কেইন কি সক্রেটিসের পথে

ট্রফিবিহীন আরও একটি মৌসুম হ্যারি কেইনেররয়টার্স

আরও একটি অভিযানের সমাপ্তি, আক্ষেপের তালিকায় আরও একটি অধ্যায়ের সংযুক্তি।

উল্লসিত, উদ্বেলিত সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর এক পাশে দাঁড়িয়ে হ্যারি কেইন হয়তো প্রশ্ন করছিলেন নিজেকেই, ‘এভাবে আর কত?’ ১৫ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ার। চার শর বেশি গোল। কত কত রেকর্ড। সুখস্মৃতির হাজারো মুহূর্ত। কিন্তু সব থেকেও নেই যেন কিছুই। সবাই মিলে একটা ট্রফি নিয়ে উল্লাসের মুহূর্তটাই যে নেই কেইনের অ্যালবামে।

কেইনের এই হাহাকারময় দীর্ঘ নিশ্বাস ফুটবল দুনিয়ায় নতুন নয়। ফুটবলের বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা হয়ে ওঠায় যাঁদের বড় অবদান, তাঁদের একজনকেও এমন না পাওয়ার বেদনায় পুড়তে হয়েছে বছরের পর বছর। শেষ পর্যন্ত বুটজোড়াও তুলে রেখেছেন শীর্ষ পর্যায়ে কখনো ট্রফি জিততে না পারার অপূর্ণতা নিয়েই। নাম তাঁর সক্রেটিস। শুধু ব্রাজিলেরই নয়, বিশ্ব ফুটবলেরই যিনি কিংবদন্তি। ট্রফি ছাড়াই পেশাদার ক্যারিয়ারে দেড় দশক পার করে ফেলা কেইনও কি তবে সক্রেটিসের পথেই এগোচ্ছেন?

কেইন গত বছর পর্যন্ত ছিলেন টটেনহাম হটস্পারে। চুক্তির মেয়াদ বাকি ছিল, টটেনহামও তাঁকে ধরে রাখতে চেয়েছিল। নিজেও ছিলেন ছন্দেই, প্রতিবছরই প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষ গোলদাতাদের তালিকায় প্রথম দিকেই থেকেছে তাঁর নাম। কিন্তু টটেনহামে কোনো ট্রফি ছিল না তাঁর।

দুবার লিগ কাপে আর একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলেও শূন্য হাত। অধরা সেই শিরোপার জন্যই পাড়ি জমান বায়ার্ন মিউনিখে। যে বায়ার্ন টানা ১১ বছর ধরে জার্মানির লিগ চ্যাম্পিয়ন। জার্মান কাপ আর চ্যাম্পিয়নস লিগেও যারা বড় শক্তি। কিন্তু হায়! কেইনও এলেন আর বায়ার্নও হারিয়ে ফেলল রাজত্ব। বুন্দেসলিগা জিতে নিল বায়ার লেভারকুসেন। জার্মান কাপে যাত্রা থেমে গেল দ্বিতীয় রাউন্ডে, জার্মান সুপার কাপে ফাইনালে। সর্বশেষ আশার সলতে হয়ে টিকেছিল উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ।

কিন্তু বুধবার রাতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেমিফাইনাল দ্বিতীয় লেগে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে যন্ত্রণার হার ২-১ ব্যবধানে! যে হার বায়ার্নের ২০২৩-২৪ মৌসুম বানিয়ে দিল ট্রফিহীন, ২০১১-১২ মৌসুমের পর যে ঘটনা প্রথম। আর কেইনের চারপাশে ছড়িয়ে গেল হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস, আরও একবার...!

আরও পড়ুন

অথচ এবারের মতো আর কোনো মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৪ গোল ছিল না কেইনের। কিন্তু দিন শেষে ফুটবল একটা দলীয় খেলা। আর দলগত অর্জনে কেইনের ঝুলি আবারও শূন্য!

কেইনের মতো ফুটবল মাঠের এমন আক্ষেপ নিয়ে পৃথিবীই ছেড়ে গেছেন সক্রেটিস। ১৯৭০ সালের দিকে ব্রাজিলের ফুটবলে ছিল লাতিনের চিরাচরিত সুন্দর ফুটবল আর ফলকেন্দ্রিক ইউরোপীয় ঘরানার ফুটবলের মিশেল। ওই সময়ই লাতিন ফুটবলের সৌন্দর্য্যের প্রতীক হয়ে আবির্ভাব সক্রেটিসের। চিকিৎসাবিদ্যায় মনোযোগী ছিলেন বলে পেশাদার ফুটবলে পা রেখেছিলেন সমসাময়িক ব্রাজিলিয়ানদের তুলনায় একটু দেরিতে—২০-এর আশপাশে।

১৯৭৩ সালে বোতাফোগো দিয়ে ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করে একই ক্লাবে শেষ করেছেন ১৯৮৯ সালে। মাঝে খেলেছেন করিন্থিয়ানস, ফ্ল্যামেঙ্গোসহ আরও চারটি ক্লাবে। এ ছাড়া ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৭ বছর (১৯৭৯-১৯৮৬)। ছিলেন ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলের অধিনায়কও। সব মিলিয়ে স্বীকৃত ফুটবলে খেলেছেন ৫১৩ ম্যাচ। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ে একটিও ট্রফি জেতা হয়নি সক্রেটিসের। বোতাফোগো, করিন্থিয়ানস ও ফ্ল্যামেঙ্গোর হয়ে কিছু ট্রফি জিতলেও সেসব ছিল আঞ্চলিক, ব্রাজিলের শীর্ষ লিগে নয়। আর জাতীয় দলে সক্রেটিসের সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৮৩ কোপা আমেরিকায় রানার্সআপ!

আরও পড়ুন

ট্রফির আক্ষেপ নিয়ে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া সক্রেটিস অনেকের চোখে সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন। ২০০৪ সালের মার্চে বিশ্বসেরা জীবিত ১০০ ফুটবলারের নাম বেছে নিয়েছিলেন পেলে। সেখানে ছিল সক্রেটিসের নাম। ওয়ার্ল্ড সকারের ‘১০০ বেস্ট ফুটবলার’ তালিকায়ও আছে ‘কুল সেনসেশন’ নামে পরিচিত এই মিডফিল্ডারের নাম।

হ্যারি কেইনের শিরোপাখরা কবে ঘুচবে?
রয়টার্স

কিংবদন্তির তকমা নিয়ে ২০১১ সালে পৃথিবী ছেড়েছেন সক্রেটিস। কেইন কিংবদন্তি হতে চাইলেও (ইংলিশদের কারও কারও চোখে হয়েছেনও) নিশ্চিতভাবে ট্রফি না পাওয়ার একই আক্ষেপ নিয়ে ফুটবল ছাড়তে চাইবেন না। ইংলিশ স্ট্রাইকারের সামনে অবশ্য এখনো লম্বা পথ বাকি। আগামী মাসেই যেমন ইংল্যান্ডের হয়ে ইউরো খেলতে নামবেন। সর্বশেষ ইউরোয় রানার্সআপ হওয়া কেইনের দল এবার খেলতে নামবে জার্মানিতেই, গত এক বছর তাঁর ঘর যেখানে।

কিন্তু যত দিন না একটা ট্রফি হাতে উঠছে, কেইনকে তাড়িয়ে বেড়াবে সক্রেটিসের আক্ষেপটাই।

আরও পড়ুন