সে যুগে পেলে–ম্যারাডোনা, এ যুগে জাভি–ইনিয়েস্তা—ব্যালন ডি’অর জেতেননি যে তারকারা

ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও পেলে কখনোই ব্যালন ডি’অর জেতেননিএএফপি

সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে, সেটা নিয়ে তর্কবিতর্ক হতে পারে অনেক। কেউ পেলেকে বেছে নেন, কারও পছন্দ আবার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কারও পছন্দের শীর্ষে লিওনেল মেসি, কেউ আবার বলতে পারেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথা। এমনকি ইয়োহান ক্রুইফ, জিনেদিন জিদান কিংবা রোনালদো নাজারিওর নামও যদি কেউ নেন, সেটা বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নয়। ব্যক্তিগত পছন্দের নিরিখেই মূলত নির্ধারিত হয় এই শ্রেষ্ঠত্ব।

তবে কেউ চাইলে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে বলতে পারেন ব্যালন ডি’অরের কথা। প্রতিবছর ফুটবলে ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক তো এটিই। এই ট্রফি হাতে উঁচিয়ে ধরাই তো অনেক ফুটবলারের আরাধ্য। তাহলে তো হিসাব সহজই হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি’অর যিনি জিতেছেন, তাঁকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে দিলেই তো হয়। কিন্তু এখানেও কথা আছে, বিশাল এক ফাঁকিও আছে। ফলে ব্যালন ডি’অর দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব মেপে নেওয়ার বিপদও আছে।

আরও পড়ুন

সর্বকালের সেরা কে হবেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেরা পাঁচে যে পেলে ও ম্যারাডোনা থাকবেন, তা নিশ্চিত। কিন্তু তাঁরা দুজন যে কখনো ব্যালন ডি’অর জেতেননি। পেলে ব্রাজিলের হয়ে তিনবার বিশ্বকাপ জিতেও হাতে তুলতে পারেনি এই পুরস্কার।

আর ম্যারাডোনা ১৯৮৬ সালে এককভাবে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতিয়েও এবং অখ্যাত নাপোলিকে শিরোপা এনে দিয়েও পারেননি ব্যালন ডি’অর জিততে। এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র বা কূটচাল খোঁজার সুযোগ নেই। সে সময় যে মানদণ্ডে ব্যালন ডি’অর দেওয়া হতো, তাতে এই পুরস্কার জয়ের শর্তগুলো পূরণের সুযোগ ছিল দুই কিংবদন্তির।

ব্যালন ডি’অর পুরস্কারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৬ সাল থেকে। কয়েক দশক ধরে এর পরিচিতি ছিল ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার হিসেবে। অর্থাৎ শুধু ইউরোপিয়ান ফুটবলাররাই এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন। ১৯৯৫ সালে পরিবর্তন হয় নিয়মের। তখন থেকে নন–ইউরোপিয়ান ফুটবলার, যিনি ইউরোপের ক্লাবে খেলেন, তিনিও এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য বিবেচিত হন। ২০০৭ সালে এসে ব্যালন ডি’অর বৈশ্বিক রূপ লাভ করে এবং পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের পেশাদার ফুটবলারকে এই পুরস্কার জয়ের আওতায় নিয়ে আসার হয়।

সতীর্থ মেসির কারণে একাধিবকার ব্যালন ডি’অর বঞ্চিত হয়েছেন ইনিয়েস্তা ও জাভি
এএফপি

মূলত নিয়মের এই ফাঁদেই পেলে ও ম্যারাডোনার ব্যালন ডি’অর জেতা হয়নি। দুজনই দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলার। এর মধ্যে পেলে তো কখনো ইউরোপে খেলেনওনি। তবে নিয়মের কারণে এই দুজনর ব্যালন ডি’অর না পাওয়া পুরস্কারটিরই দুর্ভাগ্য। আবার শুধু নিয়মের জন্যই যে সেরা তারকারা ব্যালন ডি’অর পাননি, এমন নয়; যোগ্য হওয়ার পরও কঠিন প্রতিযোগিতা ও খানিকটা দুর্ভাগ্যের জন্যও পুরস্কারটি না পাওয়া খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কম নয়।

আরও পড়ুন

সে তালিকায় যাওয়ার আগে পেলেকে দিয়েই শুরু করা যাক। ফুটবলের মহাকাশে পেলের আবির্ভাব ঘটেছিল উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে। তাঁকে ফুটবলের প্রথম বৈশ্বিক তারকাও বিবেচনা করা হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন পেলে। এরপর ১৯৬২ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপও জেতেন। কিন্তু সে সময় শুধু নন–ইউরোপিয়ান হওয়ার কারণে ব্যালন ডি’অর নেওয়ার জন্য মঞ্চে ওঠা হয়নি তাঁর। এক হিসাবে দেখা গেছে, যদি সে সময় পেলে ব্যালন ডি’অর জয়ের জন্য বিবেচিত হতেন, তবে তিনি অন্তত ৭ বার এই ট্রফি জিততে পারতেন।

পেলের মতো একই কারণে ব্যালন ডি’অর জেতা হয়নি ম্যারাডোনারও। ধারণা করা হয়, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালে নন–ইউরোপিয়ান কোনো ফুটবলার যদি ব্যালন ডি’অরের জেতার জন্য বিবেচিত হতেন, তবে ম্যারাডোনার হাতেই উঠত সেই পুরস্কার। এ ছাড়া ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালেও ব্যালন ডি’অর জয়ের দাবিদার ছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।
ব্যালন ডি’অর যখন যাত্রা শুরু করে, তখন ক্যারিয়ারের চূড়ায় ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাস।

আরও পড়ুন

১৯৫০–এর দশকে হাঙ্গেরির ফুটবলকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান পুসকাস। সে সময় টানা ৩২ ম্যাচে অপরাজিত ছিল দলটি। কিন্তু এরপরও বিশ্বকাপ জেতা হয়নি হাঙ্গেরির। বলা হয়, বিশ্বকাপ না জেতা দলগুলোর মধ্যে সর্বকালের সেরা দল হচ্ছে সে সময়ের হাঙ্গেরি। বিশ্বকাপ না জেতা এবং রাজনৈতিক কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পুসকাসের ক্যারিয়ার। এরপরও সে সময়ে একাধিকবার এই পুরস্কার জেতার যোগ্য দাবিদার ছিলেন পুসকাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর জেতা হয়নি। ধারণা করা হয়, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে এই পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা ছিল পুসকাসের।

ফেরেঙ্ক পুসকাস কখনোই ব্যালন ডি’অর জেতেননি
এক্স

বর্তমান সময়ে যে দুজন ফুটবলার ব্যালন ডি’অরের খুব কাছাকাছি গিয়েও পুরস্কারটি জিততে পারেননি, তাঁরা হলেন জাভি ও ইনিয়েস্তা। সাবেক দুই স্প্যানিশ মিডফিল্ডার একাধিকবার ব্যালন ডি’অর জয়ের দাবিদার ছিলেন। বিশেষ করে ২০১০ সালে স্পেন বিশ্বকাপ জেতার পর অনেকের ধারণা ছিল বিশ্বকাপজুড়ে দুর্দান্ত খেলা এবং ফাইনালে গোল করা ইনিয়েস্তাই হয়তো এই পুরস্কার জিতবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্য খোলেনি। জেতা হয়নি এ পুরস্কার। একইভাবে জাভির ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে ইনিয়েস্তার মতো ব্যালন ডি’অর জেতার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মেসির কারণে সে সময় হতাশা নিয়েই থাকতে হয়েছে এ দুজনকে।

আরও পড়ুন

এই তারকারা ছাড়াও অন্যদের মধ্যে যাঁরা ব্যালন ডি’অর জেতার যোগ্যও হয়েও জিততে পারেননি, তাঁরা হলেন পাওলো মালদিনি, ডেভিড বেকহাম, রোমারিও, থিয়েরি অঁরি, রবার্ট লেভানডফস্কি, অ্যালেন শিয়ারার, নেইমার, ওয়েইন রুনি, ইয়ান রাশ, জিকো, জিয়ানলুইজি বুফন, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, স্টিভেন জেরার্ড, জন চার্লস, রবার্তো কার্লোস, ফ্রাঙ্কা রাইকার্ড ও ফ্রান্সিসকো টট্টি। তাঁদের প্রত্যেকেই ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো পর্যায়ে ব্যালন ডি’অর জেতার দাবিদার ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিততে পারেননি।