নেপলসের ডিয়েগো আরামান্দো ম্যারাডোনা স্টেডিয়ামে তখনো প্রথমার্ধের খেলা শেষ হয়নি। ম্যাচের ৪৪ মিনিটেই লিভারপুলের বিপক্ষে ৩-০ গোলে এগিয়ে নাপোলি। এ স্কোরলাইন হয়তো অনেককেই অবাক করেছে। পরিসংখ্যানপ্রেমীরা ততক্ষণে ইউরোপিয়ান ফুটবলে লিভারপুলের সর্বোচ্চ ব্যবধানে হারার হিসাব খুঁজতে রেকর্ড বইয়ে ডুব দিতে শুরু করেছে।
নাপোলির মাঠে লিভারপুলের ৪৫ মিনিটের বিভীষিকাময় পারফরম্যান্সে আরও গোলের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকে। এমনকি আলিসনের পেনাল্টি সেভ ও ভার্জিল ফন ডাইকের গোললাইন থেকে বল না ফেরানোর ব্যাপার না ঘটলে স্কোরলাইনটা আরও নির্মম হতে পারত। এ কোন লিভারপুল—এমন প্রশ্ন জাগছিল ক্ষণে ক্ষণে। ইয়ুর্গেন ক্লপের ‘হেভিমেটাল’ ফুটবলের দম কি তবে ফুরিয়ে গেল?
ক্লপ লিভারপুলের দায়িত্ব নেন ২০১৫ সালে। এর আগে প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে যেন ‘শীতনিদ্রা’য় ছিল লিভারপুল। ক্লপের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সেই ঘুম ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে অ্যানফিল্ডের দলটির। চ্যাম্পিয়নস লিগে লম্বা সময়ের ব্যর্থতার গল্পে যতি পড়ে ২০১৯ সালে, টটেনহামকে হারিয়ে ১৪ বছর পর ইউরোপসেরার মুকুট মাথায় পরে লিভারপুল। ক্লপ-জাদু এরপর প্রিমিয়ার লিগেও ঘুম ভাঙায় ‘অলরেড’দের। তিন দশকের খরা কাটিয়ে ২০২০ সালে লিগ জেতে তারা।
কোন গান গেয়ে আর কীভাবে লিভারপুলের ঘুম ভাঙালেন ক্লপ—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফুটবল-অভিধানে একটু উঁকি দিতে হবে। সেখান থেকে তুলে আনতে হবে একটি শব্দ—গেগেনপ্রেসিং। ফলনির্ভর ফুটবলে এটা বেশ কার্যকর একটা কৌশল। নিজেদের সীমানায় প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুত প্রতি-আক্রমণে যাওয়ার এ কৌশল কাজে লাগিয়ে ক্লপ লিভারপুলকে ‘অন্য রকম’ করে ফেলেছেন।
কিন্তু নতুন মৌসুমে ক্লপপূর্ব যুগেই যেন আবার ফিরে গেছে লিভারপুলের ফুটবল! লিগে বাজে শুরুর পর চ্যাম্পিয়নস লিগের শুরুতেও হতশ্রী পারফরম্যান্স। বড় ব্যবধানে হার ছাপিয়ে আলোচনায় মাঠে লিভারপুলের ছন্নছাড়া ফুটবল। নাপোলির কাছে কাল ৪-১ গোলে হারার পর ক্লপ নিজেই বলেছেন, অনেক কিছুর অভাব আছে তাঁদের খেলায়। আর লিভারপুল এমন খেলেছে যে লিগে তাদের পরের ম্যাচের প্রতিপক্ষ উলভস হয়তো হাসি থামাতেই পারবে না।
গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুটজয়ী মোহাম্মদ সালাহ এবার বড্ড ম্লান। প্রিমিয়ার লিগ বা চ্যাম্পিয়নস লিগ—সালাহকে মাঠে যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! সালাহ যেন এ মৌসুমে লিভারপুলের সামগ্রিক পারফরম্যান্সের চিত্র! প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে বিপর্যয় ভর করেছে লিভারপুলের ওপর। গত মৌসুমেও চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলা দলটির এমন দৈন্য দশা কেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক—
মাঝমাঠে সমস্যা
লিভারপুলের মাঝমাঠ সমস্যা গ্রীষ্মের দলবদলের সময় থেকেই ছিল। চোটের হানা এবং বিকল্প খেলোয়াড়ের অপর্যাপ্ততা এর মূল কারণ। কিন্তু দলবদলের সময় এদিকে সেভাবে খেয়ালই দেয়নি ক্লাব কর্তৃপক্ষ। কার্যকর কোনো মিডফিল্ডার দলে টানতে পারেনি লিভারপুল। পর্তুগালের তরুণ মিডফিল্ডার ফাবিও কারভালহো এখনো পরীক্ষিত নন। আর আর্থার মেলোর সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ লিভারপুল-সমর্থকদেরই। লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ চলাকালেই তাই ক্লপ বাধ্য হচ্ছেন মাঝমাঠ নিয়ে প্রায় প্রতি ম্যাচেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। গতকাল নাপোলির বিপক্ষেসহ সর্বশেষ তিন ম্যাচেই যেমন মাঝমাঠে তিনটি আলাদা সমন্বয় করেছেন ক্লপ।
এটা সেভাবে কাজে লাগছে কই! প্রায় প্রতি ম্যাচেই মাঝমাঠে খেই হারিয়েছে লিভারপুল। যার চাপ রক্ষণের ওপর গিয়ে পড়েছে। প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ের বিপক্ষে এলোমেলো হয়ে পড়েছে রক্ষণ।
চোটের বহর
লিভারপুলের বর্তমান পরিস্থিতিতে চোট কোনো অজুহাত নয়, বরং এটিই বাস্তবতা। চোটে পড়ায় আগস্ট মাসে অন্তত ১০ খেলোয়াড়কে পায়নি লিভারপুল। চোট সমস্যায় বিপর্যস্ত দলটি একাদশ সাজাতেই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। ডিফেন্ডার জোয়েল মাতিপ ও ফরোয়ার্ড দিয়েগো জোতা চোট কাটিয়ে ফিরলেও ইব্রাহিমো কোনাটে, কালভিন রামসে, থিয়াগো আলকানতারা, অ্যালেক্স অক্সালেড-চেম্বারলিনের মতো অনেকেই এখনো মাঠের বাইরে। দলে এমন চোটের বহর ক্লপকে কৌশল সাজানোর ক্ষেত্রেও সমস্যায় ফেলছে। বিশেষ করে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে যোগ্য বিকল্প নেই ক্লপের কাছে, যা নিয়ে মাঝে আক্ষেপও করেছিলেন এই জার্মান কোচ। এমনকি ছন্দহীন খেলোয়াড়দেরও বিশ্রাম দিতে পারছেন না তিনি। একাদশে খেলাতে হচ্ছে বয়সের ভারে কিছুটা নুইয়ে পড়া জেমস মিলনারকেও।
ফরোয়ার্ডদের ছন্দহীনতা
লিভারপুলের আক্রমণভাগে একমাত্র দিয়াজ ছাড়া আর কেউই ছন্দে নেই। সালাহর খেলায় ভর করেছে ক্লান্তি। প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের কাছে ‘বন্দী’ হয়ে পড়ছেন এই মিসরীয় তারকা। নুনিয়েজ নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। রবার্তো ফিরমিনোর উপস্থিতি তেমন কোনো পার্থক্য তৈরি করতে পারছে না। দিয়েগো জোতা মাত্রই ফিরলেন চোট কাটিয়ে। নিজেকে ফিরে পেতে সময় দিতে হবে তাঁকেও। সব মিলিয়ে আক্রমণভাগের ছন্দহীনতা লিভারপুলের সামগ্রিক ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
দলবদলে হেঁয়ালি
দলবদলের মৌসুমজুড়ে লিভারপুল-সমর্থকদের হাহাকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাতাসকে ভারী করেছে। বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেখানে দলবদলের বাজারে টাকার বস্তা নিয়ে নেমেছে, লিভারপুল ছিল শুধুই দর্শকের ভূমিকায়। রেকর্ড গড়ে এক নুনিয়েজকে আনা ছাড়া দলবদলের বাজারে আর তেমন কোনো সাফল্য নেই লিভারপুলের। পর্যাপ্ত খেলোয়াড় কিনতে না পারায় কোণঠাসা দলকে জাগিয়ে তোলার রসদের দিকটা মিস করছে গত মৌসুমের লিগ রানার্সআপরা।
মানের অভাব
গত মৌসুমের শেষভাগে লিভারপুল আক্রমণভাগের কেন্দ্রে ছিলেন মানে। সালাহর সঙ্গে তাঁর জুটিটা জমেওছিল বেশ। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে করা ২৩ গোলের ১৪টিই মানে করেন মৌসুমের শেষভাগে গিয়ে। যে সময় লিভারপুল ঘরোয়া ডাবল এফএ কাপ ও লিগ কাপ জেতার পাশাপাশি শিরোপা চতুষ্টয় জয়ের সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছিল। তবে মৌসুম শেষেই ৩ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে বায়ার্ন মিউনিখে নাম লেখান মানে।
নুনিয়েজকে আনার কারণে মানেকে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেনি ক্লাবটি। যদিও লিভারপুলের সেই পদক্ষেপ কতটা কাজে লেগেছে, তা এখনই বলা কঠিন। নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশির ভাগ ম্যাচে নামতেই পারেননি নুনিয়েজ, হারিয়ে ফেলেছেন শুরুর ছন্দটাও। যার ফলে মানের অভাবটা বড্ড প্রকট হয়ে উঠেছে অ্যানফিল্ডে। ডিফেন্ডারদের ওপর মানের আধিপত্য দেখানোর সামর্থ্য দারুণ। এমনকি গতিতেও প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে পারেন তিনি। আর এ জায়গাতেই মানের অভাবটা বেশি টের পাচ্ছে লিভারপুল। নতুন মৌসুমে নিয়মিতই প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের গতির সঙ্গে পেরে উঠছেন না লিভারপুল খেলোয়াড়েরা। বলের দখল হারাচ্ছে যখন-তখন। এ অবস্থায় মানের অভাব খুব পোড়াচ্ছে লিভারপুল-সমর্থকদের।