মেসি–সৌদি আরব সম্পর্কের পেছনে যে ‘রাজনীতি’
মেসি সৌদি আরবের পর্যটনদূত হয়েছেন ২০২২ সালের মে মাসে। তবে আর্জেন্টাইন তারকার ভূমিকা এতেই সীমাবদ্ধ নয়।
লিওনেল মেসির খেলোয়াড়ি জীবনে এ এক বিরল ঘটনা।
ম্যাচে কার্ড দেখে শাস্তি পেয়ে যেকোনো খেলোয়াড়ই নিষিদ্ধ হতে পারেন। মেসিও হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মতো খেলোয়াড় ক্লাবের শৃঙ্খলা ভেঙে নিষিদ্ধ হয়েছেন, এটা একটু অভাবনীয়ই। সেই শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনাটাও আবার কী—অনুমতি ছাড়া অনুশীলন বাদ দিয়ে সৌদি আরব সফর।
আচ্ছা, মেসি কি জানতেন না, এই কাজটা করলে তাঁকে শাস্তি পেতে হবে? হয়তো জানতেন, কিংবা না জানলেও এ রকম কিছু যে হতে পারে, সেটা তাঁর অনুমিতই ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও মেসি কেন এই ঝুঁকিটা নিলেন? সৌদি আরবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কি এতই গভীর, যার জন্য নিষিদ্ধ হতেও আপত্তি নেই মেসির, আপত্তি নেই ভাবমূর্তি নষ্ট করতেও!
সম্পর্কটা আসলে টাকার। মেসি সৌদি আরবের পর্যটনদূত হিসেবে চুক্তি করেছেন ২০২২ সালের মে মাসে। তাঁর কাজ হচ্ছে, সৌদি আরবকে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করা। এ জন্য তিনি কত টাকা পাচ্ছেন কিংবা চুক্তিটা কয় বছর মেয়াদি, এটা আসলে নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারেনি। দূত হওয়ার খবরটি ছাড়া মেসি-সৌদি সরকার চুক্তির বাকি সবকিছুই গোপন রেখেছে। রাজতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক, স্বাভাবিক খেলোয়াড়দের বাণিজ্যিক চুক্তির ব্যাপারেও। তবে ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ-এর এক খবরে বলা হয়েছিল, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সৌদি আরবের দূত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
এ জন্য প্রতিবছর তাঁকে ৬০ লাখ ইউএস ডলার (প্রায় ৬৪ কোটি টাকা) দেওয়া হবে। তবে পর্তুগিজ তারকা ওই সময় প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি। কয়েকটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিক জানিয়েছে, সৌদি আরবের সঙ্গে মেসির পর্যটন চুক্তির আর্থিক মূল্য রোনালদোকে দেওয়া প্রস্তাবের চেয়ে সম্ভবত পাঁচ গুণ বেশি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, শুধু পর্যটনদূত হওয়ার জন্য এত টাকা সৌদি আরব কেন দিচ্ছে মেসিকে? উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য অ্যাথলেটিকসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। গত বছরই কাতার বিশ্বকাপ চলার সময় ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মেসিকে পর্যটনদূত করা আসলে সৌদি আরবের বিশাল ও দীর্ঘমেয়াদি এক পরিকল্পনার অংশ। যে পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক নাম ‘ভিশন ২০৩০’। সৌদি আরবের পর্যটনমন্ত্রী আহমেদ আল-খাতিবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে তাঁর দেশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে ‘ভিশন ২০৩০’-এর লক্ষ্য। তবে গার্ডিয়ান ও অ্যাথলেটিক দাবি করছে, এর ভেতরে আছে আরও অনেক কিছু।
রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে খুব একটা উজ্জ্বল নয়। মানবাধিকার সূচকে এই দেশটির অবস্থা নিচের দিকে। সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা, নারী অধিকার খর্ব করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের প্রতি কঠোর আচরণ, প্রশ্নবিদ্ধ বিচারব্যবস্থা, অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ ও ইয়েমেন যুদ্ধে ভূমিকাসহ নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ সৌদি আরব। সৌদি আরবের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী চায় এসব আড়াল করে দেশটির ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে। সেটা করার একটা বড় উপায় হচ্ছে বৈশ্বিক খেলাধুলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা।
সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই এরই মধ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব নিউক্যাসলকে কেনা হয়েছে সৌদির রাষ্ট্রীয় তহবিল ‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে’র (পিআইএফ) অর্থায়নে, একই সংস্থার অর্থায়নে পেশাদার গলফের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট পিজিএ ট্যুরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এলআইভি গলফ ট্যুর চালু করেছে সৌদি আরব, যা গলফ বিশ্বকেই দুই ভাগ করে দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, নিয়মিত আন্তর্জাতিক গলফ ও ফর্মুলা ওয়ান টুর্নামেন্ট আয়োজন করা ছাড়াও ২০১৯ সালে জেদ্দায় আয়োজন করা হয়েছে অ্যান্থনি জশুয়া ও ওলেকসান্দর ওসিকের মধ্যে হেভিওয়েট বক্সিং লড়াইও। যে লড়াই একসঙ্গে বসে দেখেছেন সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান ও ফিফা সভাপতি জিয়ানি ইনফান্তিনো। এমনকি সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট লিগ আয়োজনের ভাবনার কথাও জানিয়েছে সৌদি আরব। এ জন্য সৌদি সরকারের প্রতিনিধিদল এরই মধ্যে আইপিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকও করেছে।
কাতার বিশ্বকাপের সময় দ্য অ্যাথলেটিক এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, সৌদি আরবের এই বিশাল পরিকল্পনাতে একটা বড় ভূমিকায় থাকবেন মেসি। প্রতিবেশী দেশ কাতার যেমন ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছে, সৌদি আরবও তেমনি ২০৩০ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে চায়। আর সে জন্য প্রধান প্রচারদূত হিসেবে ব্যবহার করতে চায় মেসিকে। সে জন্যই মেসিকে অঢেল টাকা দেওয়া হচ্ছে। অঙ্কটা এত বড় বলেই নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও অনুশীলন ফেলে সৌদিতে যাচ্ছেন মেসি। ইনস্টাগ্রামে মরুর দেশের সবুজ গাছের ছবিটবিও দিচ্ছেন।
আপাতত শুধু সফরে যাচ্ছেন, তবে ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমে গুঞ্জন, মেসির পিএসজি-অধ্যায় এই মৌসুমেই শেষ। এর পরের গন্তব্য হিসেবে বার্সেলোনায় ফেরার কথা আসছে বটে, তবে পাশাপাশি এসেছে সৌদি ক্লাব আল হিলাল থেকে বিশাল অঙ্কের প্রস্তাবের কথাও। গতকালই যেমন স্প্যানিশ রেডিও ওন্দা সেরো এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, মেসি বার্সেলোনায় ফিরলেও সেটা হবে শুধু এক মৌসুমের জন্য। পরের বছরই তিনি আল হিলালে যাবেন, সঙ্গে যেতে পারেন বার্সেলোনায় তাঁর আরও দু-একজন ঘনিষ্ঠ সতীর্থ। তখন মেসিই হবেন সৌদি আরবের ফুটবলের পোস্টার বয়।
মেসির মতো একজন খেলোয়াড়ের এভাবে সৌদি আরবের মতো একটা দেশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া মানতে পারছেন না অনেকেই। গত বছর যখন মেসি চুক্তিটা করেন, তখন সৌদি রাজতন্ত্রের নির্যাতনের শিকার হওয়া এক দল ব্যক্তি মানবাধিকার সংস্থা গ্র্যান্ট লিবার্টির মাধ্যমে মেসির কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে তাঁকে এসব বিষয়ে না জড়াতে অনুরোধ করেছিলেন।
সৌদি সরকারের সঙ্গে লিওনেল মেসির এই পর্যটন চুক্তির সমালোচনা করেছেন খালিদ আল-জাবরি নামের এক সৌদি নাগরিক, যাঁর বাবা ড. সাদ আল-জাবরি সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা। খালিদের দুই ভাই-বোন এখনো সৌদির কারাগারে বন্দী। দ্য অ্যাথলেটিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খালিদ বলেছেন, ‘আমি যে সমস্যাটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হলো খেলাধুলা দিয়ে সবকিছু ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা! এর হাতিয়ার হিসেবে মেসি নিজেকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছেন সৌদি আরবকে।’
মেসি কি আসলেই সৌদি আরবের হাতিয়ার হয়ে উঠছেন?