মরক্কোর সাফল্যের রহস্য ১৪ ‘ইউরোপীয়’
বিশ্বকাপে যেন মরক্কান রূপকথাই লেখা হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তারা এখন শেষ চারে। প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়ে নতুন ইতিহাসই গড়েছে দলটি। মরক্কো প্রথম আরব দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা দলও। অতীতে যেখানে বিশ্বকাপে মরক্কোর সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল দ্বিতীয় রাউন্ড, সেখানে এবার স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেই ইতিহাস গড়েছিল তারা। কাল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে হারিয়ে সেমি-যাত্রা দেশটির ফুটবল ইতিহাস তো বটেই, বিশ্বকাপকেই ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে প্রথম খেলা মরক্কোকে এর পরের বিশ্বকাপ খেলতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৮৬ পর্যন্ত। মেক্সিকোতেই আরেক বিশ্বকাপে আফ্রিকার অন্যতম প্রতিনিধিরা খেলেছিল দ্বিতীয় রাউন্ডে। এরপর ১৯৯৪, ১৯৯৮তে চূড়ান্তপর্বে খেললেও গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে তাদের। আটানব্বইয়ের পর দীর্ঘ একটা বিরতি। ২০০২, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪—চারটি বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্বে আসতে পারেনি তারা। রাশিয়ায় ২০১৮ সালে ভালো খেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে না পারাটা ছিল মরক্কোর জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এবার অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই সেমিফাইনালে তারা। মরক্কোর এই সাফল্য জাতীয় দল নিয়ে নির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী ভাবনারই ফসল বলছেন বিশ্লেষকেরা।
মরক্কান জাতীয় ফুটবল দল কয়েক বছর ধরেই সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা নিয়ে এগিয়েছে। ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, ইউরোপের মাটিতে জন্ম নেওয়া মরক্কান প্রতিভাদের এক সুতায় গাঁথাই হচ্ছে সেই নীতিমালা। এবারের মরক্কান দলের ২৬ জনের স্কোয়াডে ১৪ জনই ইউরোপ বা বিদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া ফুটবলার। এঁরাই মরক্কোকে হাঁটিয়েছেন অপ্রত্যাশিত সাফল্যের পথে।
স্পেনের বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে টাইব্রেকার ঠেকানো গোলকিপার ইয়াসিন বুনুর জন্ম কানাডায়। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা, ফুটবলার হয়ে ওঠা। এবারের বিশ্বকাপে তিনি গোল খেয়েছেন মাত্র একটি। স্পেনের মাদ্রিদে জন্ম নেওয়া পিএসজি তারকা আশরাফ হাকিমি, দলের বড় তারকাই। নেদারল্যান্ডসে জন্ম নিয়ে মরক্কান জাতীয় দলে খেলতে এসেছেন সোফিয়ান আমরাবাত। তিনি মধ্যমাঠে দলের প্রাণশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। লেফট উইংয়ের ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া সোফিফান বুফাল দলের আক্রমণের অন্যতম চালিকা শক্তি। আরেক তারকা হাকিম জিয়েশও নেদারল্যান্ডসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। চেলসির এই তারকার নেদারল্যান্ডসের কমলা জার্সি পরারই কথা ছিল। সাবেক কোচ রোনাল্ড কোমানের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেছে নেন মাতৃভূমির লাল-সবুজ জার্সি। সোফিফান আমরাবাতের গল্পটাও একই। তাঁরও খেলার কথা ছিল নেদারল্যান্ডস দলেই।
মরক্কান ফুটবলে বড় তারকার সংখ্যা কম নয়। এজাকি বাদু, মেহেদী বেনাতিয়া, আবদেররহমান মাহজুব, সালাহদিন বশির, আবদেল মজিদ দোলমি, আজিজ বৌদার বালা, মোহাম্মদ তিমোনি, আহমেদ ফারাজ, মুস্তাফা হাজি, নুরুদিন নেইবাৎ—কিংবদন্তির সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কিন্তু মরক্কান ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছে, যেহেতু ইউরোপে মরক্কান প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ, তাই সেখান থেকেই প্রতিভা অন্বেষণ করে জাতীয় দলকে শক্তিশালী করা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালিতে প্রতিভা অন্বেষণের বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে সফল তাঁরা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জন্ম নেওয়া, সেখানেই ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠা এবং ইউরোপের শীর্ষ লিগে খেলা প্রতিভাবান ফুটবলারদের মরক্কোর জার্সির প্রতি আকৃষ্ট করতে পারাটাও তাঁদের বড় সাফল্য। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপে ইউরোপে জন্ম নেওয়া খেলোয়াড়দের প্রথম স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করেছিল মরক্কান দল।
ইউরোপে মরক্কোর বিরাট প্রবাসী জনগোষ্ঠী আছে—আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মরক্কো নিজেদের ইউরোপপ্রবাসীদের নিয়ে যে বাড়তি সুবিধা পায় সেটি হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ ইউরোপপ্রবাসীর সঙ্গেই দেশের গভীর যোগাযোগ আছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে মরক্কোর শতকরা ৬১ শতাংশ প্রবাসী, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫, তাঁরা প্রায় প্রতিবছর দেশে বেড়াতে আসেন।
ইউরোপের কোনো ফুটবল-শক্তির নজরে থাকার পরেও মরক্কোর হয়ে খেলার জন্য কেন আগ্রহী হচ্ছেন প্রবাসী ফুটবলাররা। এ ব্যাপারে সোফিয়ান আমরাবাতের মন্তব্য, ‘আমার বাবা-মা মরক্কান। আমি যখন মরক্কোতে বেড়াতে যেতাম, তখন খুব আবেগময় হয়ে পড়তাম। নেদারল্যান্ডসে থাকলেও মরক্কোকে একান্ত নিজের বলেই মনে হতো। নেদারল্যান্ডসও আমার নিজের দেশ, কিন্তু মরক্কো সত্যিই বিশেষ।’
আমরাবাত, হাকিম জিয়েশ দুজনই নেদারল্যান্ডসের জুনিয়র লেভেলে খেলেছেন। এমনকি খেলেছেন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে। এই দুজনের জাতীয় দল হিসেবে মরক্কোকে বেছে নেওয়াটা পুরোপুরি পারিবারিক কারণে।
এখানে একটি প্রসঙ্গ আসতেই পারে, ইউরোপের সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে প্রবাসী ফুটবলাররা কেন মরক্কোর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এ ব্যাপারে নুরুদিন মোকরিম নামের একজন কোচ, যিনি ইউরোপে প্রতিভা অন্বেষণের দায়িত্বে আছেন, তিনি জানিয়েছেন, ‘খুব ছোট থেকেই খেলোয়াড় ও তাদের পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তাদের বোঝাই মরক্কোর হয়ে খেলার মর্যাদার ব্যাপারটি। আমরা কাউকে জোর করি না। দেশের হয়ে খেলার অনুভূতিটা আমরা জাগিয়ে তুলি।’
তবে এই নীতির বিরোধিতাও কম হয়নি। মরক্কোর ভেতরেই প্রবাসী ফুটবলার খেলানোর ব্যাপারে সমালোচনা আছে। কারও কারও মতে, প্রবাসী ফুটবলারদের জাতীয় দলে আনার জন্য মরক্কোতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফুটবলারদের প্রতি কোনো অবিচার করা হচ্ছে কি না, প্রশ্নটা সেটি নিয়েই। তবে মরক্কান ফুটবল ফেডারেশন এ ক্ষেত্রে দেশের বিদেশের সবাইকে এক নিক্তিতে মেপেই দল গঠন করে। প্রতিভা ও কার্যকারিতাকেই মূল মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ব্যাপারে নুরুদিন বলেন, ‘যে খেলোয়াড়টি মরক্কোতে খেলতে আসে ইউরোপ বা প্রবাস থেকে। সে লড়তেই আসে। সে জানে মরক্কোর ভেতরে অনেক প্রতিভা আছে, তাকে সেই প্রতিভাদের সঙ্গেই লড়তে হবে। আমি নিজেও তো ফ্রান্সে জন্মেছি। কিন্তু আমার হৃদয়ে দেশের প্রতি যে ভালোবাসা, সেটি অনেকেরই নেই।’