উড়ছে সৌদির ‘টেকা পাখি’, গোল নয়, হিসাব হচ্ছে টাকার
‘টেকা ও পাখি তুমি/ উইড়া উইড়া আসো/ উইড়া-উইড়া আইসা তুমি/ আমার ডালে বসো।’
কথাগুলো সম্প্রতি জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘টেকা পাখি’ নামের এক বাংলা গান থেকে নেওয়া। গানটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির ওয়েব সিরিজ ‘দুই দিনের দুনিয়া’তে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান সময়ের বিশ্বসেরা ফুটবলারদের এই বাংলা গানটি শোনার কথা নয়। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে গানের কথাগুলো যেন ফুটবলের সেরা তারকাদের মানসিক অবস্থারই প্রতিচ্ছবি। তাঁদের চারপাশে এখন ‘টেকা পাখি’ উড়ছে। হাত বাড়ালেই সেই টাকা ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। তাঁরাও ধরছেন, ছুঁয়েও দেখছেন।
কে জানে, কেউ কেউ টাকার বিছানা বানিয়ে শুয়েছেন কি না! এত টাকার ছড়াছড়ি যে কেউ এমনটা করলে তা মোটেই অবাক হওয়ার মতো কিছু না। এমন না যে শীর্ষ ফুটবলারদের কখনো টাকার কমতি ছিল। কিন্তু ফুটবলমঞ্চে সৌদি আরবের উত্থানের পর যা ঘটছে, তা নজিরবিহীন।
টাকা নিয়ে যেসব প্রবাদ-প্রবচন এত দিন শোনা যেত, সেগুলোই এখন বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে। টাকার কাছে এখন অনেক ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে পড়েছে ফুটবলীয় মর্যাদা এবং অর্জনগুলো। টাকা গুনতে গুনতে এবং হিসাব কষতে কষতে এমন অবস্থা যে লোকে যেন ফুটবলের আসল লক্ষ্য ‘গোল’-এর কথা ভুলেই গেছে! এমনকি সেই টাকার হিসাব রাখতে গিয়ে নাকাল হচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলোও। কীভাবে? একটু পরেই বলছি।
‘টাকার নেশা বড় নেশা’ এমন একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। ফুটবল-দুনিয়া এখন সে নেশায় মত্ত। একটা সময় ছিল যখন ফুটবলাররা রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ বা লিভারপুলের মতো ক্লাবে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত, আর এখন নামী এই ক্লাবগুলোর বদলে অনেকের স্বপ্নে ধরা দিচ্ছে সৌদি প্রো লিগের ছবি। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে টাকার ছবি। আসলে বেশির ভাগ টাকা যে উড়ছে সেই মরু-স্বর্গে। অবশ্য এ জন্য পুরো দোষটা সৌদির ঘাড়ে চাপানোরও সুযোগ নেই। ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি এবং পিএসজির মতো ক্লাবগুলো এই কাজ আগেই শুরু করেছিল। লিওনেল মেসিকে বড় অঙ্কের বেতন দিচ্ছে ইন্টার মায়ামিও।
বাস্তবতা হচ্ছে, সৌদি ফুটবলে এমন কোনো আবেগ, অনুভূতি, মর্যাদা কিংবা ঐতিহ্যে ভরপুর আরব্য রজনীর রূপকথার গল্প নেই যে সব ছেড়েছুড়ে সেখানেই যেতে হবে। নেইমাররা যে এখন ফুটবলের নতুন দিগন্তের উন্মোচনের কথা বলছেন, তার পেছনে পুরো প্রণোদনাটাই মূলত টাকার। গতকাল রাতেই লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ বলেছেন, ‘সীমাহীন অর্থ সমস্যা তৈরি করে।’ সত্যি কথা হচ্ছে, সৌদি ধনকুবেরদের ফুটবলের প্রতি এমন দুর্নিবার আগ্রহ ইউরোপের ক্লাবগুলোর জন্য বড় সমস্যায় তৈরি করেছে। তাদের ফেলেছে অস্তিত্বসংকটেও। যদিও ফুটবলে মধ্যপ্রাচ্যের টাকা ওড়ার গল্পটা খুব বেশি দিন আগের নয়।
ফুটবলে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেরদের আধিপত্যের শুরুটা হয়েছিল দেড়-দুই দশক আগে। কিন্তু একাধিক ক্লাবের মালিকানাতেই যেন তাদের মন ভরল না। এবার তারা একটা লিগকে গোটা ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। টাকার থলে নিয়ে খেলোয়াড় কুড়ানোর যে লক্ষ্যে তারা মাঠে নেমেছে, তাতে প্রাথমিকভাবে তারা অনেকটাই সফল। ক্লাবগুলো হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মতো বাঁশি হাতে যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, আর তাদের পেছনে হাঁটা শুরু করেছে ফুটবলাররাও। চূড়ান্ত গন্তব্য সম্ভবত কেউ জানে না, না ক্লাবগুলো, না খেলোয়াড়েরা। তাঁরা শুধু টাকার ঘ্রাণে মগ্ন হয়ে ছুটে চলছে। যার ফলাফল বিশ্বের শীর্ষ ১০ বেতনধারীর ৮ জনই সৌদি ক্লাবের। যেখানে শীর্ষ তিন খেলোয়াড় আবার রোনালদো, বেনজেমা ও নেইমার।
আর খেলোয়াড়দের এই উড়ন্ত টাকার হিসাব রাখতে গিয়ে নাকাল হচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলো। মিলছে না শূন্যের হিসাবও। ফলত ঘটছে বিভ্রাটও। একই সংবাদমাধ্যমে একজন খেলোয়াড়ের আলাদা বেতনের কথা লেখা হচ্ছে। এই তো সম্প্রতি স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এএসের দুটি নিউজে মেসির দুই রকম বেতনের কথা লেখা হয়েছে। একটিতে লেখা হয়েছে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার, আবার একই প্রতিবেদকের আরেকটি নিউজে লেখা হয়েছে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এটি একটি উদাহরণমাত্র। অর্থের পরিমাণ নিয়ে এই বিভ্রাট খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যাবে।
পাঠক নিজেও হয়তো প্রথম আলোর একাধিক প্রতিবেদনে একজন খেলোয়াড়ের আলাদা বেতন দেখে থাকবেন। মূলত যেসব উৎস ব্যবহার করে সংবাদটি করা হচ্ছে, সেগুলোতেই রয়েছে ভিন্নতা, যা তৈরি করছে বিভ্রাট। তবে ফুটবলারদের ট্রান্সফার ফির চেয়ে বেতনে এই বিভ্রান্তি বেশি ঘটছে। সাধারণত খেলোয়াড়দের বেচাকেনার মূল্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলেও বেতনের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা গোপন রাখা হয়। সংবাদমাধ্যমগুলো নিজস্ব সূত্র ব্যবহার করে দামটা বের করে আনে। যেহেতু তারা আলাদা সূত্রের মাধ্যমে বেতনটা জেনে নিচ্ছে, তাই অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে তারতম্য, ফলে তৈরি হচ্ছে এই বিভ্রান্তি।
অন্যদিকে বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে ইউরো, ডলার এবং পাউন্ডসংক্রান্ত জটিলতার কারণে। ইউরোপীয় বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম দাম লিখছে ইউরোতে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের অনেকেই লিখছে পাউন্ডে, আর মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো লিখছে ডলারে। যেহেতু মানের ভিন্নতা আছে, তাই বদলে যাচ্ছে সংখ্যাও। এর ফলেও তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। আর এসব সংখ্যাকে টাকায় রূপান্তর করে লেখারও কিন্তু যন্ত্রণা আছে। শেষে গিয়ে এত শূন্য বসাতে হবে যে কড় গুনেও কূল পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, টাকার যে খেলা শুরু হয়েছে, এর শেষ কোথায়। এর উত্তর সম্ভবত কেউই জানে না। করোনা মহামারিতে যখন একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছিলেন, তখন কেউ কেউ বলেছিলেন, ফুটবলারদের পেছনে এত টাকা খরচ না করে যদি স্বাস্থ্য খাত ও গবেষণায় খরচ করা হতো, তবে এমন পরিস্থিতি হতো না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সেই ঘটনা থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। উল্টো তিন বছরের মধ্যে অকল্পনীয় এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
রোমান দার্শনিক সেনেকা বলেছিলেন, ‘যে লোকের কম আছে, সে দরিদ্র নয়, যে অধিক চায়, সেই মূলত দরিদ্র।’ এই নীতিবাক্য এখন কে শোনে! নয় তো প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক তলস্তয়ের ‘একজন মানুষের কত জমি দরকার’ গল্পটা তো সবারই পড়া। পাখোম নামের এক ব্যক্তিকে বলা হয়েছিল, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যত দূর হেঁটে আসতে পারবে সে জমি তার। জমির লোভে হাঁটতে হাঁটতে ফেরার কথা ভুলে যায় সে।
আর যখন হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল ততক্ষণে সব শেষ। মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মারা যায় সে। অর্থের প্রতি সীমাহীন টান ফুটবলারদের প্রতীকী অর্থে ‘পাখোমে’ পরিণত করছে কি না, এই প্রশ্নও চাইলে তোলা যায়। গোলের হিসাবের চেয়ে টাকার হিসাবটা যখন বড় হয়ে উঠেছে, তখন এমন আশঙ্কা কি সত্যিই অমূলক?