ধর্ষণের অভিযোগে ম্যানচেস্টার সিটি লেফটব্যাক বেঞ্জামিন মেন্দিকে গত বছর আগস্টে রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। সে বছর নভেম্বরে আরও দুটি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। গতকাল সোমবার চেশায়ারের আদালতে মেন্দির বিচার শুরু হয়।
আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানিতে বলা হয়, নিজের বাসায় পুল পার্টির পর এবং একটি নৈশ ক্লাব মিলিয়ে এক রাতে মোট তিন নারীকে ধর্ষণ করেছেন মেন্দি। আইনজীবীরা শুনানিতে তাঁকে ‘পশু’ পর্যন্ত বলেছেন।
ডিফেন্ডারদের দলবদলে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ২০১৭ সালে মোনাকো থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেন বেঞ্জামিন মেন্দি। ইংলিশ ক্লাবটির রক্ষণভাগ আগলে রাখলেও মেন্দি এবার নিজেকে বাঁচাতে পারবেন কি না, কে জানে!
২৮ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার চেশায়ারের প্রেস্টবেরি অঞ্চলের কাছাকাছি নিজের বাড়িতে ধর্ষণকাণ্ড ঘটান। আদালতের শুনানিতে বলা হয়, তিনি এবং তাঁর বন্ধু এসব নারীর সঙ্গে ‘যৌনক্রিয়াকে খেলায় পরিণত করেন’ এবং ‘নির্দয় আচরণ’ করেন।
আদালতের শুনানিতে অভিযোগনামায় আরও বলা হয়, নারীদের ওপর আক্রমণের সময় মেন্দি ‘পশু’র মতো আচরণ করেন। একবার ব্যবহারের পর ছুড়ে ফেলার মতো বস্তুই মনে করেছিলেন নারীদের। ধর্ষণের শিকার দুই নারী মনে করেন, মেন্দির পড়ার কক্ষ ও ঘুমোনোর কক্ষের দরজা বন্ধ থাকায় তাঁরা পালাতে পারেননি। দরজার তালা এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে যেন তা ‘প্যানিক রুম’-এ পরিণত হয়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানিয়েছে, চেস্টার ক্রাউন কোর্টের শুনানিতে বলা হয়, সিটি তারকা মেন্দি তাঁর খ্যাতি ও সম্পদ ব্যবহার করে নারীদের লোভ দেখিয়ে নিজের বাসায় এনে ধর্ষণ করেছেন। এ সময় নারীরা হয় ‘না’ বলেছেন কিংবা খুব বেশি পান করে ফেলায় সম্মতি দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতেও ছিলেন না
শুধু তা–ই নয়, ম্যানচেস্টারের নৈশ ক্লাবে অনেক নারীর সঙ্গে মেলামেশা ছিল মেন্দির। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেছেন ৪১ বছর বয়সী লুইস সাহা মাত্তুরিয়ে। একাধিক ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগে তাঁকেও মেন্দির সঙ্গে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। মেন্দি ও মাত্তুরিয়ের বিরুদ্ধে মোট ১৩ তরুণীর প্রতি ‘নির্দয় আচরণ’ ও আক্রমণের অভিযোগ তোলা হয়েছে। আদালতের শুনানিতে বলা হয়, তরুণীদের সঙ্গে এমন আচরণ তাঁদের কাছে শুধুই একটা ‘খেলা’ ছিল।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস জানিয়েছে, ফরাসি এই ডিফেন্ডারের বিরুদ্ধে আটবার ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। মেন্দি অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সহযোগী লুইস সাহা মাত্তুরিয়ে, যিনি সাহা নামে পরিচিত, তিনিও আটবার ধর্ষণের অভিযোগ এবং চারবার যৌন নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এসব ঘটনা আট তরুণীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
শুনানির প্রথম দিনে জুরিদের বলা হয়, নারীদের পটিয়ে ধর্ষণের পরিবেশ তৈরি করে দিতে মেন্দিকে সাহায্য করেছেন সাহা। তাঁর কাজ ছিল ‘তরুণীদের খুঁজে বের করা এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে সেসব তরুণী ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হবেন।’
আদালতে প্রশ্নোত্তর পর্বে আইনজীবী টিমোথি ক্রে বলেছেন, অভিযোগ তোলা ভুক্তভোগী নারীরা ‘ভীত ও একা’ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, বিশেষভাবে বানানো তালাবদ্ধ কামরায় আটক থাকায় তাঁরা ‘প্যানিক রুম’-এ আটকা পড়েছেন। এই তালা শুধু ভেতর থেকেই খোলা সম্ভব, বাইরে থেকে খোলার ব্যবস্থা নেই।
অভিযোগ তোলা অন্য নারীরা মেন্দির বাসায় পৌঁছানোর পর তাঁদের ফোন কেড়ে নেওয়া হতো। ক্রে শুনানিতে জানিয়েছেন, ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী এই ফুটবলার ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের আগস্টের মধ্যে সাত তরুণীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে করোনাভাইরাস মহামারিতে লকডাউন চলাকালে বাসার আয়োজন করা পার্টিতে।
টিমোথি ক্রে দিন-তারিখ উল্লেখ করে আদালতের শুনানিতে বলেছেন, গত বছরের ২৩ জুলাই রাতে এবং পরদিন সকালে মেন্দি ২২ বছর বয়সী এক তরুণী এবং ১৯ বছর বয়সী দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন। সাহাও ১৯ বছর বয়সী দুজনের মধ্যে একজনকে ধর্ষণ করেন এবং বাসার বাইরে ২২ বছর বয়সী আরেকজনকে ধর্ষণ করেন। আদালতের শুনানিতে ক্যামেরার মাধ্যমে মেন্দির বাসার ভেতরটাও দেখানো হয়। বাসার ভেতর ইনডোর পুল, সিনেমা দেখার কক্ষ ও জিমনেশিয়াম দেখানো হয়।
সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক নারীকে প্রলোভন দেখিয়ে মেন্দির শিকার হিসেবে তাঁর বাসার সিনেমা কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে মেন্দি সেই নারীকে নিজের চাহিদা পূরণে বারবার জোর করার পর তিনি রণে ভঙ্গ দেন। অন্য এক নারী সেই নারীর খোঁজ করতে মেন্দির বাসায় আসার পর সিটি তারকার দুজন সহযোগীর বাধা পান। সেদিন পুল পার্টি শেষ করে মেন্দি, সাহা এবং আরও কয়েকজন চায়নাহোয়াইট নৈশ ক্লাবে যান। সেখানেও দুজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ তোলা এক নারী জানিয়েছেন, তিনি সে সময় মাতাল ছিলেন এবং যত দূর মনে পড়ে, নিজেকে তিনি প্রথম অবস্থায় সুইমিং পুলে আবিষ্কার করেন। এরপর দ্বিতীয়বার আবিষ্কার করেন, তিনি সোফায় মুখ গুঁজে আছেন এবং হাত দুটো পেছনে আটকানো। সেই নারীর অভিযোগ, মেন্দি তখন তাঁকে ধর্ষণের সময় বলছিলেন, ‘নড়াচড়া কোরো না।’
একই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে সাহার বিরুদ্ধেও। দ্বিতীয় ১৯ বছর বয়সী তরুণী ঘুমোতে যান এবং ঘুম ভাঙার পর আবিষ্কার করেন, মেন্দি তাঁকে ধর্ষণ করছেন, বলা হয় শুনানিতে।
ক্রে আদালতকে জানিয়েছেন, মেন্দি ও সাহা ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়সী তরুণীদের লক্ষ্যবস্তু বানাতেন, ‘যাঁরা একদম মাতাল হয়ে পড়তেন, এত বেশি পান করতেন যে কোনো কিছু মনে রাখতে পারতেন না এবং ঘুমিয়ে পড়তেন।’
ক্রে বুঝিয়ে বলেন, ‘এই মামলার অবস্থান খুব সরল—ফুটবলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আমরা বলতে পারি, এটা সেই পুরোনো গল্পের আরেকটি অধ্যায়; পুরুষ নারীকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করে, কারণ তারা নিজেদের শক্তিশালী এবং পার পেয়ে যাবে বলে মনে করে।’ এখানে একজন নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি জানিয়ে ক্রে বলেন, ‘যৌনমিলনে একবার ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলার মতো’ আচরণ করা হয়েছে।
এক সন্তানের বাবা মেন্দি সাহার ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতেন। যেহেতু তিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের তারকাদের একজন, তাই ‘অনেকেই তাকে সাহায্য করতে চাইত’ বলে জানান ক্রে। এ মামলায় ‘না’ কথাটা উত্তর হিসেবে নেওয়া হবে না বলেও সরাসরি জানিয়ে দেন ক্রে।
আদালতে জুরিদের বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত এমন পাঁচটি তারিখ আছে, যেসব দিনে মোট নয়জন নারী মেন্দির বাসায় গিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে মেন্দি ও সাহার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন।
ক্রে সোজাসাপটাই বলেছেন, সবারই ‘যৌনমিলনে “না” বলার অধিকার আছে এবং কেউ পানশালায় গেলে, নৈশ ক্লাবের পোশাক পরলে কিংবা ফুটবলারের বাসায় গেলেই তা বলার অধিকার হারায় না।’ মেন্দি ও সাহা নারীদের সঙ্গে জোর করে যৌনমিলন করাকে ‘খেলা হিসেবে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা ঠান্ডা মাথায় এসব করেছেন,’ শুনানিতে দাবি করেন ক্রে।