়ারও খুলে যাচ্ছে এই তরুণ তুর্কির জন্য। আধুনিক ফুটবলে সাফল্য লাভে সবচেয়ে জরুরি দুটি বিষয় শারীরিক সক্ষমতা ও দক্ষতা ভালোভাবেই আছে রকির। চাপের মধ্যে বলের নিয়ন্ত্রণ রেখে মার্কারকে ছিটকে এগিয়ে যাওয়ার দারুণ সামর্থ্যও আছে।
পাশাপাশি ডান পায়ের নজরকাড়া ফিনিশিং ও বক্সের ভেতর বুদ্ধিদীপ্তভাবে জায়গা বের করার ক্ষেত্রেও জাদু দেখাতে পারেন রকি। শুধু মাটিতেই নয়, বাতাসেও (এয়ারে) বল সামলানোর দক্ষতা আছে তাঁর। ডান পায়ের খেলোয়াড় হলেও প্রয়োজনে খেলা বদলে দিতে পারেন বাঁ পায়েও। এ ছাড়া পাসিং, উইংয়ে খেলা এবং দারুণ সব ক্রসও দিতে পারেন।
দারুণ সব গুণ থাকার পরও উন্নতির কিছু জায়গা আছে রকির। বিশেষ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও পরিপক্ব হতে হবে তাঁকে, ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেলার ধরন পরিবর্তনেও নিজেকে পরিণত করতে হবে। তবে বার্সেলোনার মতো ক্লাবে গেলে এসব সমস্যা সমাধানে রকির খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। সব মিলিয়ে রকির জন্য মঞ্চটা এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন শুধু তাঁর ডানা মেলার অপেক্ষা।