রিয়াল–ম্যান সিটি ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে যেসব জায়গায়

চ্যাম্পিয়নস লিগে আজ মুখোমুখি ম্যানচেস্টার সিটি ও রিয়াল মাদ্রিদরয়টার্স

‘আমি রিয়াল মাদ্রিদকে বুঝতে পারি না। আমার ধারণা, তারা মৌসুমজুড়ে অনুশীলন করে, আর শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়েই চিন্তা করে’—কয়েক দিন আগে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের দাপট নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি কিংবদন্তি সের্হিও আগুয়েরো। তাঁর এ কথায় রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়ার সঙ্গে লুকিয়ে আছে অন্তহীন এক আক্ষেপও।

আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়নস লিগে একটি শিরোপা জিততে দলগুলো বছরের পর বছর ধরে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে, রিয়ালের জন্য সেটা যেন ‘ভিনি, ভিডি, ভিসি’—অর্থাৎ এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম। আর রিয়ালের এই চিরকালীন উচ্ছ্বাসের মাঝেই চাপা পড়ে আছে ম্যান সিটি-পিএসজির মতো দলগুলোর যাবতীয় আর্তনাদ। এ যেন যুদ্ধে হার নিশ্চিত জেনেও বারবার লড়াইয়ে নামা! পানির মতো টাকা ঢেলে, কাগজে-কলমে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়েও একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিততে পারেনি সিটি-পিএসজি।

২০১৬ সালে ম্যান সিটির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ক্লাবটিকে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব এনে দেওয়ার জন্য লড়ে যাচ্ছেন গার্দিওলা। ইউরোপিয়ান মসনদকে পাখির চোখ করে একের পর এক লিগ শিরোপা ঘরে তুলে যাচ্ছেন এই স্প্যানিশ কোচ। যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগকে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভাবা হতো, সেটিকেই একপেশে বানিয়ে ছেড়েছেন গার্দিওলা। কিন্তু সিটির হয়ে ইউরোপসেরার মুকুট গার্দিওলার জন্য দীর্ঘশ্বাস হয়েই থেকে গেল। কদিন আগেও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সিটিতে তাঁর সাফল্যকে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা দিয়েই বিবেচনা করা হবে!

আরও পড়ুন

অবশ্য এখনো হয়নি মানে কখনো যে হবে না তা তো না। কে জানে, হতে পারে এবারই। ইতিহাদে চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা রিয়ালকে আজ হারাতে পারলেই স্বপ্নের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে পৌঁছে যাবে সিটি। এরপর তো এক ম্যাচের ব্যাপার। এর আগে ২০২১ সালেও চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলেছিল সিটি। সেবার গার্দিওলার ট্যাকটিক্যাল ভুলের কারণে চেলসির কাছে হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল সিটিকে।

এবার রিয়ালের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগের লড়াইয়েও গার্দিওলার ট্যাকটিকসের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। সামান্য একটি ভুল আবার দুঃস্বপ্নের দীর্ঘ রাত উপহার দিতে পারে সিটিকে। আর শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার পথে রিয়ালও তাকিয়ে থাকবে কোচ কার্লো আনচেলত্তির লুকানো তাসে। তবে কৌশলগত মাস্টার মাইন্ডের পাশাপাশি আরও কিছু ছোট-বড় বিষয় আছে, যা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে।

কৌশলের লড়াইয়ে নামবেন দুই দলের কোচ কার্লো আনচেলত্তি ও পেপ গার্দিওলা
এএফপি

দুই কোচের কৌশলগত যুদ্ধ:

‘চিন্তা করবেন না, খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব না’—ফিরতি লেগের আগে কথাগুলো বলেছেন গার্দিওলা। বড় ম্যাচে কৌশলগতভাবে বড় ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত সাবেক এই বার্সা কোচ। তাঁর ট্যাকটিক্যাল জুয়ার সুফল ও কুফল দুটিই পেয়েছে সিটি। গার্দিওলার ট্যাকটিক্যাল ভুলে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে হারের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে এর সুফলও আছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে ম্যানুয়ালি আকাঞ্জিকে লেফটব্যাক হিসেবে খেলিয়ে এবং হলান্ড-ডি ব্রুইনার জায়গা অদলবদল করে ঠিকই সাফল্য পেয়েছেন গার্দিওলা।

তবে রিয়ালের বিপক্ষে প্রথম লেগে খুব একটা ঝুঁকি নিতে দেখা যায়নি গার্দিওলাকে। এরপরও পুরো ম্যাচে বদলি হিসেবে কাউকে না নামানোয় ঠিকই সমালোচনা কুড়াতে হয়েছে এই কোচকে। আজও ট্যাকটিক্যাল লড়াইয়ে গার্দিওলার পাশার দান কেমন হয়, তার ওপর নির্ভর করছে সিটির ফলের অনেকটাই।

আরও পড়ুন

আনচেলত্তিকে অবশ্য কৌশল দিয়ে কদাচিৎই বিপ্লব করতে দেখা যায়। প্রথম লেগেও খেলোয়াড়দের দিয়ে মৌলিক কাজগুলো করানোর দিকে নজর ছিল তাঁর। সে ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও হয়তো শুরুর কিছু সময় প্রতিপক্ষের আক্রমণের চাপ হজম করে পুরো মাঠের চিত্র বুঝে নিতে চাইবেন এই ইতালিয়ান কোচ। আর ম্যাচ যতই সামনে গড়াবে, ততই একে একে নিজের লুকানো তাসগুলো বের করতে শুরু করবেন আনচেলত্তি। তাই কৌশলে দুই কোচের লড়াইটা হবে হাড্ডাহাড্ডি। যে কারণে পুরো ম্যাচটা তখন নির্ভর করবে কোচদের কৌশল খেলোয়াড়েরা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন তার ওপর।

ভিনিসিয়ুসের জাদুর অপেক্ষা:

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রথমার্ধে রিয়াল সিটির পোস্টে একটা শটই নিয়েছিল, আর সেই এক শটেই গোল করেছিল তারা। স্রোতের বিপরীতে রিয়ালের সেই গোলের নায়ক ছিলেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। তাঁর এক শটই পুরো ম্যাচের গতি বদলে দিয়েছিল। চলতি মৌসুমের নিজের সেরা ছন্দে ছিলেন ভিনি। ম্যাচের পর ম্যাচে রিয়ালের হয়ে গোল ও অ্যাসিস্ট করেছেন এই ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার। চ্যাম্পিয়নস লিগে ১১ ম্যাচে ৭ গোলের পাশাপাশি করেছেন ৫টি অ্যাসিস্টও। সব মিলিয়ে ৫২ ম্যাচে ২৩ গোল ও ২১ অ্যাসিস্ট। এ ছাড়া ড্রিবলিংয়ের জাদুতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এ তরুণ তুর্কি। সিটির বিপক্ষে ম্যাচেও ভিনির জাদুকরি কোনো মুহূর্তে বদলে যেতে পারে ম্যাচের চিত্র।

ভিনিসিয়ুস না হলান্ড, আজ শেষ হাসি হাসবেন কে?
রয়টার্স

হলান্ডের ফেরা না ফেরা:

চলতি মৌসুমে ‘গোলমেশিন’ শব্দটাকে নিজের সমার্থক করে নিয়েছেন আর্লিং হলান্ড। একের পর এক রেকর্ড ভেঙে হলান্ড সব মিলিয়ে ৪৮ ম্যাচে করেছেন ৫২ গোল। কিন্তু এত গোল করার পরও হলান্ডকে নিয়ে ঠিক অস্বস্তি থেকেই গেছে। রিয়ালের বিপক্ষে পুরো ম্যাচে রুদিগারের পকেটেই ছিলেন হলান্ড। ম্যাচে গোল দূরে থাক, খুব একটা বলও স্পর্শ করতে পারেননি এই স্ট্রাইকার। দুই–একবার বিপদ তৈরির চেষ্টা করলেও, রিয়ালের কড়া মার্কিংয়ে খুব একটা শ্বাস নেওয়ার জায়গা পাননি নরওয়েজীয় তারকা। অর্থাৎ আনচেলত্তির হলান্ডকে থামানোর পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল।

এই ম্যাচেও হলান্ডকে নড়াচড়ার জন্য খুব একটা জায়গা দেবে না রিয়াল। এমন পরিস্থিতিতে হলান্ডকে ‘আউট অব দ্য বক্স’ কিছু করে ফাঁদ কেটে বের হয়ে আসতে হবে, নয়তো ডিফেন্ডারদের মনোযোগ নিজের দিকে ধরে রেখে ডি-ব্রুইনা-গুন্দোয়ানদের জন্য ফাঁকা জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। বড় ম্যাচে এটুকু করতে পারলেও বদলে যেতে পারে ফলাফল।

আরও পড়ুন

গোলরক্ষকদের দ্বৈরথ:

এই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন দুই গোলরক্ষক রিয়ালের কোর্তোয়া ও সিটির এদেরসন। বড় ম্যাচে কোর্তোয়া বরাবরই ভয়ংকর। গত মৌসুমের ফাইনালের কথায় ধরা যাক। লিভারপুলের বিপক্ষে একের পর এক সেভ সেদিন শিরোপা ভাগ্য লিখে দিয়েছিল। প্রথম লেগেও দারুণ কিছু সেভ করেছেন কোর্তোয়া। একইভাবে এদেরসনও প্রথম লেগে একাধিকবার নিরাশ করেছিলেন রিয়ালকে। যেহেতু ফাইনালে যাওয়ার লড়াই আজ রাতে, তাই দুই গোলরক্ষকের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেতে পারে। সেই ঝড়ের বুকে যিনি বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারবেন, তিনিই পারবেন ম্যাচটা নিজের নামে লিখে নিতে।

লড়াইটা মনস্তাত্ত্বিকও:

ইতিহাদে চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ২৫ ম্যাচের ২৩টিতেই জয়ের পাশাপাশি ২টিতে ড্র করেছে সিটি। জয়ের হার ৯২ শতাংশ। এই ম্যাচগুলোতে সিটি গোল করেছে ৮১টি এবং হজম করেছে ১৮টি। এই পরিসংখ্যানে ঘরের মাঠে সিটি কতটা অপ্রতিরোধ্য সেটাকেই তুলে ধরছে। আজ রাতে সিটির মাঠে এই পরিসংখ্যান বদলানোর আশায় মাঠে নামবে রিয়াল। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়নক হয়ে উঠতে পারে ওপরের পরিসংখ্যান। একদিকে এই পরিসংখ্যানের কারণে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলে বিপদে পড়তে পারে সিটি। আর ঘরের মাঠে সিটির এই দাপটকে বাড়তি চাপ হিসেবে নিলে বিপদ বাড়তে পারে রিয়ালেরও।

সেই সঙ্গে ঘরের মাঠে সিটির সমর্থকেরাও রিয়ালের কাজটাকে কঠিন করে তুলতে পারেন। আর চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের অবিশ্বাস্য সাফল্য সিটিকে ফেলতে পারে একই ধরনের চাপে। তাই দিন শেষ নিজেদের স্নায়ুকে যারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা তাদের অনেকটাই বেড়ে যাবে।