মেসিকে পেয়ে যা হারাল মায়ামি
‘আমি ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছি’—মেসির এই ঘোষণা বদলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলকে। এই এক ঘোষণার পর দেশটির খেলাধুলার ইতিহাসটাও লিখতে হচ্ছে নতুন করে। মেসির সেই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের খেলাধুলায় চতুর্থ স্থানে থাকা ফুটবলের জগৎও মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। বলাবাহুল্য, এই বদলের ধাক্কাটা সবচেয়ে বেশি গেছে ইন্টার মায়ামির ওপর দিয়ে। মাঠের খেলা, শিরোপা, বাণিজ্য—সব দিক থেকে গত জুনের পর অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে মায়ামি।
মায়ামি, মেজর লিগ সকার (এমএলএস) এবং যুক্তরাষ্ট্রের খেলার জগতে মেসি যেসব ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন, তা নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। এর মধ্য দিয়ে ফুটবলে নতুন দিগন্তের উন্মোচনও দেখছেন অনেকে। কিন্তু উজ্জ্বল আলোকবাতির নিচে কিছু অন্ধকারও নাকি জড়ো হয়। সেই অন্ধকারটুকুই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
মেসির যুক্তরাষ্ট্রে আগমনের সিদ্ধান্তের পর মায়ামির মালিক হোর্হে মাস–ডেভিড বেকহাম থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষ দলের মালিক–কোচরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সেই উচ্ছ্বাসে সুর মেলাতে পারেননি মাইক লনগিন।
মেসির আগমনের খবর শুনে কী করেছিলেন, তা জানাতে গিয়ে মায়ামির সমর্থক গোষ্ঠী গ্রিন লট গ্যাং–এর এই সদস্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘যখন খবরটি সামনে এল, আমি ফোন বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার বন্ধু, আমার পরিবারসহ অনেকে ফোন করে বলল, “মেসি আসছে। আমরা তোমার জন্য রোমাঞ্চিত।” দিনটা রোমাঞ্চকরই ছিল। কিন্তু প্রথম দিন থেকে এই ভাবনাও ছিল যে “আচ্ছা, এর অর্থ কী?” আমরা জানতাম কোনো কিছু আর আগের মতো থাকবে না।’
হ্যাঁ, আগের মতো যে থাকবে না সেটা সবাই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু লনগিনের উপলব্ধিটা গড়পড়তা ভাবনার চেয়ে একটু ভিন্নই ছিল। মেসির আসার ঘোষণায় যখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে হলিডউ তারকারা পর্যন্ত রোমাঞ্চিত ছিলেন, তখন এর অন্য একটা দিক নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় ছিলেন এই মায়ামি–ভক্ত। সেটি ছিল ক্লাবটির সঙ্গে এর সমর্থকদের সম্পর্ক।
মেসি আসার আগে ম্যাচের দিন খেলোয়াড়েরা ডিআরভি পিএনকে স্টেডিয়ামে যাওয়ার আগে ক্লাবের অনুশীলন মাঠে জড়ো হতেন। খেলোয়াড়দের যাতায়াতের পথ বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা থাকলেও সমর্থকদের সব সময় স্বাগত জানানো হতো। এমনকি বেষ্টনীর কাছাকাছি জায়গায় খেলোয়াড় এবং সমর্থেকেরা হাতও মেলাতেন। কেউ কেউ তখন সেখানে অটোগ্রাফ নিতেন, কেউ আবার সেলফি তুলতেন। কিন্তু মেসি আসার পর তাঁকে দেখার জন্য নব্য সমর্থক এবং সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে সেটি যে আর সম্ভব হবে না, তা অনেকটা অবধারিতই ছিল। বিপরীতে এখন প্রি–ম্যাচ আনুষ্ঠানিকতা সেরে খেলোয়াড়েরা সরাসরি মাঠেই চলে যান।
সম্পর্কের বদল নিয়ে লনগিন বলেন, ‘ইন্টার মায়ামিকে আগে যা বিশেষ করে তুলত, তা হলো এর দারুণ সমর্থক গোষ্ঠী। যাদের সঙ্গে মালিকদের খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল।’ এরপর সম্পর্ক কীভাবে বদলে গেল লনগিন সে বর্ণনা দিলেন এভাবে, ‘আমি আগে ডেভিড বেকহামের সঙ্গে বিয়ার পান করতাম। নিজেদের ছড়িয়ে দিতে ক্লাব অনেক করেছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। পারিবারিক আবহ এখন পেশাদারত্বের আবহে রূপ নিয়েছে। আমরা একটি তরুণ ক্লাব ছিলাম। কিন্তু রাতারাতি আমরা বড় হয়ে গেলাম।’
মেসি আসার পর স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরীণ চিত্রও বদলে গেছে। এর আগে ইন্টার মায়ামির দর্শক উপস্থিতির গড় হার ছিল সর্বনিম্ন। কিন্তু মেসি আসার পর ম্যাচগুলোতে এখন দর্শক উপচে পড়ছে। যা দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক ভক্ত মানতে পারছেন না। তাঁরা মনে করেন, পূর্ণ স্টেডিয়াম সব সময় দারুণ পরিবেশ উপহার দিতে পারে তা নয়।
লনগিন বলেছেন, ‘মেসির আগমন ম্যাচ উপভোগে কিছু নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে। যেহেতু তারা শুধু মেসিকেই দেখতে আসে, বাকি দল নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। যখন মেসি খেলে না এবং সে স্ট্যান্ডে বসে থাকে তখন লোকেরা লাফিয়ে চেয়ার উঠে তাকে দেখার চেষ্টা করে।’ তিনি আরও যোগ করেছেন, ‘আমরা জানতাম পরিস্থিতি বদলে যাবে। কিন্তু কীভাবে সেটি বদলাবে এবং আলাদা হবে তা নিয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ঘরের মাঠে শেষ ম্যাচে মেসি খেলেনি, সেদিন সেটাকে পুরোনো দিনের স্টেডিয়াম বলেই মনে হয়েছে।’
শুধু ভক্তরাই নন, যেসব সাংবাদিক আগে থেকে ইন্টার মায়ামির খবর সংগ্রহ করতেন, তাঁরাও ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। মায়ামি হেরাল্ডের অভিজ্ঞ প্রতিবেদক মাইকেল কাউফমান বলেছেন, ‘৭ জুনের পর আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। মেসি আসার আগে আমরা মুষ্টিমেয় কজন দলটির খবর সংগ্রহ করতাম।’ সে সময় দুই–একজন সাংবাদিক খবর সংগ্রহ করতে এলেও মেসি আসার পর পরিস্থিতি কেমন হলো তা কাউফমান জানালেন এভাবে, ‘যে মুহূর্তে সে এল, সবকিছু বদল গেল। অনুশীলন দেখতে যেতে এখন মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়েই যেতে হয়। তার (মেসি) প্রথম অনুশীলনের দিন ৫০০ জন সাংবাদিক ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চেয়েছিল। আমার মনে হয় ২০০ জন পেয়েছিল। মাথার ওপর এখন হেলিকপ্টার এবং ড্রোন উড়তে দেখা যায়। আগে যা ছিল তা থেকে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি মার্কিন খেলার জগতের অনেক তারকার খবর কাভার করেছি। কিন্তু মেসি–ম্যানিয়ার মতো এমন কিছু আর কখনো দেখিনি।’
শুধু মানসিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও সমর্থকদের বড় ধরনের চাপে ফেলেছে মেসির আগমন। কিছুদিন আগে ২০২৪ সালের টিকিটের মূল্য দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে ইন্টার মায়ামি। যা চাপে ফেলেছে সমর্থকদের। লনগিন বলেছেন, ‘এই ঘটনা অনেককে বিস্মিত করেছে। এই মূল্য অনেকের সাধ্যের বাইরে। এটা হজম করা কঠিন। অনেকে এতে হতাশ হয়েছে।’
সমর্থকদের এমন দুরবস্থা ও মানসিক পীড়নের পরও অনেকেই হয়তো ক্লাবের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্র্যান্ড মূল্য এবং মাঠের সাফল্যকেই বড় করে দেখবেন। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে সমর্থকেরাই হচ্ছেন খেলাধুলা অন্যতম বড় স্তম্ভ, তারাই এই খেলাটির প্রাণ। তাই মেসি আসার পর বড় হয়ে ওঠার পথে থাকা মায়ামিকে সমর্থকদের সঙ্গে একটি ভারসাম্য আনতে হবে। কারণ, তারকারা আসবেন তাঁরা চলেও যাবেন। কিন্তু ক্লাবের নিউক্লিয়াস হয়ে সমর্থকেরা সব সময় সেখানেই থেকে যাবেন।