ট্রেবল জয়ের যে অভিজাত ক্লাবে সিটি
ট্রেবল, ফুটবলের পরিভাষায় এক মৌসুমে তিন ট্রফি।
ইউরোপীয় ট্রেবল জিততে অবশ্য ঘরোয়া লিগের সঙ্গে ঘরোয়া কাপ এবং মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে হয়। ট্রেবল জেতা কত কঠিন এই মুহূর্তে সেটা সবচেয়ে ভালো জানেন পেপ গার্দিওলা। ২০০৮ সালে বার্সেলোনার মূল দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম মৌসুমেই ট্রেবল জিতেছিলেন। এর পর এক বছর বিরতি দিয়ে প্রতিটি বছরই ছিলেন কোনো না কোনো বড় ক্লাবের ডাগআউটে। লিগ জিতেছেন, ঘরোয়া কাপ জিতেছেন, এমনকি চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতেছেন। কিন্তু একসঙ্গে তিনটিই...? বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ আর ম্যানচেস্টার সিটির মতো ক্লাবে থেকেও ২০০৯ সালের পর আর জিততে পারেননি।
গার্দিওলার সেই অপেক্ষার অবসান হয়েছে শনিবার রাতে ইস্তাম্বুলে। আগেই প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ জেতা ম্যানচেস্টার সিটি এ দিন ইন্টার মিলানকে হারিয়ে জেতে চ্যাম্পিয়নস লিগ। গার্দিওলার ক্যারিয়ারে এটি দ্বিতীয় ট্রেবল হলেও ম্যানচেস্টার সিটি ইতিহাসে প্রথম। ইউরোপীয় ফুটবলে ট্রেবলের কীর্তিই হাতে গোনা। সিটির আগে ট্রেবল জিতেছে ৭টি দল। এর মধ্যে বার্সেলোনা ও বায়ার্ন জিতেছে দুবার করে। অর্থাৎ সিটি হচ্ছে ট্রেবলজয়ী অষ্টম ক্লাব আর ইউরোপে দশম ট্রেবলজয়ী দল।
এর আগে কারা কবে কীভাবে ট্রেবল জিতেছিল, সেটিই দেখে নেওয়া যাক এবার।
সেল্টিক: ১৯৬৬-৬৭
তিনটি নয়, সেল্টিক সেবার চারটি ট্রফি জিতেছিল। স্কটিশ লিগের পাশাপাশি স্কটিশ কাপ, স্কটিশ লিগ কাপ এবং ইউরোপিয়ান কাপ। উয়েফা আয়োজিত তখনকার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা ছিল ইউরোপিয়ান কাপ, সেল্টিক ছিল এই টুর্নামেন্টজয়ী প্রথম ব্রিটিশ ক্লাব।
জক স্টেইনের অধীন খেলা সেল্টিক ১৯৬৬-৬৭ মৌসুমের লিগ জেতে রেঞ্জার্সের চেয়ে ৩ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে। একই ক্লাবকে লিগ কাপের ফাইনালে হারায় ১-০ ব্যবধানে। এরপর অ্যাবারডিনকে ২-০ গোলে হারিয়ে নিশ্চিত করে ঘরোয়া ট্রেবল। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ইউরোপিয়ান কাপে।
লিসবনে ফাইনালে সেল্টিকের প্রতিপক্ষ ছিল ইন্টার মিলান। ম্যাচের ৬ মিনিটেই পেনাল্টি থেকে করা গোলে এগিয়ে যায় ইন্টার। ম্যাচ ঘণ্টার কাঁটা পার হওয়ার কিছুক্ষণ পর সমতা আনে সেল্টিক। ৮৪ মিনিটে স্কটিশ ক্লাবটিকে শিরোপা জেতানো গোলটি এনে দেন স্টিভি চালমার।
আয়াক্স: ১৯৭১-৭২
ঠিক আগের বছরই ওয়েম্বলিতে গ্রিক ক্লাব প্যানাথিনাইকোসকে হারিয়ে ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল আয়াক্স। ইয়োহান ক্রুইফের দল ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতার ট্রফি জিতেছে পরের বছরেও। তবে মাঝের ১৯৭১-৭২ মৌসুমটাই আয়াক্স ইতিহাসে বেশি স্মরণীয়। ডাচ ক্লাবটির জেতা একমাত্র ট্রেবল এসেছিল এ মৌসুমেই।
প্রথমে মুঠোয় আসে ডাচ লিগ এরেডিভিসির শিরোপা। মৌসুমের সর্বশেষ ২৭ ম্যাচের ২৬টিতে জিতে দাপটের সঙ্গে লিগ জেতে স্টেফান কোভাচের দল। এফসি ডেন হাগকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে আসে কেএনভিবি কাপের ট্রফি।
ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল সেল্টিকের মতোই, ইন্টার মিলান। ফেইনুর্ডের দি কুইপ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে অবশ্য জিততে কোনো বেগই পেতে হয়নি আয়াক্সকে। ক্রুইফের জোড়া গোলের সুবাদে ২-০ ব্যবধানে জিতে ট্রেবল জয় করে আয়াক্স।
পিএসভি আইন্দহোফেন: ১৯৮৭-৮৮
আয়াক্সের ১৬ বছর পর দ্বিতীয় ডাচ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয় করে পিএসভি আইন্দহোফেন। গাস হিডিঙ্কের দল লিগ জেতে আয়াক্সের চেয়ে ৯ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে। কাপ জেতে রোদা জেসিকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে। তবে ঘরোয়া দুই লিগের মতো আয়েশি জয় আসেনি ইউরোপিয়ান কাপে।
দ্বিতীয় রাউন্ড বাদে নকআউট পর্বের কোনো ম্যাচেই ৯০ মিনিটের মধ্যে জিততে পারেনি পিএসভি। কোয়ার্টার ফাইনালে বোর্দো আর সেমিফাইনাল রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে জয় এসেছিল অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে। দুটি পর্বেই ঘরের মাঠে ০-০ স্কোরলাইনের আগে প্রতিপক্ষের মাঠে ১-১ ড্র করে আসে তারা।
এরপর ফাইনালেও সরাসরি জিততে পারেনি পিএসভি। স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল বেনফিকা। ১২০ মিনিটের খেলা গোলশূন্য স্কোরলাইনে শেষ হওয়ার পর পেনাল্টিতে ৬-৫ ব্যবধানে জেতে তারা।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড: ১৯৯৮-৯৯
১৯৯২ সালে প্রিমিয়ার লিগ শুরুর পর থেকেই দাপট দেখিয়ে আসছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্য পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৯ পর্যন্ত। সেবার আর্সেনালের চেয়ে এক পয়েন্ট এগিয়ে থেকে প্রিমিয়ার লিগ জেতে ইউনাইটেড, আর এফএ কাপ জেতে নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে।
চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল বায়ার্ন মিউনিখ। মৌসুমজুড়ে ইউনাইটেডের আক্রমণভাগের নেতা অ্যান্ড্রু কোল আর ডোয়াইট ইয়র্কে হলেও ফাইনালে নায়ক হয়ে ওঠেন টেডি শেরিংহাম ও ওলে গুনার সুলশার।
বার্সেলোনার ক্যাম্প ন্যুতে অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে ৬ মিনিটেই মারিও বাসলারের গোলে এগিয়ে যায় বায়ার্ন। এই ১-০ ব্যবধান পূর্ণ হয়ে ৯০ মিনিটও। তবে যোগ করা সময়ে ৯১তম মিনিটে শেরিংহাম আর ৯৩তম মিনিটে শোলসার গোল করে ইউনাইটেডকে এনে দেন ২-১ ব্যবধানের নাটকীয় জয়। প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জেতে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের দল।
বার্সেলোনা: ২০০৮-০৯
বার্সেলোনার মূল দলের কোচ হিসেবে এটি ছিল পেপ গার্দিওলার প্রথম মৌসুম। আগের বছর লা লিগায় তৃতীয় হওয়া বার্সা এবার প্রথম ম্যাচেই হেরে বসে নুমানসিয়ার কাছে। তবে ধীরে ধীরে গুছিয়ে উঠে শেষ পর্যন্ত সহজেই শিরোপা জেতে বার্সা। মৌসুম শেষে দ্বিতীয় স্থানে থাকা রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে এগিয়ে থাকে ৯ পয়েন্টে।
ক্যাম্প ন্যুতে দ্বিতীয় ট্রফি আসে কোপা দেল রে ফাইনালে অ্যাথলেটিক বিলবাওকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে।
তৃতীয় কোয়ালিফাইং রাউন্ড দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ শুরু করা গার্দিওলার দল সেমিফাইনালে চেলসিকে হারিয়ে ফাইনালে পায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। রোমে অনুষ্ঠিত ফাইনালে স্যামুয়েল ইতো ও লিওনেল মেসির গোলে ২-০ ব্যবধানে জেতে বার্সা। ট্রেবল জয় দিয়ে শুরু হয় বার্সায় গার্দিওলার ‘ড্রিম টিমে’র যাত্রা।
ইন্টার মিলান: ২০০৯-১০
বার্সেলোনার ট্রেবল জয়ের পরের বছরই দেখা মেলে আরেকটি ট্রেবলের। এবার ইন্টার মিলান। মজার বিষয় হচ্ছে, ট্রেবল জয়ের পথে বার্সেলোনাকেও হারায় জোসে মরিনিওর দল। ইন্টার সেবার সিরি আ জেতে রোমার চেয়ে ২ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে। কোপা ইতালিয়া জেতে সেই রোমাকেই ১-০ গোলে হারিয়ে।
গ্রুপ পর্বে বার্সেলোনার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও চেলসি ও সিএসকেএ মস্কোকে হারিয়ে জায়গা করে শেষ চারে, যেখানে আবারও দেখা বার্সেলোনার সঙ্গে। ক্যাম্প ন্যুতে ১-০ ব্যবধানে হারলেও গার্দিওলার দলকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ইন্টার।
রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাবুতে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ৩৫ মিনিটে ইন্টারকে এগিয়ে দেন দিয়েগো মিলিতাও। দ্বিতীয়ার্ধে মিলিতাওই আরেকটি গোল করলে বায়ার্নের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানের জয় পায় জোসে মরিনিওর দল, যা ১৯৬৫ সালের পর ইন্টার মিলানের প্রথম ইউরোপিয়ান শিরোপা।
বায়ার্ন মিউনিখ: ২০১২-১৩
এই মৌসুমের বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখ ছিল দুর্দান্ত ছন্দে। পুরো মৌসুমে মাত্র ১টি লিগ ম্যাচ হারে ইয়ুপ হেইঙ্কসের দল। লিগ জেতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডর্টমুন্ডের চেয়ে ২৫ এগিয়ে থেকে, মোট ৯১ পয়েন্ট নিয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে অবশ্য চিত্রটা ভিন্ন ছিল। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অল-জার্মান ফাইনালে মুখোমুখি হয় বায়ার্ন-ডর্টমুন্ড।
ম্যাচের ৬০ মিনিটে বায়ার্নকে এগিয়ে দেন মারিও মানজুকিচ, যা ৮ মিনিট বাদেই পেনাল্টি গোলে শোধ দেন ডর্টমুন্ডের ইলকায় গুনদোয়ান। পরে ৮৯তম মিনিটে আরিয়েন রোবেন গোল করে বায়ার্নকে ২-১ ব্যবধানে শিরোপা নিশ্চিত করে দেন। এর এক সপ্তাহ পর জার্মান কাপের ফাইনালে স্টুটগার্টকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে জার্মানির হয়ে প্রথম ট্রেবল জেতে বায়ার্ন।
বার্সেলোনা: ২০১৪-১৫
বার্সেলোনার আক্রমণভাগে তখন মেসি, নেইমার ও সুয়ারেজ। মাঝমাঠে জাভি হার্নান্দেজ ও আন্দ্রে ইনিয়েস্তা। পরীক্ষিত ও অভিজ্ঞ এই খেলোয়াড়দের ওপর ভর করে মৌসুমজুড়েই দুর্দান্ত ছন্দে ছিল বার্সেলোনা। মেসি, নেইমার, সুয়ারেজ—এ তিনজনই করেন ১২২ গোল, যার মধ্যে মেসির একারই ৫৮। অবশ্য ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, করিম বেনজেমা আর গ্যারেথ বেলে গড়া রিয়াল মাদ্রিদও লিগে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত ৯৪ পয়েন্ট তুলেও মাত্র ২ পয়েন্ট ব্যবধানে লা লিগা জেতে বার্সা।
কোপা দেল রে ফাইনালে বিলবাওকে অবশ্য সহজেই ৩-১ ব্যবধানে হারায় লুইস এনরিকের দল। বার্লিনে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে বার্সেলোনার প্রতিপক্ষ ছিল জুভেন্টাস। ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই বার্সেলোনাকে এগিয়ে দেন ইভান রাকিতিচ, যা ৫৫ মিনিটে শোধ করে দেন আলভারো মোরাতা। তবে ৬৮তম মিনিটে সুয়ারেজ ও ৯৭তম নেইমারের দুই গোলের সুবাদে শেষ পর্যন্ত ৩-১ ব্যবধানে শিরোপা নিশ্চিত করে বার্সা। গড়ে প্রথম ক্লাব হিসেবে দুটি ট্রেবল জয়ের রেকর্ড।
বায়ার্ন মিউনিখ: ২০১৯-২০
বায়ার্নের এই ট্রেবল জয়ে আছে দর্শকের সঙ্গে উদ্যাপন করতে না পারার দুঃখ। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারির কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যায়, পরে শুরু হলেও স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে দর্শকবিহীন। গ্যালারির সামনেই ডর্টমুন্ডের চেয়ে ১৩ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে বুন্দেসলিগা জেতে বায়ার্ন। হান্সি ফ্লিকের দলটি জার্মান কাপ জেতে বায়ার লেভারকুসেনকে ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে।
মহামারির কারণে বিশেষ সতর্কতায় আয়োজিত এ বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ তিন রাউন্ড ছিল এক লেগের। যেখানে কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সেলোনাকে ৮-২ আর সেমিফাইনালে লিওঁকে ৩-০ ব্যবধানে ফাইনালে ওঠে বায়ার্ন। শিরোপা নির্ধারণীতে প্রতিপক্ষ ছিল পিএসজি। ৫৯ মিনিটে ফরাসি ফরোয়ার্ড কিংসলি কোমানের দেওয়া গোলে ১-০ ব্যবধানে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে বায়ার্ন, জেতে দ্বিতীয় ট্রেবলও।