হলান্ড-এমবাপ্পে দ্বৈরথে মেসি-রোনালদোর খোঁজ
প্যারিস থেকে সেভিয়ার দূরত্ব প্রায় ১৪৪২ কিলোমিটার। ইউরোপের এই দুই শহরে গতকাল রাতে আলাদা ম্যাচে মাঠে নেমেছিল প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি) ও ম্যানচেস্টার সিটি। চ্যাম্পিয়নস লিগে ভিন্ন গ্রুপে পড়ায় এক দলের খেলা নিয়ে অন্য দলের খুব একটা আগ্রহ থাকার কথা ছিল না। এরপরও দুই দলের আলাদা লড়াইয়ে লুকিয়ে ছিল প্রচ্ছন্ন এক দ্বৈরথ।
এই দ্বৈরথ দুই দলের দুই তরুণ খেলোয়াড়ের। যেখানে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অন্য এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিলিয়ান এমবাপ্পে ও আর্লিং হলান্ড। যাদের মাঝে ইউরোপীয় ফুটবলে হারিয়ে যেতে বসা মেসি–রোনালদোর দ্বৈরথও খুঁজে নিতে চাইছেন অনেকে। এমনকি দুজনের তুলনামূলক সামর্থ্য নিয়েও তির্যক মন্তব্য ছুড়তে শুরু করেছেন ফুটবল বিশ্লেষকেরা।
ফুটবল মঞ্চে হলান্ডের নিজেকে চেনানোর সময়কালটা সাম্প্রতিক হলেও এমবাপ্পে নিজেকে চিনিয়েছেন ৪ বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে। উদীয়মান তারকা হিসেবে ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতার পথে দারুণ অবদান রেখেছিলেন এমবাপ্পে। তবে সময় এখন দুজনকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে।
ফুটবল মঞ্চে এখন শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে একে অপরের মুখোমুখি হচ্ছেন হলান্ড ও এমবাপ্পে। যেখানে তাঁদের দ্বৈরথকে মেসি–রোনালদোর লম্বা সময় ধরে চলতে থাকা দ্বৈরথের বিকল্প হিসেবে দেখছেন অনেকে। এমবাপ্পে–হলান্ড আসলেই মেসি–রোনালদোর বিকল্প হতে পারবেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতেই তোলা রইল।
তবে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে দুজনেরই মনোভাব যেন, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।’ নিজেদের পাওনাটুকু বুঝে নিতে যে হাল ছাড়বেন না, সে ইঙ্গিতও ইতিমধ্যে দিয়েছেন তাঁরা। এ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম ম্যাচেই জোড়া গোল করে নিজ নিজ দলকেও জিতিয়েছেন এমবাপ্পে–হলান্ড।
মেসি না রোনালদো কে সেরা—দুই দশক ধরে এই বিতর্কই ছিল ফুটবলের অন৵তম আলোচিত বিষয়। মধ্য ত্রিশে থাকা এই দুই ফুটবল মহাতারকা পরিসংখ্যানেও একে অপরকে সমানতালে টেক্কা দিয়েছেন। কোথাও মেসির দাপট তো আবার কোথাও রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্ব। নিজেদের এই দ্বৈরথে দীর্ঘ সময় কাউকেই ঘেঁষতেই দেননি এই দুজন। এমন দুই মহাতারকার জায়গা নেওয়া তাই শুধুই কঠিনই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভবও বটে। তবু একটি প্রজন্মের বিদায়বেলায় পরের প্রজন্মের দিকে হাত বাড়াতেই হয়। খোঁজ করতে হয় নতুন কোনো নক্ষত্রের। আর এই জায়গাটিতেই নিজেদের প্রতিভাসমেত উঁকি দিচ্ছেন এমবাপ্পে ও হলান্ড। যাঁরা দুই মৌসুম ধরে দুর্দান্ত ছন্দে আছেন। ২০২০–২১ মৌসুমে এমবাপ্পে যেখানে পিএসজির হয়ে ৪২ গোল করেছেন, সেখানে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে হলান্ড লক্ষ্যভেদ করেছেন ৪১ বার।
গত মৌসুম পর্যন্ত অবশ্য দুজনের লড়াইটা এতটা প্রকট ছিল না। হলান্ডের দল ডর্টমুন্ড সেই অর্থে বুন্দেসলিগা এবং চ্যাম্পিয়নস লিগে ফেবারিট ছিল না। তাই বড় শিরোপা জেতার চাপও ছিল না হলান্ডের ওপর। তবে এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এমবাপ্পে যেখানে পিএসিজকে নিয়ে শিরোপা অভিযানে, সেখানে হলান্ডের লক্ষ্য প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা ধরে রাখার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথম শিরোপা জেতার। দুজনের দলই অপেক্ষায় আছে প্রথমবারের মতো ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব জেতার। যেখানে নিজ নিজ দলের তুরুপের তাস হবেন তাঁরা।
এমবাপ্পে–হলান্ড দুজনই নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন একই সময়ে। ২০১৫–১৬ মৌসুমে লিগ ওয়ানের ক্লাব এএস মোনাকোর হয়ে যাত্রা শুরু করেন ২৩ বছর বয়সী এমবাপ্পে, আর ২২ বছর বয়সী হলান্ড খেলা শুরু করেন নরওয়েজীয় ক্লাব ব্রাইন এফকের হয়ে। ফরাসি তারকা এমবাপ্পে সবচেয়ে বেশি ৪২ গোল করেছেন ২০২০–২১ মৌসুমে। আর হলান্ডের সবচেয়ে বেশি গোল করা মৌসুম ছিল ২০১৯–২০। যেবার তিনি গোল করেছেন ৪৪টি। তবে গোলের পরিসংখ্যানে এ দুজনের সামর্থ্যকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। নিজ নিজ দলে নিজেদের শক্তিশালী জায়গা তৈরি করেছেন তাঁরা। যদিও কাজটা একেবারেই সহজ ছিল না।
এমবাপ্পের নিজের দলেই আছেন মেসি ও নেইমারের মতো অন্যতম দু্ই সেরা তারকা। এ দুজনের ছায়া থেকে বেরিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করতে হচ্ছে তাঁকে। ম্যাচের পর ম্যাচ গোল করার পাশাপাশি প্লে মেকিংয়েও দক্ষতা দেখাচ্ছেন এই ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ড। চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে কম বয়সে (২৩ বছর ২৬০ দিন) ৩৫ গোল করার মালিকও এমবাপ্পে। যেখানে তিনি পেছনে ফেলেছিলেন মেসিকে (২৩ বছর ৩০৭ দিন)। আর হলান্ড কেবলই ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলতে গেছেন। যেখানে কেভিন ডি ব্রুইন, বের্নার্দো সিলভাসহ একাধিক পরীক্ষিত তারকা ফুটবলারের মাঝে নিজেকে চেনাতে হচ্ছে তাঁকে।
তবে কোনো চ্যালেঞ্জই যে তাঁর কঠিন নয়, সে প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছেন হলান্ড। চ্যাম্পিয়নস লিগে সব মিলিয়ে এখন ২০ ম্যাচ খেলে ২৫ গোল করেছেন হলান্ড। এত কম ম্যাচ খেলে ২৫ গোল আর কেউই করতে পারেননি। প্রিমিয়ার লিগে চলতি মৌসুমে ইতিমধ্যে ৬ ম্যাচে ১০ গোল করেছেন করেছেন হলান্ড। সিটির এই গোলমেশিন লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে দেন কি না, সেই সম্ভাবনাও দেখতে শুরু করেছেন অনেকে।
মাঠে দুজনের কৌশলগত দিক থেকেও শুরু হয়েছে তুলনা। এমবাপ্পে বরাবরই গতিময় ফুটবলে প্রতিপক্ষকে নাকাল করে অভ্যস্ত। যেখানে হলান্ডের মূল কাজটা স্কোরিংয়ের। তবে পরিসংখ্যানে একে অন্যের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন। এ মৌসুমে লিগে এখন পর্যন্ত ১৭ শটে ৭ গোল করেছেন এমবাপ্পে। রূপান্তর হার ৬৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২৩টি বড় সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। বিপরীতে হলান্ড ১৫ শটে করেছেন ১০ গোল। তাঁর রূপান্তর হার ৬৮ শতাংশ। এমবাপ্পের মতো তিনিও ২৩টি উল্লেখযোগ্য সুযোগ তৈরি করেছেন। এখন পর্যন্ত হলান্ড একটি গোলে সহায়তা করলেও এমবাপ্পে কোনো সহায়তা করতে পারেননি। তবে দুজনই সমান ৯টি গুরুত্বপূর্ণ পাস দিয়েছেন। আর বক্সের ভেতর এমবাপ্পের পাস সম্পূর্ণ করার হার ৬৮ শতাংশ। যেখানে হলান্ডের পাস সম্পূর্ণ করার হার ৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে একে অপরের দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সব রসদ এই পরিসংখ্যানেই রাখা আছে।
এমবাপ্পে–হলান্ডের দ্বৈরথ নিয়ে শুরু হয়েছে কথার লড়াইও। ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরি বলেছেন, এখনো তিনি হলান্ডের চেয়ে এমবাপ্পেকে এগিয়ে রাখবেন। খেলোয়াড় হিসেবে এমবাপ্পেকে অধিক পরিণত মনে হয় তাঁর। অঁরি বলেছেন, ‘এমবাপ্পে গোল বানাতেও পারে এবং করতেও পারে। হলান্ড গোল বানাতে পারে না। সে শুধু গোল করতে পারে। এমবাপ্পে বাঁ, ডান ও মাঝে খেলতে পারে। আর হলান্ড কেবল মাঝে খেলতে পারে।’
অঁরির প্রশ্নের জবাবটা অবশ্য সেভিয়া ম্যাচ শেষে দেওয়া ডি ব্রুইনের সাক্ষাৎকারেই পাওয়া যাবে। সিটির এই বেলজিয়ান মিডফিল্ডার বলেছেন, ‘আমার মনে হয় যেভাবে সে আমাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তা সত্যিই দারুণ। তবে গোল করা ছাড়াও খেলার আরেকটা দিক থাকে এবং সেখানে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। আপনি যদি এত বেশি গোল করেন, তবে সেসব এড়িয়ে যেতে পারবেন। সে যদি গোল করা অব্যাহত রাখে, তবে সেটা আমাদের জন্য ইতিবাচক।’ এটা অবশ্য মাত্রই শুরু। সামনের দিনগুলোতে এ দুজনের লড়াইয়ের উত্তাপ কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।