সেই রুডিগারেই আনচেলত্তির ‘দায়মোচন’
টাইব্রেকারের শেষ শটে গোলটা করেই ভোঁ দৌড় লাগিয়েছেন আন্তনিও রুডিগার। সাইডলাইনের দিকে গিয়ে স্লাইড করার পর সতীর্থদের সঙ্গে আনন্দে মেতেছেন।
জয়সূচক গোল করার পর যে কেউ উদ্যাপনের মধ্যমণি হয়ে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক। রুডিগারের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। ইতিহাদ স্টেডিয়ামে রোমাঞ্চকর পেনাল্টি শুটআউটে রিয়াল মাদ্রিদ ডিফেন্ডারের ওই গোলই তো চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে ছিটকে দিয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটিকে।
রুডিগার মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে যেমন সিটিকে ভড়কে দিয়েছেন, চমক দেখিয়েছেন উদ্যাপনেও। রিয়ালের সবাই যখন নিজেদের মধ্যে উদ্যাপন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন; রুডিগার তখন সেই জটলা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গিয়েছেন টাইব্রেকারের বিপরীত প্রান্তের গোলপোস্টের পেছনের গ্যালারির দিকে। এরপর বিজ্ঞাপন বোর্ডের ওপর দিয়ে লাফিয়ে মিশে গেছেন শুভ্রতায়।
বুঝতেই পারছেন, রুডিগারের কাছে রিয়াল সমর্থকেরাই সব। মাদ্রিদ থেকে ম্যানচেস্টারে উড়ে যাওয়া হাজার তিনেক সমর্থকেরাই কাল ছিলেন রিয়ালের অনুপ্রেরণার উৎস, উজ্জীবনী শক্তি। দলকে সেমিফাইনালে তোলার পর তাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়তো আরেকটি বড় দায়িত্ব মনে হয়েছে রুডিগারের কাছে। মাঠে সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার পর ভক্ত-সমর্থকদের এভাবে ‘সারপ্রাইজ’ দিতে পারেন বলেই তো তিনি ‘বিশেষ একজন’।
তবে রুডিগার আসল বিশেষত্ব দেখিয়েছেন মাঠেই। শুধু টাইব্রেকারে রিয়ালকে সেমিফাইনালের টিকিট পাইয়ে দেওয়া গোলটা করেই নয়, ম্যাচের আগে যিনি প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগের ঘুম হারাম করে দেন; সেই আর্লিং হলান্ডকে ‘বোতলবন্দী’ করে রেখেও। আগের সপ্তাহে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খেলেছেন ৯০ মিনিট, কাল ইতিহাদে টাইব্রেকারের আগে নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ১২০ মিনিট। দুই লেগের যোগ করা সময় বিবেচনায় নিলে আরও অন্তত ১০ মিনিট। সিটির বিপক্ষে সব মিলিয়ে ২২০ মিনিট একই ‘স্ট্যামিনা’ নিয়ে খেলে গেছেন ৩১ বছর বয়সী এই জার্মান সেন্টার-ব্যাক।
কাল ম্যাচের আগে রুডিগার বলেছিলেন, হলান্ডকে আটকে রাখার ব্যাপারটা তাঁর কাছে ব্যক্তি পর্যায়ের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুডিগার থাকলে রিয়ালের ডি বক্স যেন হলান্ডের কাছে হয়ে ওঠে কারাগার! তিনি মাঠে থাকলে হলান্ডের গোলবন্ধ্যাত্ব কাটবে না—বিষয়টি আঁচ করতে পেরে হয়তো নরওয়েজীয় স্ট্রাইকারকে কাল ৯০ মিনিট পরেই তুলে নিয়েছেন পেপ গার্দিওলা। তাঁর বদলি নামিয়েছেন হুলিয়ান আলভারেজকে। তবে লাভ হয়নি। হলান্ডকে নিজের বশে নিয়ে আসা রুডিগার আলভারেজকেও স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে দেননি। সিটির লেফট উইঙ্গার জ্যাক গ্রিলিশ কাল দারুণ খেলেছেন। কিন্তু গ্রিলিশের আক্রমণগুলো সাফল্যের মুখ দেখেনি রুডিগার দেয়াল তুলে দাঁড়ানোর কারণেই।
কাল ৫৬ বার বলে স্পর্শ করেছেন রুডিগার। সিটির খেলোয়াড়দের আক্রমণ রুখে দিয়েছেন ৯ বার, শট ঠেকিয়েছেন ৫ বার, পা ও মাথা মিলিয়ে বল বিপদমুক্ত করেছেন ৬ বার, বল পুনরুদ্ধার করেছেন ২ বার। অথচ একবারও ফাউল করেননি!
ম্যাচের ১২ মিনিটেই রদ্রিগোর গোলে এগিয়ে যায় রিয়াল। ইতিহাদে সিটিকে শুরুতেই গোল দেওয়া এরপর মৌচাকে ঢিল ছোড়ার মতোই সমার্থক হয়ে উঠেছিল। গার্দিওলার শিষ্যরা অনুমিতভাবেই রিয়ালকে মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরেছেন। ফিল ফোডেন–জ্যাক গ্রিলিশদের একের পর এক আক্রমণে তটস্থ হয়ে উঠলেও কার্লো আনচেলত্তির দল ৭৫ মিনিট পর্যন্ত ১-০ ব্যবধান ধরে রেখেছিল রুডিগার বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়ার কারণেই। কেভিন ডি ব্রুইনার সমতা ফেরানো গোলের মুহূর্তটা বাদে বাকি সময় রুডিগারে উজ্জীবিত রিয়াল দারুণভাবে রক্ষণভাগ সামলেছে।
রিয়ালের এই রক্ষণভাগও আসলে পূর্ণশক্তির নয়। হাঁটুর চোটে এদের মিলিতাওকে ৮ মাস মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে (কাল বদলি নেমে খেলেছেন মাত্র ১০ মিনিট), লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া ডেভিড আলাবার তো মৌসুমই শেষ হয়ে গিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে কাল অরিলিয়েঁ চুয়ামেনিও খেলতে পারেননি। তবে রুডিগার মাত্র কয়েক দিনেই রক্ষণভাগের সঙ্গীদের অভাব পূরণ করে হয়ে উঠেছেন দলের অপরিহার্য অংশ।
শুধু কি তা-ই? কাল টাইব্রেকারে সিটির দুটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ত্রাতা বনে যাওয়া আন্দ্রি লুনিনের একটিতে অবদান আছে রুডিগারেও। কীভাবে? ২০২২ সালে রিয়ালে যোগ দেওয়ার আগে পাঁচ মৌসুম চেলসিতে খেলেছেন রুডিগার। চেলসিতে তিনি তিন মৌসুম সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন মাতেও কোভাচিচকে। দুজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চেলসির রক্ষণভাগ সামলেছেন। ২০২১ সালে লন্ডনের ক্লাবটির হয়ে একসঙ্গে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগও। দুজনের ঠিকানা বদলে গেলেও কোভাচিচের শক্তিমত্তা-দুর্বলতার জায়গাগুলো হয়তো ভালোভাবেই চিহ্নিত করে রেখেছেন।
সেই কোভাচিচ কাল টাইব্রেকারে সিটির তৃতীয় শটটা নিতে যেতেই রিয়াল গোলকিপার লুনিনকে তাঁর ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইশারা দেন রুডিগার। কোভাচিচ শট নেন লুনিনের ডান দিকেই। রুডিগারের পরামর্শে তিনি সেদিকেই লাফিয়ে কোভাচিচের শট রুখে দেন।
অথচ এই রুডিগারকেই গত বছর চিনতে পারেননি কার্লো আনচেলত্তি। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনালেই দেখা হওয়া রিয়াল-সিটি গত বছর মুখোমুখি হয়েছিল সেমিফাইনালে। সেবারও প্রথম লেগ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আর ফিরতি লেগ ইতিহাদে হয়েছিল। প্রথম লেগে মাদ্রিদ থেকে ১-১ সমতা নিয়ে ফেরা সিটি ঘরের মাঠে ফিরতি লেগে ৪-০ গোলে রিয়ালকে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে ওঠে। পরে দলটি প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপাও জিতে নেয়।
ফিরতি লেগের সেই ম্যাচটিতে রুডিগারকে বসিয়ে রেখেছিলেন আনচেলত্তি। জার্মান ডিফেন্ডারকে রিয়াল কোচ দ্বিতীয়ার্ধে নামালেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। মানে, সেই অবস্থা থেকে রিয়ালকে ম্যাচে ফেরানো যে কারও জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। ইংল্যান্ডে পাঁচ মৌসুম কাটানোর পরও, ইংলিশ ফুটবলের নাড়ি-নক্ষত্র সব জানার পরও ইতিহাদে রুডিগারকে দেরিতে নামানোয় বেশ সমালোচিতও হয়েছিলেন আনচেলত্তি।
তবে আনচেলত্তি কাল আর ভুল করেননি। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এক বছর আগের দোষ স্বীকার করে ‘ডন কার্লো’ নিশ্চিত করেছিলেন, ইতিহাদে এবার শুরু থেকেই রুডিগারকে খেলাবেন। কাল রুডিগারকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খেলিয়ে আনচেলত্তি করেছেন গত মৌসুমের ‘দায়মোচন’। আস্থার প্রতিদান দিয়ে রুডিগারও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বারবার রিয়ালের ঘুরে দাঁড়ানোর ডিএনএ তিনি নিজের শরীরেও ঢুকিয়ে নিয়েছেন।
ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখা কথাগুলোই যার প্রমাণ, ‘এটাই রিয়াল মাদ্রিদ!!! আমরা সব সময় লড়াই করি, আমরা সব সময় বিশ্বাস করি, আমরা কখনোই হাল ছাড়ি না!’
রিয়ালকে ধারণ করা রুডিগারের সামনে এবার হ্যারি কেইনকে আটকে রাখার চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জও জিতে নিতে পারলে রিয়ালও নিশ্চয়ই রুডিগারকে ধারণ করতে শুরু করবে!