স্ক্রলিংয়ের যুগে সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। মুহূর্তের মধ্যে আপনার চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে বিষয়বস্তু। একটু আগে কী দেখেছিলেন কিংবা পড়েছিলেন, আপনার নিজেরও হয়তো তা মনে থাকে না। ক্ষণস্থায়ী এ সময়ে ফুটবল কোচের দায়িত্বের স্থায়িত্ব যেন আরও কম। এ যেন এলাম আর গেলাম। ডাগআউটে স্থির হয়ে বসার সময়টুকুও অনেক সময় মিলছে না।
পরিকল্পনা সাজানো, দল গোছানো, ফল পাওয়ার পথে যাত্রা তো আরও দূরের বাতিঘর। নিয়মিত বিরতিতেই ছাঁটাইয়ের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। ইউরোপিয়ান ফুটবলে ছাঁটাই হওয়া কোচের তালিকায় নতুন দুই সংযোজন—অ্যাস্টন ভিলার কোচ স্টিভেন জেরার্ড ও শালকে কোচ ফ্রাঙ্ক ক্রামের।
কোচ ছাঁটাইয়ের সংস্কৃতি অবশ্য খুব নতুন কিছু নয়। ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গেই রয়েছে এর যোগ। বলা হয়ে থাকে, কোচদের ব্যাগ সব সময় গোছানোই থাকে। বেশ বিব্রতকর এক চাকরিই বটে!
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’ বইয়ে উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়া লেখক এদোয়ার্দো গালেয়ানো লিখেছিলেন, ‘কোনো কিছুই লম্বা সময় টিকে থাকে না। ভোগবাদী এ সমাজে আর বাকি সব পণ্যের মতো কোচকেও ছুড়ে ফেলতে সময় লাগে না। যে দর্শকেরা আজ হুল্লোড় করে বলছে, “তুমি অমর হও!” পরের রোববার সেই সমর্থকেরাই বলছে, “মরিস না কেন হতভাগা!”’
কোচ বিদায়ের সেই ধারা বর্তমান সময়ে এসে আরও পোক্ত হয়েছে। ৩০ অগস্টের পর থেকে ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগে ২১ কোচ এখন পর্যন্ত বিদায় নিয়েছেন। বলে রাখা ভালো, সব বিদায় অবশ্য ছাঁটাই নয়। তবে এই ২১ জনের মধ্যে কেবল গ্রাহাম পটার নিজ থেকে ক্লাব বদলানোর সুযোগ পেয়েছেন। বাকিদের সবার ভাগ্যে জুটেছে ‘মার্চিং অর্ডার’।
সাম্প্রতিক সময়ে সাফল্য পাওয়ার অতি আকাঙ্ক্ষাতেই কোচদের এমন পরিণতি। ‘ধর তক্তা, মার পেরেক’ নীতিই এখন ক্লাবগুলোকে দ্রুত কোচ পরিবর্তনের পথে পরিচালিত করছে। এতে কোচদেরও এখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বদলে বেছে নিতে হচ্ছে নতুন পথ।
একটা সময় ছিল, যখন কিছু কোচ একটি ক্লাবে লম্বা সময় ধরে কাজ করে ক্লাবের সংস্কৃতি বদলানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। যেমন স্যার আলেক্স ফার্গুসন কিংবা আর্সেন ওয়েঙ্গারের কথা তো সবার জানাই। ফার্গুসন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে প্রায় ২৭ বছর এবং ওয়েঙ্গার আর্সেনাল কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ২২ বছরের বেশি।
এ ছাড়া ওয়েস্ট ব্রমউইচের সাবেক কোচ ফ্রেড ইভেরিসের কথাও চাইলে বলা যায়, যিনি সব মিলিয়ে ৪৫ বছর ৯ মাস ৩০ দিন একটি ক্লাবের কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমান সময়ে এসে এসব অবশ্য রূপকথার গল্প বলেই মনে হতে পারে। খুব কম ক্লাবই আছে, যেখানে লম্বা সময় ধরে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন কোচরা।
এমনকি সাফল্য পেয়েও জায়গা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন তাঁরা। নয়তো খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এনে দেওয়া টুখেলকে কেন এভাবে ছুড়ে ফেলতে যাবে চেলসি!
এখন যেমন সাফল্যের কারণে পেপ গার্দিওলা কিংবা ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো কোচদের মাথায় তুলে রাখা হয়েছে। প্রতি মৌসুমে তারা কিছু না কিছু জিতছেন বা দলকে সাফল্যের পথে রেখেছেন। কে জানে, এক মৌসুমের ব্যর্থতাতেই হয়তো জায়গা হারাতে হতে পারে তাঁদেরও। যেকোনো মূল্যে সাফল্য পেতে হবে, এমন অবস্থান কোচদের ভবিষ্যৎকে রীতিমতো বিপন্ন করে তুলেছে।
ক্লাবে নিজেদের অবস্থান সুনিশ্চিত না হওয়ায় অনেক কোচকে নিজেদের কৌশলও বদলাতে হচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন কোচরা তরুণ খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করে তাঁদের তৈরি করায় মনোযোগ দিতেন। তবে গত কয়েক মৌসুমের দলবদলে এ ধারায় বেশ পরিবর্তন দেখা গেছে। যেমন কোচরা এখন তরুণদের সঙ্গে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দেরও সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
যেমন এবারের দলবদলে ৩১ বছর বয়সী কলিদু কুলিবালিকে ৪ বছরের চুক্তিতে ৩ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড খরচ করে কিনেছে চেলসি। দুই বছরের চুক্তিতে ৩৩ বছর বয়সী ইভান পেরিসিচকে কিনেছে টটেনহাম হটস্পার্স। ৩০ বছর বয়সী কাসেরিমোকে ৭ কোটি ইউরো খরচ করে কিনেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
তাৎক্ষণিক সাফল্য পাওয়ার ক্ষুধাকেই এর কারণ হিসেবে দেখছেন ফুটবল বিশ্লেষকেরা। অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা দ্রুত পার্থক্য গড়ে দেবেন, এ ভরসাতেই তাঁদের দলে টানছেন কোচরা।
এখন খেলোয়াড়দের গড়ে তুলে তাদের কাছ থেকে সাফল্য পাওয়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, সেটিই পাচ্ছেন না কোচরা। একটি ম্যাচের ব্যর্থতাতেই বদলে যাচ্ছে ভাগ্য, যা তাঁদের বাধ্য করছে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের দিয়ে স্কোয়াড সাজাতে।
এ নিয়ে কদিন আগে বিশ্বব্যাপী ক্লাবগুলোকে পরামর্শ ও বিশ্লেষণী সহায়তা প্রদান করা প্রতিষ্ঠান এমআরকেটির সহপ্রতিষ্ঠাতা টিম কিচ বলেছেন, ‘তারা হয়তো ভাবছে, কিছু খেলোয়াড় এনে এখনই জিততে হবে।’ সাফল্য পাওয়ার মরিয়া মনোভাবই মূলত কোচদের বাধ্য করছে এ পথে হাঁটতে।
মৌসুম শুরু হওয়ার পর তিন মাস না পেরোতেই ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতে ২০ কোচ ছাঁটাই হয়েছেন। চলতি মৌসুমে ৩০ আগস্ট প্রথম ছাঁটাই হন বোর্নমাউথের কোচ স্কট পার্কার। এরপর প্রিমিয়ার লিগে আলোচনার ঝড় তুলেছিল চেলসি থেকে টুখেলের বিদায়। যে তালিকায় সর্বশেষ নাম জেরার্ড।
সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত চাকরি হারিয়েছেন ৫ কোচ। গতবার পুরো মৌসুমজুড়ে সংখ্যাটি ছিল ১০। লা লিগায় গত মৌসুমে ১১ কোচকে ছাঁটাই করা হয়েছিল, যেখানে আছেন বার্সেলোনার কোচ রোনাল্ড কোমানও। এবার অবশ্য এখন পর্যন্ত দুজন কোচ ছাঁটাই হয়েছেন স্প্যানিশ লিগে। এলচের কোচ ফ্রান্সিসকো এবং সেভিয়ার কোচ হুলেন লোপেতেগিকে ব্যর্থতার দায়ে ক্লাব ছাড়তে হয়েছে।
সিরি আ’তে গত মৌসুমে ১০ কোচ ছাঁটাই হয়েছিলেন। চলতি মৌসুমে ইতিমধ্যে ৪ জন কোচ চাকরি হারিয়েছেন। বুন্দেসলিগায় এখন পর্যন্ত চাকরি হারিয়েছেন ৫ জন। আর লিগ ওয়ানে কোচ ছাঁটাই করেছে ৫ ক্লাব, যার সব কটিই আবার এ মাসে।
মৌসুমের অবশ্য এখনো অর্ধেক পেরোয়নি। সামনে পড়ে আছে লম্বা পথ। এর মধ্যে আরও কত কোচকে যে নতুন চাকরির সন্ধানে নামতে হয়, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা!