২২ মিনিটে ১ বার করে ফাউল ও বর্ণবাদী আক্রমণে নাজেহাল ভিনিসিয়ুস
কদিন আগে রিয়াল মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া বলেছিলেন, ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে রক্ষা করার কথা। প্রশ্ন উঠতে পারে, সবাইকে বাদ দিয়ে কোর্তোয়া কেন ভিনিসিয়ুসকে রক্ষা করতে বলছেন। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু পরিসংখ্যান ও খবরের দিকে চোখ রাখলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে ভিনি যেন সেই ঘণ্টা, যাঁকে এখন সবাই বাজাচ্ছেন। ফাউল করা, প্ররোচিত করে হলুদ কার্ড দেখানো কিংবা বর্ণবাদী আক্রমণ কী করা হচ্ছে না! মাঠ এবং মাঠের বাইরে কোথাও যেন নিস্তার নেই এই ব্রাজিলিয়ান তারকার। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ভিনি এমন সহজ শিকার?
সাংবাদিকদের সামনে ফাউল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ভিনিকে রক্ষার দাবি করেছিলেন কোর্তোয়া। তবে বাস্তবতা বলছে, ভিনিকে শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও রক্ষা করতে হবে। নয়তো মাঠে ও মাঠের বাইরে বিপদে পড়তে হবে রিয়ালকেই। সেদিন কোর্তোয়া বলেছিলেন, ভিনিসিয়ুসের খেলার ধরন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের পছন্দ হয় না। যার ফলে মাঠে রিয়ালকে অনেক বেশি ফাউলের শিকার হতে হয়। আর এভাবে ফাউলের শিকার হওয়ার কারণে ভিনিসিয়ুসকে মেজাজ হারাতে দেখা যায় হরহামেশা। ভিনি কার্ড দেখছেন নিয়মিত এবং এর প্রভাব পড়ছে রিয়ালের সামগ্রিক পারফরম্যান্সে।
সর্বশেষ মায়োর্কার বিপক্ষে ম্যাচটিকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়। এই ম্যাচে ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে ছিলেন রাইট–ব্যাক পাবলো মাফেও। কত আর পারা যায়! প্রথমার্ধের শেষ দিকে মাফেওকে ফাউল করে বসেন ভিনি। সঙ্গে সঙ্গে মায়োর্কার খেলোয়াড়েরা ভিনিকে ঘিরে ফেলেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালে রেফারি ভিনিকে হলুদ কার্ড দেখান।
এটি ছিল চলতি মৌসুমে ভিনিসিয়ুসের দেখা পঞ্চম হলুদ কার্ড, যা তাঁকে পরের ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছে। এইচের বিপক্ষে রিয়ালের পরের ম্যাচে ভিনিকে এখন দর্শক হয়েই থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভিনি কি তবে ফাউল করে খেলা খেলোয়াড়?
একটু তলিয়ে দেখলে অবশ্য ভিন্ন এক চিত্রের দেখা মিলবে, যা রিয়াল কর্তৃপক্ষ এবং ভিনিসিয়ুস—দুই পক্ষের জন্যই আতঙ্কের কারণ হতে পারে। একের পর এক ম্যাচে কার্ড দেখার দায় পুরোপুরি ভিনিসিয়ুসের নয়। অন্তত পরিসংখ্যান সেটাই বলছে। লা লিগায় মায়োর্কার বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচটিতে সব মিলিয়ে ২৯ বার ফাউলের শিকার হয়েছে রিয়াল, এর মধ্যে ১০টিই ছিল ভিনির বিপক্ষে। এই মৌসুমে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের নির্দিষ্ট একটি ম্যাচে এর চেয়ে বেশি ফাউলের শিকার হননি কোনো খেলোয়াড়। আর ২০১৩ সালের পর রিয়ালের কোনো খেলোয়াড় এক ম্যাচে এত বেশিবার ফাউলের শিকার হলেন।
বিষয়টি অবশ্য একটি ম্যাচের নয়। মৌসুমজুড়ে ম্যাচের পর ম্যাচে ফাউলের শিকার হয়ে চলেছেন ভিনিসিয়ুস। এ মৌসুমে লা লিগায় সব মিলিয়ে ভিনিসিয়ুস ফাউলের শিকার হয়েছেন ৭৯ বার। ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগে আর কোনো খেলোয়াড় এত বেশি ফাউলের শিকার হননি। ২০০৩–০৪ মৌসুমে লুইস ফিগোর পর প্রথম ২০ ম্যাচে রিয়ালের কোনো খেলোয়াড়ের জন্যও এটি রেকর্ড। সেবার পর্তুগিজ কিংবদন্তি ফাউলের শিকার হয়েছিলেন ৯৬ বার। পরিসংখ্যান বলছে, এ মৌসুমে প্রতি ২২ মিনিটে একবার করে ফাউলের শিকার হয়েছেন ভিনি।
চলতি মৌসুমে এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছেন ভিনিসিয়ুসের জাতীয় দল সতীর্থ নেইমার। এই পিএসজি তারকা এ ফাউলের শিকার হয়েছেন ৫৯ বার। ভিনিসিয়ুসের অধিক ফাউলের শিকার হওয়ার আরেকটি কারণ তাঁর ডিব্রল করার প্রবণতা। লিগে ১৫৮ বার প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের মুখোমুখি হয়ে এ মৌসুমে সর্বোচ্চ ৫৫ বার ড্রিবল করেছেন এই ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার।
অতিরিক্ত ড্রিবল চেষ্টা করাও তাঁর ফাউলের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
চ্যাম্পিয়নস লিগের চিত্রটা অবশ্য লা লিগার মতো নয়। গত মৌসুমের ফাইনালে লিভারপুলের বিপক্ষে গোল করে শিরোপা জেতানো ভিনি ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ফাউলের শিকার হয়েছেন ১১ বার। এই মঞ্চে ফাউলের শিকার হওয়া সেরা দশ খেলোয়াড়ের তালিকায় নেই ভিনির নাম। পাশাপাশি যে সময়ের মধ্যে লা লিগায় ৫ কার্ড দেখেছেন, সেই একই সময়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে ভিনি কোনো কার্ডই দেখেননি।
শুধু ফাউল কিংবা কার্ড দেখার ক্ষেত্রেই নয়, স্পেনে ভিনির তীব্র বর্ণবাদী আক্রমণের মুখে পড়ার ঘটনাও এখন নৈমিত্তিক। মৌসুমের শুরু থেকে গোল উদ্যাপনে নেচে বিতর্কের কেন্দ্রে আসেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। তাঁর নাচকে ঘিরে চলতে থাকে একের পর এক বর্ণবাদী আক্রমণ। মায়ের্কোর বিপক্ষে সেই ঘটনাবহুল ম্যাচেও তাঁকে পড়তে হয়েছিল বর্ণবাদী আক্রমণের মুখে।
একটি ভিডিওতে তাঁকে ‘বানর’ বলে ডাকতেও শোনা যায়। ভিনির জন্য অবশ্য এ অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন নয়। এ ঘটনার পর এক বিবৃতিতে রিয়ালের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আরও একবার বর্ণবাদী অপমানের মুখে পড়লেন ভিনিসিয়ুস, যা মেনে নেওয়ার মতো নয়।’
এর আগে গত মাসের শেষ দিকে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচেও একইভাবে বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হন ভিনিসিয়ুস। প্রতিবার এমন আচরণের পর কঠোর শাস্তির কথা শোনা যায়। তবে এরপরও একটুও কমেনি বর্ণবাদী আক্রমণ।
বর্ণবাদী আক্রমণে হতাশ ভিনিসিয়ুস বলেছেন, ‘বর্ণবাদীরা ম্যাচ দেখে চলেছে। তারা বিশ্বসেরা ক্লাবকে কাছ থেকে দেখছে কিন্তু লা লিগা কিছুই করতে পারে না। আমি আমার মাথা উঁচু রেখে খেলে যাব এবং মাদ্রিদে এভাবেই (নেচে) নিজের উদ্যাপন চালিয়ে যাব।’
আইন বা প্রশাসন যখন কিছু করতে পারে না, তখন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নাচের চেয়ে বড় অস্ত্রই–বা আর কী হতে পারে!