ক্যানসার করেছি জয়, হলান্ডকে কিসের ভয়

ইন্টার মিলান সেন্টার ব্যাক ফ্রান্সিসকো অ্যাকারবিটুইটার থেকে

উচ্চতা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি, দৌড়াতে পারেন ঘণ্টায় ৩৬ কিলোমিটার পর্যন্ত। দীর্ঘ দেহ আর দুরন্ত গতির সঙ্গে আছে ২২ বছর বয়সী তারুণ্যের ক্ষিপ্রতা আর প্রায় অফুরন্ত দম, যা কাজে লাগিয়ে এরই মধ্যে মৌসুমে তাঁর গোলসংখ্যা ৫২।

বলা হচ্ছে আর্লিং হলান্ডের কথা। ম্যানচেস্টার সিটির নরওয়েজীয় তারকাই যে আজ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে পেপ গার্দিওলার দলের বাজির ঘোড়া, সে আর না বললেও চলে। দুর্দান্ত ছন্দে থাকা হলান্ড যদি সিটির জন্য হন মূল ভরসা, তবে প্রতিপক্ষ ইন্টার মিলানের জন্য সেটাই ‘সবচেয়ে বড় ভয়’। আর ভয়ের কারণ হয়ে ওঠা হলান্ডকে সামলানোর দায়িত্বটা ফ্রান্সিসকো অ্যাকারবির। উচ্চতায় হলান্ডের কাছাকাছি, কিন্তু বাকি সবকিছুতে যোজন ফারাক।

বয়স তাঁর ৩৫, হলান্ডের চেয়ে ১৩ বছর বেশি। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল তো বটেই, ইউরোপ-সেরার টুর্নামেন্টই খেলছেন এই প্রথম। কখনো লিগ জেতেননি ইন্টার মিলান পর্যায়ের ক্লাবেই খেলছেন এই প্রথম। এসি মিলানে কিছুদিন খেলেছিলেন বটে, সেও প্রায় এক যুগ আগে অল্প কিছু ম্যাচে। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় থাকা এমন একজন সেন্টার ব্যাকের জন্য তারুণ্যে টগবগ করা হলান্ডকে সামাল দেওয়া কি যথেষ্ট ভয়ের নয়?

‘কিসের ভয়, যেখানে ক্যানসারকে করে এসেছি জয়’—হ্যাঁ, এটাই হয়তো অ্যাকারবির আসল উত্তর। যে মানুষ ক্যানসার জয় করে এখনো সবুজ ঘাসে জীবনের জয়গান গেয়ে চলেছেন, তাঁর কাছে মাঠের একজন প্রতিপক্ষ কিংবা একটি ম্যাচ এমন কিসের ভয় তৈরি করবে? বরং যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে পার হওয়া সেসব দিন এখন ভেতর থেকে জোগাতে পারে সাহস, দিতে পারে প্রেরণা।

রক্ষণের পাশাপাশি সতীর্থদের গোলে সহায়তার দক্ষতাও আছে অ্যাকারবির
টুইটার থেকে

একটি মৃত্যুতে শুরু

অ্যাকারবির গল্পের শুরুটা এক যুগ আগের। মিলানের ছোট্ট শহর ভিজোলো প্রেদাবিসিতে জন্ম, ছোটবেলা থেকে এসি মিলানের সমর্থক। ইতালিয়ান ফুটবলের নিচু স্তরের দলগুলোয় খেলার একপর্যায়ে ২০১২-এর গ্রীষ্মে যখন স্বপ্নের এসি মিলানে যোগ দেন, তার কিছুদিন আগে অ্যাকারবির বাবা মারা যান। তাঁকে ফুটবল চিনিয়েছিলেন বাবা, খেলতে শেখাও। ‘গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্ত’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাবার মৃত্যুতে নিজের পতনের শুরু বলে অভিহত করেন অ্যাকারবি, ‘বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু খালি খালি লাগত। ফুটবলকে অর্থহীন মনে হতো। আমার তলানির দিকে পড়ে যাওয়ার শুরু ওই সময় থেকে।’

অ্যাকারবি ফুটবলে মনোযোগ হারিয়ে ঝুঁকে পড়েন নৈশক্লাবে, মদের আসরে। শুরু হয় অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা। প্রতিদিন বেশি রাত পর্যন্ত বারে আর বাইরে কাটতে লাগল সময়। মিলান কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বুঝতে পেরে তাঁকে শহর দূরে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। উদ্দেশ্য, শহরে আসতে-যেতে যেন সময় লাগে। চাইলেই বারে চলে যেতে না পারে। কিন্তু অ্যাকারবি তখন নিয়ন্ত্রণহীন, ‘প্রায়ই ক্যাম্পে যেতাম মাতাল হয়ে। রাতে খুব একটা ঘুম হতো না। এ জন্য খুব যে সমস্যা হতো, তা নয়। শারীরিক দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী ছিলাম। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েই মাঠে ফিরতে পারতাম। খেলতামও ভালোই।’

তবে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা অ্যাকারবিকে ক্লাবে রাখতে রাজি ছিল না এসি মিলান। খেলার প্রতি আগ্রহ ফেলেছিলেন অ্যাকারবি নিজেও। ভাবছিলেন ফুটবল খেলাই ছেড়ে দেবেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে মিলান তাঁকে জেনোয়াতে পাঠিয়ে দেয়, সেখান থেকে ধারে চিয়েভোতে। কয়েক মাস পর জুলাইয়ে ১৮ লাখ ইউরোয় তাঁর প্লেয়িং রাইটসের অর্ধেক কিনে নিয়ে যায় সাসসুয়োলো, ওই বছরই ক্লাবটি সিরি বি থেকে সিরি আ-তে পা রেখেছে।

শুরুর আগেই শেষের পদধ্বনি

সাসসুয়োলোর সঙ্গে চুক্তির পর নিয়মিত মেডিকেল চেকআপে অ্যাকারবির রক্তে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন, টেস্টিকুলার (অণ্ডকোষ) ক্যানসারে ভুগছেন তিনি। দ্রুতই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয়, অপসারণ করা হয় টিউমার। অ্যাকারবির ভাষায় সবকিছু তখনো ‘যন্ত্রণামুক্ত’। কয়েক মাস পর ডোপ টেস্ট করা হলে পজিটিভ আসে তাঁর। ইতালিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। পরে দেখা যায়, অনিয়মিত হরমোনের প্রভাবে ক্যানসার ফিরে এসেছে।

এখান থেকে শুরু হয় ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই, ‘২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে মার্চের ১৪ তারিখ পর্যন্ত আমি কেমোথেরাপি নিই। এটা ছিল একটা সমান্তরাল পৃথিবীতে পদার্পণের মতো। একজন মানুষের ভাবনায় পৃথিবীটা যে পর্যন্ত আসা সম্ভব, তার কাছাকাছি। এটা ছিল যন্ত্রণা ও সাহসের জগৎ।’ অ্যাকারবি বলছিলেন লা রিপাবলিকাকে।

হঠাৎ এক সকালে...

তবে দ্বিতীয় দফা চিকিৎসার পরই যে তিনি নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন, তা নয়। অনেকটা ক্যানসার-পূর্ব সময়ের মতোই জীবনযাপন করতেন। জীবন সম্পর্কে বোধ, পেশাদারত্ব আর সুশৃঙ্খলতা নিয়ে বুঝ আসতে শুরু করে ধীরে ধীরে, ‘অসুস্থতার বছরখানেক পরের ঘটনা। এক সকালে আমি প্রচণ্ড ভয় নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি। রাতে কিছুই ঘটেনি। কিন্তু সকালে আমি আমার নিজের ছায়াকে ভয় পেতে শুরু করলাম। ভাবতে শুরু করলাম আমার কারণে বাবা-মাকে যেসব দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়েছিল, জীবনে আসা যেসব সুযোগ হাতছাড়া করেছি, যে বছরগুলো নষ্ট করেছি, সন্ধ্যার পর মাত্রাতিরিক্ত যা করেছি...সবকিছুই। এবং হঠাৎ করেই।’

আকস্মিক সেই ভাবনার পরই নিজেকে পাল্টাতে শুরু করেন। সহায়তা নেন পেশাদার মনোবিদের। বুঝতে পারেন আশপাশে ভালোবাসার এবং বিশ্বাসী মানুষ দরকার। গ্যাজেত্তা দেল্লো স্পোর্তকে বলছিলেন, ‘ক্যানসার না হলে আমি হয়তো ২৮ বছর বয়সেই অবসর নিতাম। হয়তো সিরি বিতে খেলতাম। ক্যানসারের আগে যা কিছু হারানোর, সবই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ক্যানসারের পর শুরু হলো আমার সত্যিকারের জীবন, ক্যানসার আমাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দিল।’

ফেরা ...

সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আগের সব হতাশা-বিষণ্নতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ান অ্যাকারবি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন সাসসুয়োলোতে, এর পর যোগ দেন লাৎসিওতে। এরই মধ্যে নিয়মিত হন ইতালির জাতীয় দলেও, বিশেষ করে জর্জিও কিয়েল্লিনির অবসরের পর। গলায় ওঠে ইতালির ২০২০ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের গৌরবময় পদকও।

সিরি আ–য় ফিওরেন্তিনার বিপক্ষে বল দখলের লড়াইয়ে অ্যাকারবি (বাঁয়ে)
রয়টার্স

গত সেপ্টেম্বরে তাঁকে ধারে ইন্টার মিলানে নিয়ে আসেন সিমোন ইনজাগি, যিনি একসময় লাৎসিওর কোচ ছিলেন। শুরুতে ইন্টার দর্শকেরা তাঁকে খুব একটা আন্তরিকতার সঙ্গে নেয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন ক্লাবের জনপ্রিয় মুখদের একজন তিনি। এই মৌসুমে ইন্টারের কোপা ইতালিয়া আর সুপারকোপা ইতালিয়ানা জয়ে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। আর চ্যাম্পিয়নস লিগে অবদান তো ইন্টারের ফাইনালে ওঠাই বলে দিচ্ছে।

শোনা যাচ্ছে, মৌসুম শেষে ইন্টার মিলান তাঁকে চুক্তিবদ্ধ করে নেবে। তার আগে একটাই কাজ এখনো বাকি—চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। সামনে অদম্য ম্যানচেস্টার সিটি হোক বা দুরন্ত হলান্ড, অ্যাকারবির তাতে কী যায় আসে? তিনি যে এর চেয়ে হাজার গুণ বড় চ্যালেঞ্জ জয়ী!