রোনালদোকে পেছনে ফেলা এমন এক গোলের স্বপ্নই দেখেছেন ‘তুর্কি মেসি’ গুলের
সিগনাল ইদুনা পার্কে তখন ৬৫ মিনিটের খেলা চলছিল। জর্জিয়ার বিপক্ষে তুরস্ক ১-১ গোলে সমতায়। মাঠের ডান প্রান্তে জর্জিয়ার এক খেলোয়াড়কে ট্যাকল করেন তুর্কি সেন্টার-ব্যাক কান আইয়ান। বল চলে যায় পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আর্দা গুলেরের পায়ে। গুলের বল নিয়ে বেশ খানিকটা এগোলেন। কেউ সম্ভবত ভাবেননি ১৯ বছর বয়সী ছেলেটির গোলের উদ্দেশ্যে শট নেওয়ার সাহস হবে। কেউ হয়তো এটাও ভাবেননি, গুলের শট নিলেও সেটি ধনুকের মতোর বেঁকে লক্ষ্যভেদ করে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে!
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক।
২০২২-২৩ মৌসুমের শুরুতে মেসুত ওজিলের ১০ নম্বর জার্সি গুলেরকে দিয়েছিল তুর্কি ক্লাব ফেনেরবাচে। কারণ? ছেলেটির অমিত প্রতিভা। বলের ওপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ, চোখধাঁধানো ড্রিবলিং, মুহূর্তের মধ্যে নাটমেগ করে বল বের করে নেওয়া এবং নিখুঁত নিশানার মতো শট—এসব মিলিয়ে গুলেরকে বলা হয় ‘তুর্কি মেসি’। ফেনেরবাচের হয়ে অভিষেক তাঁর ওই মৌসুমের আগেই—২০২১ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে। পরের বছর মার্চে তুরস্কর সুপার লিগে ফেনেরবাচের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড গড়লেন। তখন নিজের ১৭তম জন্মদিন উদ্যাপনের ১৬ দিন বাকি। সে বছরই তাঁর অভিষেক হয় তুরস্কের হয়ে এবং জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোলটি পান ২০২৩ সালে ইউরো বাছাইয়ে ওয়েলসের বিপক্ষে।
ফেনেরবাচের হয়ে গুলেরের উত্থান এমনই দুর্দান্ত ছিল যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় ইউরোপের নামীদামি ক্লাবগুলোর মধ্যে। আর্সেনাল গুলেরের পেছনে ঘুরেছে, বাদ যায়নি পিএসজি, বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবও। শেষ পর্যন্ত রিয়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে—গত বছর জুলাইয়ে ‘তুর্কি মেসি’র সঙ্গে ৬ বছরের চুক্তি করে মাদ্রিদের ক্লাবটি। ক্রমাগত চোটে গত মৌসুমে তাঁকে সেভাবে খেলাতে পারেনি রিয়াল। ৬ গোল করেছিলেন ১২ ম্যাচে (সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে)। তবে ইতিহাস গড়েন এর মধ্যেই। রিয়ালের ইতিহাসে দ্রুততম (৩৩০ মিনিট) খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগায় ৬টি গোল করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, এই ছেলে ইউরোপিয়ান ফুটবলে রাজত্ব করতেই এসেছে।
সে ধারণা আরেকটু পোক্ত হলো গতকাল রাতে ইউরোপিয়ান ফুটবলের সেরা মঞ্চে—ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ (ইউরো)! এবার ফেরা যাক তুরস্ক-জর্জিয়া ম্যাচের সেই মুহূর্তে। বল পায়ে গুলের এক পা দুই পা এগিয়ে ঠিক লিওনেল মেসির মতোই বাঁ পায়ের শট নিলেন ২০ গজ দূর থেকে। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি যেভাবে ডান প্রান্ত দিয়ে কাটইন করে ঢুকে বাঁকানো শট নেন, সেভাবে। এমন শটের ক্ষেত্রে চাইলে আপনি ডাচ কিংবদন্তি আরিয়েন রোবেনকেও স্মরণ করতে পারেন।
তবে গুলেরকে কাটইন করে ঢুকতে হয়নি। বলটা পেয়ে স্রেফ নিজের মুভমেন্টের ওপর জর্জিয়ার দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে শট নেন। বাকিটা তো জানাই। জর্জিয়া গোলকিপার গিওর্গি মামারদাশভিল্লি পূর্ণমাত্রার ডাইভ দিয়েও বলটা ছুঁতে পর্যন্ত পারেননি। গোল! আর গুলেরের এই গোলেই ইউরোয় জন্ম নিল নতুন ইতিহাস, যেখানে পেছনে পড়লেন পর্তুগিজ কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো!
ফুটবলের তথ্য-পরিসংখ্যানভিত্তিক ‘এক্স’ হ্যান্ডল অপটা হোসে জানিয়েছে, ইউরোর মূল পর্বে অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গোলের রেকর্ড এখন গুলেরের। ১৯ বছর ১১৪ দিন বয়সে গোল করলেন তুর্কি অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। এই পথে তিনি ভেঙেছেন ২০০৪ ইউরোয় গড়া রোনালদোর রেকর্ড। সেবার ১৯ বছর ১২৮ দিন বয়সে গোলের রেকর্ড গড়েছিলেন রোনালদো। বয়সে মাত্র ১৪ দিনের ব্যবধানে পর্তুগিজ কিংবদন্তিকে পেছনে ফেলে রেকর্ডটি নিজের করে নিলেন গুলের। তবে সব মিলিয়ে ইউরোয় পঞ্চম সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা গুলের। ম্যাচটি তুরস্ক জিতেছে ৩-১ গোলে।
অপটা অ্যানালিস্ট জানিয়েছে, ইউরোর তৃতীয় ‘টিনএজ’ (কিশোর) হিসেবে গোলটি করলেন গুলের। তাঁর এবং রোনালদোর আগে ১৯৬৪ ইউরোয় স্পেনের বিপক্ষে ১৯ বছর ১৮৩ দিন বয়সে গোল করেছিলেন হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক বেনে।
গুলেরের গোলের পর ওয়েলশ ডিফেন্ডার অ্যাশলে উইলিয়ামস বিবিসি ওয়ানকে বলেছেন, ‘অবিশ্বাস্য গোল। আমরা আলোচনা করছিলাম এমন বড় টুর্নামেন্ট নিজের জাত চেনানোর সুযোগ এবং সে কী দারুণভাবেই না সেটি করল!’
ম্যাচসেরা গুলের জয়ের পর সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘খুব রোমাঞ্চ লাগছে। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। এই গোলটির স্বপ্নই দেখেছি। যে অবিশ্বাস্য ভালোবাসা আমি পেয়ে আসছি, কিছু ফিরিয়ে দিতেই বেশি করে পরিশ্রম করেছি। অনুশীলন সেশন শেষে আলাদা করে এই শটের অনুশীলন করেছি। এভাবে গোল করতে পারায় তাই ভালো লাগছে। (রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি) আমাকে এর আগে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সৌভাগ্য কামনা করেছেন।’
ইউরোপিয়ান ফুটবলের বেশ কিছু তারকাই এবার সম্ভবত ক্যারিয়ারের শেষ ইউরো খেলছেন—পোল্যান্ডের রবার্ট লেভানডফস্কি, ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদরিচ, পর্তুগালের রোনালদো ও পেপে। ওদিকে গুলের ও লামিনে ইয়ামালের মতো উঠতি তারকাদের জন্য এটাই প্রথম ইউরো। স্পেনের ইয়ামাল তো সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ইউরোয় মাঠে নামা এবং গোল করানোরও রেকর্ড গড়েছেন। এই নতুন প্রজন্মের আগমনী বার্তায় বোঝা যাচ্ছে, রোনালদো-লেভাদের প্রস্থানের পর ইউরোপিয়ান ফুটবল সঠিক পথেই থাকবে।
ইংরেজ ধারাভাষ্যকার গাই মোউব্রে সাধেই কী আর বলেছেন, ‘তুর্কি মেসি নিজের প্রত্যাশার প্রতিদান দিল—তরুণদের জন্য দুর্দান্ত একটা টুর্নামেন্ট হচ্ছে!’