২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বড় বিনিয়োগে আলোচনায়, সৌদি লিগের ভবিষ্যৎ কী

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, সৌদি লিগের প্রথম বড় তারকাএএফপি

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দিয়ে শুরু। এরপর করিম বেনজেমা, জর্ডান হেন্ডারসন, এনগোলো কান্তে, রিয়াদ মাহরেজ, রবার্তো ফিরমিনো, সাদিও মানেসহ চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি ও বায়ার্ন মিউনিখের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়েরা পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে। সৌদি প্রো লিগই (এসপিএল) কি তবে ফুটবলারদের পরবর্তী আকর্ষণীয় গন্তব্য? স্বাভাবিকভাবেই এমন আলোচনা উঠেছে।

শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের লিগ কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তা বলবে সময়। তবে শিগগিরই এটি টাকা ছড়ানো থামাবে না। বেশ দীর্ঘমেয়াদি ও মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েই লিগের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। এমন চলতে থাকলে ৯-১০ বছরের মধ্যে লিগটি লাভবান হবে বলেও মনে করছেন লিগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বিশেষজ্ঞ।

এই বিশেষজ্ঞের নাম পিটার হাটন, যুক্ত আছেন সৌদি প্রো লিগের পরিচালনা বোর্ডে। হাটনের মতে, এসপিএলে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা সামনেও থাকবে, ‘আমার মনে হয়, কয়েক বছরের জন্যই বাজেট ধরা হয়েছে, এটি কমে আসবে, এমনটি মনে করি না আমি।’ এর আগে ইউরোস্পোর্ট, ইএসপিএন, আইএমজি, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছেন হাটন। ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি এতটা বড়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্প দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন।

গত মাসে পিএসজির ফরাসি স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পেকেও ভেড়াতে চেয়েছিল সৌদি প্রো লিগ। আল হিলাল তাঁর জন্য বিশ্ব রেকর্ড ২৫ কোটি ৯০ লাখ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রস্তাব দিয়েছে। ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলা এরই মধ্যে সৌদি লিগের প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন, এটি দলবদলের বাজার বদলে দিয়েছে। ফলে কী ঘটছে, সে ব্যাপারে ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদিকে লিভারপুল ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপ সৌদিতে ইউরোপের তুলনায় দেরিতে দলবদলের বাজার বন্ধ হওয়ায় নিজের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন।

সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন সাদিও মানেরা
এএফপি

এখনই সব লিগকে ছাড়িয়ে গেছে সৌদি প্রো লিগ, ব্যাপারটি অবশ্য তা নয়। তবে তালিকার ওপরের দিকেই আছে তারা। ট্রান্সফারমার্কেটের তথ্য অনুযায়ী, এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত খেলোয়াড় কেনার পেছনে প্রায় ৪০ কোটি ৯০ লাখ ইউরো বা ৩৫ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড খরচ করেছে সৌদি লিগ। যেটি বিশ্ব ফুটবলে পঞ্চম সর্বোচ্চ, লা লিগার (২১ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড) চেয়েও বেশি। তালিকায় এখনো ১.৩৭ বিলিয়ন ইউরো খরচ করা প্রিমিয়ার লিগই শীর্ষে।

আরও পড়ুন

সৌদি লিগ ইউরোপের অন্যান্য লিগের জন্য কতটা হুমকির হতে পারে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিবিসির স্পোর্টস এডিটর ড্যান রোনকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে হাটন বলেন, ‘সৌদিতে যে বিনিয়োগ, সেটি দুর্দান্ত। বেশ দ্রুত এগিয়েছে বলতেই হবে। তার মানে এই নয় যে সামনে বিশ্ব ফুটবলে ইউরোপ শক্তিশালী থাকবে না। তবে আমি বলব, এটি খারাপ হবে না। বিশ্বজুড়েই শক্তিমত্তা থাকাটা ফুটবলের জন্যই ভালো।’

হাটন এরপর মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘খেলার জগতে এটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে প্রিমিয়ার লিগ এ মৌসুমে যা খরচ করেছে, এটি তার পাঁচ ভাগ বা চার ভাগের এক ভাগ।’

আরও পড়ুন

শুধুই ফুটবল নাকি স্পোর্টসওয়াশিং
সম্প্রতি খেলাধুলায় বেশ বড় বিনিয়োগ করছে সৌদি আরব। ফুটবল ছাড়াও গলফে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করছে তারা। গলফের শক্তিশালী সংস্থাকেও নড়বড়ে করে দিয়েছে। তবে এসবের মাধ্যমে তারা তাদের ভাবমূর্তি নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে চাইছে বলেও বলা হচ্ছে।

এমনিতে মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে সৌদি আরবকে ঘিরে। সেখানে সমকামিতাও নিষিদ্ধ, যেটির সম্ভাব্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এর আগে সমকামীদের সমর্থন দেওয়া হেন্ডারসন যখন সৌদি লিগের আল ইত্তিফাকে গেলেন, সেটি নিয়েও সমালোচনা হয়েছে।

প্রো লিগে গেছেন করিম বেনজেমা
টুইটার

এ ব্যাপারে হাটন বলেছেন, ‘আমি সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি; কারণ, আমি কিছু ব্যাপার দেখেছি। আমার স্ত্রী ফিফায় নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করে। সে জানে সেখানে কী হচ্ছে। আপনি পরিবর্তনটা দেখবেন। এটি স্থানীয়দের কতটা আনন্দ এনে দিচ্ছে, সেটিও দেখবেন।’

নারীদের অবস্থান সেখানে বদলাচ্ছে বলেও দাবি হাটনের, ‘সৌদি সম্প্রদায়ে নারীদের ভূমিকা দুর্দান্ত এবং এটি এগোচ্ছেও বেশ দ্রুতগতিতে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের চোখে এটি আরও দ্রুত এগোতে পারত। তবে দেশটির ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এটি দুর্দান্তভাবে এগিয়েছে।’

আরও পড়ুন

হাটন এরপর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি চোখের সামনে প্রমাণ দেখি। এখন স্কুলগামী ৫০ হাজার মেয়ে ফুটবল খেলে। ১ হাজার নারী কোচ আছে। ২০১৮ সালে ছিল ৭৫০ জন নিবন্ধিত কোচ, এখন আছে ৫ হাজার ৫০০। পরিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে এগুলো দেখা যায়। সামাজিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নকেও দেখা যায়। আমার কাছে এ প্রকল্পের মূল আকর্ষণই এটি।’

শুধু রোনালদো-বেনজেমাদের ভেড়ানোর বাইরেও এর প্রভাব আছে বলে মনে করেন হাটন, ‘এটা শুধু শিরোনামে থাকা খেলোয়াড়, দলবদলের বড় অঙ্ক আর বেতনের ব্যাপার নয়। এটি সৌদি ফুটবলের পুরো অবকাঠামোর ব্যাপার। সেটি নারী হোক, যুব ফুটবল হোক, দেশটিতে খেলা বদলে দেওয়ার একটি অবকাঠামো হোক।’

সত্যিকারের সমর্থক আছে সেখানে?
মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কোনো লিগের আলোচনায় আসা—এ ক্ষেত্রে সৌদিই প্রথম নয়। এর আগে চীনা সুপার লিগও এমন শুরু করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি দাঁড়াতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সৌদি ব্যতিক্রম হবে বলেও মনে করেন হাটন।

পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) নামে একটি সংস্থার কাছে আছে সৌদি প্রো লিগের চারটি ক্লাবের মালিকানা। খেলোয়াড় নেওয়ার ব্যাপারে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনাও গড়ে তোলা হয়েছে। হাটনের বিশ্বাস, সৌদি লিগে সরকারের সম্পৃক্ততা অন্য লিগগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে। এর মাধ্যমে একাডেমি, নারী লিগ, পুরুষ লিগ ও ফুটবল ফেডারেশন একত্রে উন্নতির দিকে এগোবে, এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়াবে না।

হাটন বলছেন, ‘সৌদি লিগে ৫০ বছরের ঐতিহ্য আছে। এটিতে প্রতিষ্ঠিত ক্লাব, প্রতিষ্ঠিত সমর্থক আছে। এটা সত্যিকারের একটি প্রতিযোগিতা, আমরা যার উন্নতি করতে চাচ্ছি। নতুন কিছু গড়ে তোলার বিপরীতে। এমবাপ্পের প্রস্তাব এবং রুবেন নেভেসের মতো খেলোয়াড়কে নেওয়ার ভালো দিক হচ্ছে, এর মানে শুধু বয়স্ক খেলোয়াড়দের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। কিসে আরও বাড়তি কিছু যোগ করবে, কিসে গ্ল্যামার বাড়বে, তারকাখ্যাতি আসবে—এসব ব্যাপারেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।’

প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোও এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে বলেও মনে করিয়ে দিয়েছেন হাটন, ‘এগুলো সত্যিকারের ক্লাব, যাদের সত্যিকারের সমর্থকগোষ্ঠী আছে। যারা সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চিত। যেমন নতুন বিনিয়োগ আসার পর চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটির সমর্থকেরা রোমাঞ্চিত ছিল। এটি ব্যতিক্রমী কিছু নয়।’

এমনিতে মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী অধিকার নিয়ে প্রশ্ন আছে সৌদি আরবকে ঘিরে
এএফপি

বাণিজ্যিক দিক দিয়ে লাভবান হবে লিগ
বড় বিনিয়োগ মানে নিশ্চিতভাবেই বড় লাভের আশা! সৌদি লিগ যে এত টাকা খরচ করছে, সেখানকার বাজার অনুযায়ী লাভের সম্ভাবনাই–বা কতটুকু? হাটন বলছেন, ‘৯-১০ বছর সময়ে আমি বড় আয়ের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। প্রতিবছর নতুন দুয়ার খুলে যাওয়া, টিভি স্বত্ব বাড়া, স্পনসরদের অর্থ পাওয়া—এসব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কমে যাবে, এমন আশঙ্কা দেখছি না আমি।’

হাটন রোনালদোর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘রোনালদো আল নাসরে আসার পর থেকেই আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টারদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। গত বছর রোনালদো আসার পর থেকে আমরা ১৭০টি অঞ্চলে পৌঁছেছি। বিশ্বজুড়ে সম্প্রচারকদের আগ্রহ ধরতে পেরেছি, এটি বড় একটা ব্যাপার, ইতিবাচক দিক। সামনের মৌসুমে যুক্তরাজ্যেও সম্প্রচারস্বত্ব বিক্রি করতে করতে পারব বলে আমি আত্মবিশ্বাসী।’