ম্যানচেস্টারের বিষণ্ন আকাশের নিচে গার্দিওলা–আমোরিমের অস্তিত্বের লড়াই
নাকের ঠিক মাঝখানে কাটা দাগ। মনে হলো একটু আগে কেউ খামচি দিয়ে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে জিজ্ঞেস করা হলো, এটা কীভাবে হলো! অকপট পেপ গার্দিওলা জানালেন, নিজেই নখ দিয়ে আঁচড়েছেন। বিস্মিত হওয়ার মতোই ঘটনা বটে। পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ ম্যাচ জিততে না পেরে এমন করবেন কেন! কারণ একটাই, লোকটার নাম গার্দিওলা। যিনি জানেন না লাগাতার হার কাকে বলে, এমনকি শিরোপা না জেতা মৌসুমের স্বাদ তাঁর জন্য বিরল।
গত দুই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতার মিলিয়ে ৭টির বেশি ম্যাচ হারেননি গার্দিওলা। সেই একই ব্যক্তি যখন সর্বশেষ ১০ ম্যাচের ৭টিতেই হারবেন, তখন নখ দিয়ে নিজের নাক খামচে দেওয়াকে খুব বড় ঘটনা মনে না–ও হতে পারে। যদিও যে ম্যাচে এই কাণ্ড করেছিলেন, সেই ম্যাচটিতে গার্দিওলা হারেননি। চ্যাম্পিয়নস লিগে ফেইনুর্দের বিপক্ষে ৩-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর শেষ পর্যন্ত ৩-৩ গোলে ড্র করেছিল তাঁর দল।
একটা মানুষ জয়ের জন্য কতটা মরিয়া হলে এমন কিছু করতে পারেন! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কিংবদন্তি আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাই লাইফ ইন রেড অ্যান্ড হোয়াইট’–এর কিছু কথা।
ওয়েঙ্গার লিখেছিলেন, ‘আমি প্রায়ই ভাবি, মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা কী হবে, তা নিয়ে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, জীবনে কী করেছিলে, আমি কীভাবে জীবনকে অর্থবহ করেছি? বলব, আমি চেষ্টা করেছি ম্যাচ জেতার। এটুকুই?—তিনি জিজ্ঞেস করবেন। হতাশও হবেন। তখন তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করব, আপনি যেমনটা ভাবছেন, ম্যাচ জেতা তার চেয়ে অনেক কঠিন।’
কে জানে ওয়েঙ্গারের আত্মজীবনী গার্দিওলা পড়েছেন কি না? যদি পড়েন, এই অংশ পড়তে গিয়ে হয়তো মনে মনে হেসেছেন। আরে যে ম্যাচ জয় নিয়ে ওয়েঙ্গার এত মাথাকুটে মরছেন, তা তো আমার বাঁ হাতের খেল! কিন্তু পাশার দান যে কীভাবে বদলে যেতে পারে, তা এবার হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছেন গার্দিওলা।
মাথাখুটে মরেও মিলছে না জয়ের দেখা। শেষ ১০ ম্যাচে ১ জয়, এমন দিন কি গার্দিওলা কখনো দুঃস্বপ্নেও দেখেছিলেন! কিন্তু এটাই মানবজীবনের বাস্তবতা। কেউ অজেয় নয়, কেউই শেষ পর্যন্ত ‘ইনভিন্সিবল’ থাকতে পারেন না। গার্দিওলার জন্যও শেষ পর্যন্ত কথাটা সত্যি হলো।
এই কঠিন সত্য ধারণ করেই আজ রাতে ইতিহাদ স্টেডিয়ামে ম্যানচেস্টার ডার্বির কঠিন এক লড়াইয়ে মাঠে নামবে গার্দিওলার সিটি। ভরসা একটাই, নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবস্থা আরও খারাপ। এত বাজে পারফরম্যান্সের পরও সিটির অবস্থান যেখানে প্রিমিয়ার লিগ পয়েন্ট তালিকার ৪ নম্বরে, সেখানে ইউনাইটেড আছে ১৩ নম্বরে। হেরেছে সর্বশেষ দুই ম্যাচেই। বোঝাই যাচ্ছে, আজকের ম্যাচে দুই ম্যানচেস্টারের কারা বেশি খারাপ, সে লড়াইটাই যেন হতে যাচ্ছে। আর শহরের দুই ক্লাবের এমন হতশ্রী অবস্থা দেখে ম্যানচেস্টারের আকাশও নিশ্চয় খানিকটা বিষণ্ন।
তবে গার্দিওলার জন্য আসল ভয়টা মাঠের চেয়ে ডাগআউটেই বেশি। সেই ভয়ের নাম রুবেন আমোরিম। ইউনাইটেডের নতুন এই কোচের বিপক্ষে সর্বশেষ দেখায় সিটি হেরেছিল ৪–১ গোলে। তখন আমোরিম ছিলেন স্পোর্তিং লিসবনের দায়িত্বে। ফলই বলে দিচ্ছে সেই ম্যাচে গার্দিওলার সিটিকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছিল আমোরিমের লিসবন। এরপরই লিসবন ছেড়ে ওল্ড ট্রাফোর্ডে চলে আসেন আমোরিম।
তবে ইউনাইটেডে আমোরিম যে খুব ভালো আছেন, তা নয়। সর্বশেষ দুই ম্যাচেই হেরেছেন। এখনো দলকে ঠিকঠাক গোছাতে পারেননি। নিজেই একাধিকবার বলেছেন, দলকে ছন্দে ফেরাতে সময় লাগবে। আর সিটি ম্যাচের আগে তো বলেই দিলেন, ‘ভালো দলগুলো যেকোনো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তারা (সিটি) দল হিসেবে আমাদের চেয়ে ভালো। সাম্প্রতিক সময়ে ধুঁকতে থাকার পরও আমাদের চেয়ে তাদেরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি।’
আমোরিমের কথা শুনে মনে হতে পারে যেন ম্যাচ শুরুর আগেই আত্মসমর্পণ করে ফেলেছেন। কিন্তু এটাকে কেউ চাইলে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই হিসেবেও দেখতে পারেন। সিটিকে ফেবারিট তকমা দিয়ে নিজেদের ওপর থেকে চাপ কমানোর কৌশলও হতে পারে আমোরিমের। ফলে আমোরিমের এই কোর্টে বল ঠেলে দেওয়ার রাজনীতিকে হয়তো সেভাবেই মোকাবিলা করতে চাইবেন গার্দিওলা। যদিও লড়াইয়ের জন্য গার্দিওলার অস্ত্রাগারে খুব সামান্যই গোলাবারুদ অবশিষ্ট আছে।
সিটির এই মৌসুমে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ দলের সেরা তারকাদের চোট। চোটজর্জর দলটির অবস্থা এতটাই খারাপ যে তিনজনের বেশি ডিফেন্ডার নামানোর সুযোগও নেই। ফলে সীমিত শক্তি নিয়েই গার্দিওলাকে আজ ইউনাইটেডকে হারানোর অভিযানে নামতে হবে।
আর এই ম্যাচে সিটির সবচেয়ে বড় শক্তি প্রতিপক্ষের ছন্দহীনতা। অর্থাৎ ইউনাইটেড যদি নিজেদের খারাপ পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে, তাহলে তা গার্দিওলার দলকে এই ম্যাচে বাজিমাত করার সুযোগ করে দেবে। তবে বড় ম্যাচে ইউনাইটেড যদি বড় কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আবির্ভূত হয়, তাহলে গার্দিওলার জন্য ম্যাচ বের করে আনা কষ্টসাধ্য হতে পারে।
বলা হয়, কোচের চাকরি পৃথিবীর সবচেয়ে অনিশ্চিত চাকরিগুলোর একটি। দলকে জেতানোর পর এক রোববারে যে মানুষটিকে বলা হয় তুমি অমর। পরের রোববারেই দল হারলে বলা হয়, তোর মরণ হয় না কেন! এমনই প্রশংসা ও নিন্দার দোলাচলে সারাক্ষণ সরলদোলকের মতো দুলতে থাকে কোচদের ভাগ্য। অথচ এমন একটা কাজের জন্য তাঁদের মাটিতে মিশিয়ে ফেলা হয়, যেখানে তাদের সরাসরি কিছু করারও থাকে না। গার্দিওলার জন্য অবশ্য সিটিতে এখনো এমন পরিস্থিতি আসেনি।
টানা হারের পরও শিগগিরই যে আসবে, তা–ও মনে হচ্ছে না। আর আমোরিম তো মাত্রই দায়িত্ব নিলেন। তবে আধুনিক ফুটবলের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে ভক্ত–সমর্থকেরা কতক্ষণ ধৈর্য দেখাতে পারবেন, সেই আশঙ্কা তো থাকেই। এরই মধ্যে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ছাঁটাইয়ের দুয়ো শুনে ফেলেছেন গার্দিওলা। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে দুয়োটা ইতিহাদ স্টেডিয়ামের গ্যালারির নীল অংশ থেকেও আসা শুরু হতে পারে।
কোচের চাকরি পৃথিবীর সবচেয়ে অনিশ্চিত চাকরিগুলোর একটি। দলকে জেতানোর পর এক রোববারে যে মানুষটিকে বলা হয় তুমি অমর। পরের রোববারেই দল হারলে বলা হয়, তোর মরণ হয় না কেন!
এমন কিছু হওয়ার আগে গার্দিওলা নিশ্চয় চাইবেন সব বদলে দিতে। যার শুরুটা হতে পারে আজকের ডার্বি ম্যাচ দিয়ে। আমোরিমের জন্যও লড়াইটা নিজেকে বড় ম্যাচে প্রমাণ করার। এটা বোঝানোর যে ডাগআউটের লাল অংশে দাঁড়িয়ে নীলের ওপর রাজত্ব করতে চান তিনি। ফলে আমোরিমের জন্যও ম্যাচটা অস্তিত্ব প্রমাণের। দুই কোচের এই অস্তিত্ব রক্ষা ও প্রমাণের লড়াটাই ম্যাচটাকে করে তুলতে পারে রোমাঞ্চকর। জন্ম দিতে পারে ধ্রুপদি এক আখ্যানের।