খবরের কাগজ ফেরি করা ছেলেটিই এখন ছাড়িয়ে যেতে চান দ্রগবাকে
তাঁর গল্পটাও আরও অনেক আফ্রিকান কিংবা লাতিন আমেরিকান ফুটবলারের মতোই। জীবনযুদ্ধের গল্প। নাইজেরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল শহর লাগোসের রাস্তায় খবরের কাগজ, সস্তা খাবার ও পানি ফেরি করে বেড়ানো এক ছেলের গল্প। ফুটবলের সঙ্গে এক কিশোরের ভালোবাসার গল্প। ফুটবলকে ভালোবেসেই জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প। এ রকমই গল্প ছিল পেলের, ডিয়েগো ম্যারাডোনার, নেইমারের, দিদিয়ের দ্রগবার, স্যামুয়েল ইতোর। এ রকমই গল্প ভিক্টোর ওসিমেনেরও।
ইউরোপিয়ান ফুটবলের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের কাছে ওসিমেন এখন হয়তো কিছুটা চেনা নাম। কারও কারও কাছে হয়তো এখনো অচেনাই। কয়েক মৌসুম ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগে বেশ নিয়মিত হলেও নাপোলি তো আর ঠিক ইউরোপের পরাশক্তি ক্লাব নয় বা ওই অর্থে কখনো ছিলও না। সেই নাপোলির নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ওসিমেনকে তাই আলাদা করে চেনার কথাও নয় ইউরোপের বাইরের ফুটবলপ্রেমীদের।
তবে এই মৌসুমে ২৪ বছর বয়সী ওসিমেন নিজেকে আলাদা করেই চেনাচ্ছেন। আর চেনাচ্ছেন বলেই ইউরোপের ক্লাবগুলোর কাছে এরই মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছেন লোভনীয় এক ফরোয়ার্ড। তাঁর ওপর চোখে পড়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার সিটি ও চেলসির মতো বড় পরাশক্তি ক্লাবগুলোর।
স্বপ্নের মতো এক মৌসুম কাটছে ওসিমেনের। সিরি ‘আ’তে ২২ ম্যাচে ১৯ গোল, চ্যাম্পিয়নস লিগে ৪ ম্যাচে ২টি। দুই টুর্নামেন্ট মিলিয়ে করিয়েছেন আরও ৫টি গোল। এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত তিনিই সিরি ‘আ’র সর্বোচ্চ গোলদাতা। শুধু তা–ই নয়, ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগে এই মুহূর্তে ওসিমেনের চেয়ে বেশি গোল মাত্র দুজনের। একজন ম্যানচেস্টার সিটির আর্লিং হলান্ড, ২৬ ম্যাচে যার ২৮ গোল। অন্যজন টটেনহামের হ্যারি কেইন, ২৭ ম্যাচে করেছেন ২০ গোল।
চোটের কারণে মৌসুমের শুরুর দিকে মাস দুয়েক মাঠের বাইরে ছিলেন। হলান্ড-কেইনদের চেয়ে তাই বেশ কিছু ম্যাচ কম খেলেছেন ওসিমেন। গোলের সংখ্যাটা নইলে আরও বাড়ত, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। ম্যাচপ্রতি গোলের হার হলান্ডের মতো (১.০৮) অবিশ্বাস্য হয়তো নয় তাঁর। কিন্তু ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর মধ্যে ম্যাচপ্রতি গোলের হারে হলান্ডের পরই তিনি (০.৮৬)।
সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, হলান্ড এমন একটা দলে খেলেন, যেখানে তাঁর সতীর্থরা প্রতি ম্যাচেই গড়ে ৬-৮টা গোলের সুযোগ তৈরি করেন। ওসিমেনের সতীর্থদের নিয়ে একই কথা বলা যায় না। পাশাপাশি ওসিমেন এমন একটা লিগে খেলেন, যেখানকার দলগুলোর রক্ষণের সুনাম যুগ যুগ ধরে। সেই লিগে নাপোলির হয়ে মাঝে টানা ৮টি ম্যাচে ১০ গোল করার রেকর্ড গড়েছেন ওসিমেন।
এই যে এ মৌসুমে ২৬টি করে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর নাপোলি দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্টার মিলানের চেয়ে ১৮ পয়েন্ট এগিয়ে শীর্ষে, ৩৩ বছর পর যে এবার নাপোলি ইতালির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, সেটার পেছনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকা ভিক্টোর ওসিমেন ও তাঁর সতীর্থ খিচা কাভারাস্কেইয়ার। ওসিমেন গোল করছেন, কাভারাস্কেইয়া মূলত গোল করানোর দায়িত্ব নিলেও সমান তালে নিজেও গোল করে যাচ্ছেন। ১৫ গোল করানোর পাশাপাশি যিনি নিজেও করেছেন ১৩টি।
আক্রমণভাগে এ দুজনের জুটিটা এতই জমে উঠেছে যে শুধু সিরি ‘আ’ নয়, এবার নাপোলি চ্যাম্পিয়নস লিগেও দারুণ কিছু করার স্বপ্ন দেখতে পারছে। শেষ ষোলোর প্রথম লেগে ফ্রাঙ্কফুর্টকে ২-০ গোলে হারিয়ে এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালেও এক পা দিয়ে রেখেছে নাপোলি। ডিয়েগো ম্যারাডোনার সময়ের পর আর কখনো এত দারুণ মৌসুম কাটায়নি নাপোলি। সবকিছুর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাই হয়তো গোলমুখে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ওসিমেনের।
অথচ এই ওসিমেন বছর চারেক আগেও খেলতেন চারলেরই নামে অচেনা এক বেলজিয়ান ক্লাবে। নাইজেরিয়ার বয়সভিত্তিক দলে তাঁর খেলে দেখে জার্মানির ক্লাব ভলফসবুর্গ চুক্তি করেছিল তাঁর সঙ্গে। সেখান থেকেই ধারে পাঠানো হয় চারলেরই ক্লাবে। চারলেরই থেকে ফরাসি ক্লাব লিলে যান ২০১৯ সালে। ওই মৌসুমে লিলের হয়ে ২৫ ম্যাচে ১৩ গোল করে ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন।
পরের মৌসুমেই তাঁকে নাপোলির কাছে ক্লাব রেকর্ড ৭ কোটি ইউরোতে বিক্রি করে দিল লিল। ওশিমেনের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় সেখান থেকেই। নাপোলির হয়ে প্রথম মৌসুমে লিগে করেছেন ১০ গোল, পরের মৌসুমে ১৮। তবে ওই সময়টা আসলে নাপোলিও যাচ্ছিল পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে। কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তি দলটাকে গুছিয়ে ফেলার পর এই মৌসুমে ওশিমেন-কাভারাস্কেইয়াদের নিয়ে নাপোলি রীতিমতো অপ্রতিরোধ্যই হয়ে উঠেছে।
ইতালিয়ান লিগ হয়তো এবার নাপোলিই জিতবে, গোল্ডেন বুটের পুরস্কারও ওশিমেনই পাবেন হয়তো। এর মধ্যে জিতেছেন ইতালির বর্ষসেরা বিদেশি অ্যাথলেটের পুরস্কারও। তবে নাইজেরিয়ান এই স্ট্রাইকারের স্বপ্নটা আরও বড়। শুধু এক মৌসুমে লিগ জিতে আর সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েই থেমে যাওয়ার ইচ্ছা নেই তাঁর।
সেই ২০১৫ সালেই নাইজেরিয়ার হয়ে অনূর্ধ্ব–১৭ আফ্রিকান কাপে খেলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার আদর্শ দিদিয়ের দ্রগবা। আমি তাঁর মতো মানুষ ও খেলোয়াড় হতে চাই। তিনি শুধু আফ্রিকানদের নন, সারা বিশ্বের ফুটবলারদের আইকন, কিংবদন্তি। আমি তাঁর মতো খেলোয়াড় হতে চাই, কিংবা তাঁর চেয়েও ভালো।’
ওসিমেনের স্বপ্নের সীমানা কত দূর, বুঝতে পারছেন তো!