‘দোজখ’ পেরিয়ে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপে যে ছেলেটি...
আয়াক্স থেকে গত আগস্টে ৮ কোটি ২০ লাখ পাউন্ডে আন্তনিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিয়ে আসার পর কেউ তেমন একটা অবাক হননি। ব্রাজিলিয়ান এই উইঙ্গারের প্রতিভা নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। ডাচ ক্লাবটিতে থাকতেই ডান প্রান্তে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতেন আন্তনি, ইউনাইটেডেও ব্যত্যয় ঘটেনি।
২২ বছর বয়সী এই ফুটবলার ইউনাইটেডের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে নিজের প্রথম তিন ম্যাচেই গোল করেছেন। এটুকু পড়ে মনে হতে পারে, ব্রাজিলিয়ান ফুটবল থেকে এটি আরেকটি উঠে আসার গল্প। তা বলাই যায়, তবে আন্তনি ‘দোজখ’ পেরিয়েই এই আলোর দেখা পেয়েছেন। ‘দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’–এ লেখা কলামে নিজের উঠে আসার গল্পই জানিয়েছেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে থাকা এই উইঙ্গার।
আন্তনির লেখার শুরুটাই চমকে দেওয়ার মতো। সাও পাওলোর ওসাসকোতে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলার লেখার শুরু করেছেন এভাবে, ‘আমার জন্ম দোজখে। এটা মোটেও কৌতুক নয়। আমার যেসব ইউরোপিয়ান বন্ধু জানেন না তাদের বলছি, সাও পাওলোর যে ফ্যাভেলায় (বস্তিবিশেষ) আমি জন্মেছি, তাকে বলা হয় “ইনফার্নিনহো” বা “ছোট্ট দোজখ”।’
আন্তনি তারপর লিখেছেন, ‘মানুষ হিসেবে যদি আমাকে বুঝতে চান, তাহলে অবশ্যই আমি কোথা থেকে এসেছি, তা বুঝতে হবে। জানতে হবে আমার ইতিহাস ও শিকড়—ইনফার্নিনহো।’
সেই ফ্যাভেলায় আন্তনি যে বাসায় থাকতেন, সেখান থেকে ১৫ পা সামনেই ড্রাগ ডিলারদের আনাগোনা ছিল। জানালা দিয়ে মাদকের গন্ধ ঢুকে পড়ত বাসায়। আন্তনি লেখায় জানিয়েছেন, তাঁর বাবা কখনো কখনো আর সহ্য করতে না পেরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবার প্রতি হুংকার দিয়ে উঠতেন। তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলতেন। কারণ, মাদকের ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের কারণে বাসায় টিভিতে ফুটবল ম্যাচ দেখতে সমস্যা হতো।
বন্দুক ও গোলাগুলির আওয়াজ আন্তনির শৈশবেরই অংশ ছিল। স্কুলে যাওয়ার পথে একদিন ভয়াবহ এক ঘটনার কথা জানিয়েছেন এভাবে, ‘তখন আমার বয়স ৮ অথবা ৯ বছর। গলির রাস্তায় দেখলাম এক লোক পড়ে আছে। শরীরটা নিথর। কাছে গিয়ে বুঝলাম সে মৃত। ফ্যাভেলায় এসব দৃশ্যের সঙ্গে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর কোনো পথ নেই। যেহেতু আমাকে স্কুলে যেতে হতো, তাই চোখ বন্ধ করে লাফ দিয়ে লাশটা পেরিয়ে হাঁটা ধরি।’
শৈশবে এমন ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার মধ্যেও ফুটবলে ভালোভাবে বাঁচার আশা খুঁজে পেয়েছিলেন আন্তনি। তাঁর ভাষায়, ‘বাস্তবতা এমন হলেও আমি ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ, ওপর (ঈশ্বর) থেকে একটা উপহার পেয়েছিলাম। বল, এটাই আমাকে বাঁচিয়েছে। ইনফার্নিনহোতে বড়দিনে আমরা ছোটরা কখনো খেলনার আশা করিনি। গড়িয়ে চলার মতো একটা বল পেলেই খুশিতে আটখানা হয়ে উঠতাম।’
আন্তনিদের ফ্যাভেলায় একটি খেলার জায়গাও ছিল। বড় ভাইয়ের সঙ্গে সেখানে যেতেন। ফ্যাভেলায় মাদক কারবারি থেকে বাস ড্রাইভার, যেকোনো পেশার লোকই ফুটবল খেলেন। আন্তনি বয়সে ছোট হয়েও মাদক কারবারি থেকে যে কাউকে ড্রিবলিং করেছেন অবলীলায়। কারও কাছে মাথা নত করেননি। তাঁর বাবা যে সময় মাঠে খেলতেন, তখন ঘাস ছিল না। আন্তনি সেই একই মাঠ পেয়েছেন কংক্রিটে তৈরি। খালি পায়ে খেলার সময় পা কেটে রক্ত পড়ত। জুতা কেনার মতো অর্থ তাঁদের ছিল না। কিন্তু বল পায়ে এলেই কাউকে তোয়াক্কা করেননি। আন্তনির ভাষায়, ‘পায়ে বল পেলে আমার কোনো ভয় থাকত না।’
তোনিওলো নামে আন্তনিদের পাশের বাসায় একজন থাকতেন। আন্তনি তাঁর কলামে তোনিওলোকে ‘আঙ্কেল’ সম্বোধন করেছেন। তোনিওলো নিজের ওয়াই–ফাই ব্যবহার করতে দিতেন আন্তনিকে, যেন ইউটিউবে তারকাদের খেলা দেখে তিনি কিছু শিখতে পারেন। তোনিওলো আন্তনিকে এতটা ভালোবাসতেন যে ইউনাইটেডের এই খেলোয়াড় কলামে লিখেছেন, ‘তোনিওলো দুটি রুটি পেলে একটি আমাদের জন্য রাখতেন। ফ্যাভেলার এই বিষয়টি অনেকে বুঝতে পারে না। একজন হয়তো খারাপ কাজ করছে কিন্তু দুজন ভালো কাজ করছে।’
ব্রাজিলের ক্লাব গ্রেমিও ব্রুয়েরির পরিচালক আন্তনিকে একদিন খেলতে দেখে তাঁর খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। পরে তাঁকে ক্লাবের ফুটসাল দলে টানেন। তখনই প্রথম ফ্যাভেলা ছাড়ার সুযোগ পান আন্তনি। একদিন মায়ের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রেঞ্জ রোভার গাড়ি দেখে মাকে বলেছিলেন, ‘একদিন ফুটবলার হতে পারলে আমি এই গাড়িটা কিনব।’ মা শুনে হেসে দেন। আন্তনি তখনো ভীষণ সিরিয়াস, ‘হেসো না, কিছুদিন পর তোমাকেও চালাতে দেব।’
শৈশবে আন্তনির নিজের বিছানা ছিল না। মা–বাবার মাঝে ঘুমাতে হতো। ১১ বছর বয়সে আন্তনির মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। আন্তনির ভাষায়, ‘বিছানায় আগে যেকোনো পাশ ফিরলেই বাবা অথবা মাকে পেয়েছি। কিন্তু সেই ঘটনার পর পাশ ফিরে মাকে পাইনি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, এই অবস্থা থেকে বের হতে হবে।’
আন্তনি তাঁর লেখায় দার্শনিকসুলভ একটি মন্তব্যও করেছেন, ‘মিডিয়া সব সময় জানতে চায়, আমার স্বপ্ন কী? চ্যাম্পিয়নস লিগ? বিশ্বকাপ? ব্যালন ডি’অর? এগুলো স্বপ্ন নয়। এগুলো লক্ষ্য। আমার স্বপ্ন ছিল মা–বাবাকে ফ্যাভেলা থেকে বের করে আনা। অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এটা করতেই হতো, না হলে এই চেষ্টাতেই মরতাম।’
আন্তনি তাঁর লেখার শেষটা করেছেন এভাবে, ‘যেখানেই যাই না কেন, কখনো শিকড় ভুলে যাইনি, যে জায়গাটা আমাকে সবকিছু শিখিয়েছে। প্রতি ম্যাচের আগে বুটে লিখে নিই—ফ্যাভেলা। যখন বুটের ফিতে বাঁধি, তখনো সব মনে পড়ে। সবকিছু। এটাই আমার গল্প। এরপরও যদি আমাকে বুঝতে না পারেন, যদি আমাকে ভাঁড় মনে হয়, তাহলে আমার হাতে (উল্কি) যা লেখা আছে, সেটা দেখাব...শুধু ফ্যাভেলায় বাস করা মানুষেরাই বুঝবে আমি কিসের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছি। এই কথাটাই আমার গল্প, আমাদের গল্প।’