এবার ভিনি ডি’অর...

স্মরণীয় এক পারফরম্যান্স। হ্যাটট্রিকের আনন্দে দিশfহারা ভিনিসিয়ুসএএফপি

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ততক্ষণে শেষ বাঁশি বেজেছে। কিন্তু গ্যালারিতে উন্মাদনা শেষ হয়নি। টিভিতে সেই উন্মাতাল কোরাস শুনে ও দেখে মনে হতে পারে, পাগলামি ছাড়া কিছু নয়! ভিনদেশি ভাষা তো বোঝা কঠিন। তবে রিয়াল সমর্থকদের শরীরী ভাষার প্রকাশটা বাংলায় অনূদিত করলে মনে হবে, ‘সব সাথিদের খবর দে, ভিনিসিয়ুসকে ব্যালন ডি’অর এনে দে!’

আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়নস লিগে গতকাল রাতের বার্নাব্যুর খবর হয়তো আপনার জানা। ২-০ গোলে পিছিয়ে বিরতিতে গিয়েছিল রিয়াল। ঘুরে দাঁড়ানোর ‘ডিএনএ’ জেগে উঠেছিল তারপরই। দ্বিতীয়ার্ধে রিয়াল করেছে ৫ গোল, হ্যাটট্রিক করেন ভিনিসিয়ুস। সেটাও যেনতেন হ্যাটট্রিক নয়—কথাটি বলতে হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় গোলটির জন্য।

আমার মনে হয় ভিনিসিয়ুসই (ব্যালন ডি’অর) জিতবে। তবে সেটি আজ রাতের পারফরম্যান্সের জন্য নয়। সে গত মৌসুমে যা করেছে, সেটার জন্য। আজ রাতের ৩ গোল তাঁকে পরের ব্যালন ডি’অর জিততে সাহায্য করবে!
কার্লো আনচেলত্তি, রিয়াল মাদ্রিদের কোচ

৮৬ মিনিটে ভিনি নিজেদের অর্ধে যখন বল পান, বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের গোলপোস্ট থেকে তাঁর দূরত্ব ছিল ৮০ মিটারের। তারপর ভিনির শরীরে কী যেন ভর করল! মহাকাশে ছুটন্ত ‘তারাখসা’র গতিতে একে একে পেছনে ফেললেন সবাইকে। বলে ৯ টাচে এগোলেন ৭০ মিটার। ১০ম টাচে গোল! সেটা ফুটবলীয় প্রতিশব্দ। আসলে তো চোখে মায়াঞ্জন মেখে দেওয়া কোনো মায়াপুরীর মোহ!

ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ভিনিসিয়ুস
এএফপি

বার্নাব্যুর গ্যালারি সেই মোহেই পড়েছিল। শেষ বাঁশি বাজার পরও যা কাটেনি। ‘ব্যালন ডি’অর...ভিনিসিয়ুস ব্যালন ডি’অর’ চিৎকারে মোহগ্রস্ত হওয়ার স্বীকারোক্তিও দিয়েছে বার্নাব্যুর গ্যালারি। এবারের ব্যালন ডি’অর ভিনিকেই দেওয়া হোক—রিয়ালের ভক্তদের এই দাবির সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারেননি ভিনিরই সতীর্থ লুকাস ভাসকেজ। তাঁর দাবি একটু অন্য রকম, ‘ভিনিকে বলেছি, আজ রাতে (গতকাল) প্রতিটি গোলের পর সে-ই ব্যালন ডি’অর। দ্বিতীয়ার্ধে ভিনিসিয়ুসের খেলা সব শিশুকে দেখানো উচিত, তাহলে তারা বুঝতে পারবে, ফুটবল কীভাবে খেলতে হয়।’

আরও পড়ুন

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ভিনির দ্বিতীয়ার্ধের ভিডিও নিশ্চয়ই সংরক্ষণে রাখা থাকবে। সেই ভিডিও ফাইলের নাম কী হতে পারে? ইনস্টাগ্রামে তা বলে দিয়েছেন তাঁর একসময়ের সতীর্থ করিম বেনজেমা। ব্যালন ডি’অর লিখে পাশেই আগুনের তিনটি হলকা (ইমোজি)। সত্যি বলতে, ৩১ মিনিটের মধ্যে করা হ্যাটট্রিকটি দেখে কেউ যদি আগুন! আগুন! বলে চিৎকারও করে উঠতেন, তাঁকে দোষ দিয়ে লাভ হতো না। কাল রাতে ব্রাজিলিয়ান তারকার পারফরম্যান্সের ওটাই একমাত্র শিরোনাম—আগুন! সবাই তা পারে না কিংবা সবার পায়েই ওই আগুন ফোটে না। বিশ্বাস না হয় ডর্টমুন্ডের কোচ নুরি সাহিনের মুখেই শুনুন, ‘ভিনি জুনিয়র আমাদের নিয়ে আজ রাতে (গতকাল) যা করেছে, সেটা দুনিয়ায় খুব কম খেলোয়াড়ই পারে।’

এমন ভিনিসিয়ুসকেই দেখতে চায় রিয়াল
এএফপি

খুব কমের তো একটি সীমারেখা আছে। সেটা কেমন, ঠিক কোন ধাঁচের খেলোয়াড়েরা সেই ‘চুজেন ওয়ান’ তালিকায় পড়েন, তা বুঝে নিতে পারেন রিয়ালের ‘লা কুইন্তা দেল বুইত্রে’ (দ্য ভালচার)–এর সদস্য এমিলিও বুত্রাগুয়েনোর কথায়, ‘সে আমাকে পেলেকে মনে করিয়ে দেয়।’ রিয়াল কিংবদন্তি কিন্তু ভিনির দ্বিতীয় গোলের মোহে মজে পেলেকে স্মরণ করেননি। বুত্রাগুয়েনোর চোখে তাঁর তৃতীয় গোল ‘কালো মানিক’–এর প্রতিচ্ছবি, ‘যেভাবে বক্সে ঢুকে ফেইন্ট (শরীরী ছল) করল...পেলেকে মনে পড়েছে।’ গোলটি না দেখে থাকলে আরেকটু বুঝিয়ে বলা যায়। ৪০ গজ দূর থেকে বল পায়ে টান দিয়ে তিন ডিফেন্ডারকে কাটানোর পথে ব্রাজিলিয়ানদের চিরায়ত ‘বডি ফেইন্ট’ করেছেন ভিনিসিয়ুস, তারপর বুলেট গতির শটে গোল।

আরও পড়ুন

ভিনিসিয়ুসের রিয়াল ক্যারিয়ারে এটি তৃতীয় হ্যাটট্রিক। উয়েফা জানিয়েছে, চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়ের হ্যাটট্রিকের এটি ২২তম নজির। টুর্নামেন্টটির ইতিহাসে আর কোনো দেশের খেলোয়াড়দের এত বেশি হ্যাটট্রিক নেই।

ফুটবলের মায়াপুরীতে কখনো কখনো এমন রাত নেমে আসে, যখন আপনার মন ও মুখের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন ভিনিসিয়ুসের মতো জাদুকর!

তবে এ পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর গতকাল রাতের পারফরম্যান্স বোঝানো যাবে না। ভিনি নিজেও হয়তো বোঝাতে পারবেন না। তাঁর কাছে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে রিয়ালের মায়াপুরীতে দর্শকদের তাঁর নাম ধরে চিৎকার। ম্যাচের পর মুভিস্টারকে বলেছেন, ‘আমাদের ভক্তরা যখন আমার নামে স্লোগান ধরে, তখন স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়। আমি আরও গোল করে তাদের পুরস্কৃত করতে চাই। আমার বয়স ২৪ বছর, আমি মাদ্রিদে চিরকাল থাকতে চাই। যে ক্লাব আমাকে এত কিছু দিয়েছে, আমি তাদের সবকিছু ফেরত দিতে চাই।’

ব্যালন ডি’অর, ব্যালন ডি’অর, ব্যালন ডি’অর, ব্যালন ডি’অর...ভিনিসিয়ুসের ব্যাগে এখন ব্যালন ডি’অর।
রিও ফার্ডিনান্ড, ইংল্যান্ডের সাবেক ডিফেন্ডার ও বিশ্লেষক

ভিনি তা দিচ্ছেনও। তবে আপাতত তাঁর নেওয়ার পালা। প্যারিসে ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠান শুরু হতে আর মাত্র ৫ দিন। রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি অবশ্য এবারের ব্যালন ডি’অর নিয়ে ভাবছেন না। (ম্যাচ শেষে) বলে দিয়েছেন, ‘আমার মনে হয় ভিনিসিয়ুসই (ব্যালন ডি’অর) জিতবে। তবে সেটি আজ রাতের পারফরম্যান্সের জন্য নয়। সে গত মৌসুমে যা করেছে, সেটার জন্য। আজ রাতের ৩ গোল তাঁকে পরের ব্যালন ডি’অর জিততে সাহায্য করবে!’

হাসির কিছু নেই। পরেরটা জিততে পারবেন কি না, সময়ই তা বলে দেবে। আপাতত এবারের ব্যালন ডি’অরে সবাই ভিনির মুখটাই দেখতে পাচ্ছেন। রিও ফার্ডিনান্ডের কথাই ধরুন। মাইক্রোফোন হাতে মাঠে ভিনির খেলা দেখতে দেখতে একসময়ের বিশ্বসেরা ডিফেন্ডার কী বলেছেন শুনুন, ‘ব্যালন ডি’অর, ব্যালন ডি’অর, ব্যালন ডি’অর, ব্যালন ডি’অর...ভিনিসিয়ুসের ব্যাগে এখন ব্যালন ডি’অর।’

ফার্ডিনান্ড মোট ৯ বার ভিনির নাম বলতে গিয়ে ইচ্ছে করেই বলেছেন ‘ব্যালন ডি’অর’। নাকি ভিনিতে মোহাবিষ্ট হয়ে তাঁর মুখ ফুটে আপনাই বেরিয়ে গেছে? ম্যাচটি দেখে থাকলে উত্তর আপনার জানা। ফুটবলের মায়াপুরীতে কখনো কখনো এমন রাত নেমে আসে, যখন আপনার মন ও মুখের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন ভিনিসিয়ুসের মতো জাদুকর!