মারাকানায় রক্তাক্ত আর্জেন্টাইন সমর্থক যা বললেন
মারাকানায় বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা ম্যাচের ফল ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে গ্যালারির সহিংসতা। জাতীয় সংগীতের সময় দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে এই সহিংসতা শুরু হয়। ব্রাজিলের পুলিশ গ্যালারিতে গিয়ে লাঠিপেটা করে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের। তা থামাতে লিওনেল মেসির নেতৃত্বে গ্যালারির দিকে ছুটেও গিয়েছিল আর্জেন্টিনা দল।
পরে সতীর্থদের নিয়ে মাঠ ছেড়ে যান মেসি। নির্ধারিত সময় থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা দেরিতে শুরু হওয়া এই ম্যাচে ১–০ গোলে জিতেছে আর্জেন্টিনা। ফিফা এই সহিংসতার তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে। তবে আপাতত সহিংসতার ঘটনাগুলো ভাসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে রক্তাক্ত মাথায় স্ট্রেচারে করে এক সমর্থককে নিয়ে যাওয়ার ছবি ও ভিডিও আলোচনায় এসেছে।
আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’ ও ‘টিওয়াইসি স্পোর্টস’ জানিয়েছে, এই ফুটবলপ্রেমীর নাম ইউজেনিও। ছবিতেই দেখা গেছে তাঁর গায়ে আর্জেন্টিনা দলের ‘অ্যাওয়ে জার্সি’ ছিল—অর্থাৎ ইউজেনিও যে আর্জেন্টিনার সমর্থক, তা না বললেও চলে। রিও ডি জেনিরোয় মঙ্গলবার রাতের (বাংলাদেশ সময় বুধবার সকালে) সেই ঘটনা নিয়ে টিওয়াইসি স্পোর্টসের সঙ্গে কথা বলেছেন ইউজেনিও। ক্লারিন জানিয়েছে, এই আর্জেন্টাইন সমর্থক রিওতে বসবাস করেন।
গ্যালারির মারামারি বর্ণনা দিতে গিয়ে ইউজেনিও বলেছেন, ‘একটি মারামারির ঘটনায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে হইচই শুরুর আগপর্যন্ত আমরা শান্তভাবেই (স্টেডিয়ামে) ঢুকেছিলাম। পুলিশ এরপর এসে আমাদের (ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা) বিচ্ছিন্ন করেনি, বরং আমাদের সাপমারা মার শুরু করে। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, আমি মারামারি করিনি কিংবা কাউকে মারিওনি। পড়ে গিয়েছিলাম এবং গ্যালারির একটি স্ট্যান্ডের আঘাত লেগেছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই।’
টিওয়াইসি স্পোর্টসের প্রতিবেদক মাতিয়াস পেল্লিচ্চিওনি ম্যাচের সময় মারাকানায় ছিলেন। ঘটনাগুলো তিনি নিজ চোখেই দেখেছেন। তাঁকে ইউজেনিও বলেছেন, ‘মারাকানায় হাসপাতালে চেতনা ফিরে পাই। আমাকে মারাকানার বাইরে নেওয়া হয়নি। হাতে হাতকড়া এবং মাথা ও চোখ রক্তে মাখামাখি ছিল। আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল এবং এমন এক কক্ষে রাখা হয়েছিল, যেখানে চিকিৎসা করা হয়। নার্স পুলিশকে জানান আমার সেলাই লাগবে। ওরাও (পুলিশ) আমাকে মেরেছে।’
সহিংসতার ঘটনায় মারাকানার বিশেষ ক্রিমিনাল আদালতে (জেক্রিম) আটক করা ১৭ জন সমর্থককে উপস্থিত করা হয়। এর মধ্যে বর্ণবাদী আচরণে অভিযুক্ত মারিয়া বেলেম নামের এক আর্জেন্টাইন সমর্থকও ছিলেন। ক্লারিন জানিয়েছে, বেশির ভাগকেই আর্থিক জরিমানা করা হলেও বর্ণবাদী আচরণের জন্য বেলেমের দুই বা তিন বছরের কারাবাসের শাস্তিও হতে পারে। সে জন্য বিচারক এবং কৌঁসুলিও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—যেহেতু এই ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল আর্জেন্টিনা এবং দলটির সমর্থকেরাও গ্যালারিতে ছিলেন। তাই আর্জেন্টিনার দূতাবাসের পরামর্শও নেওয়া হয়েছে।
ব্রাজিল পুলিশের আচরণ নিয়েও কথা বলেছেন ইউজেনিও, ‘ভোর চারটার দিকে আটক হওয়া অন্যদের সঙ্গে বের হই। আমরা মোট আটজন ছিলাম। একজনের হাত ভাঙা ছিল। যে পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের মেরেছিল, তারাই আমাদের এক্স–রে রিপোর্ট এমনভাবে তুলে ধরে ছবি ও সেলফি তুলেছে, যেন ট্রফি ধরে আছে! তাদেরকে দেখে সুখী মনে হচ্ছিল এবং নিজেদের যে নায়ক মনে করছে, সেটাও বুঝতে পারছিলাম।’
ইউজেনিওর মাথায়ও ব্যান্ডেজ এবং আটটি সেলাই লেগেছে। আর্জেন্টিনার দূতাবাসের প্রশংসা করে এই সমর্থক বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের ধন্যবাদ। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তাঁরা বিচারকের অপেক্ষায় ছিলেন। তবে এমন পরিস্থিতি ক্রোধ তৈরি করবেই। কারণ, আমরা একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম।
রিও ডি জেনিরো প্রশাসনের বরাত দিয়ে ক্লারিন জানিয়েছে, ২০০ রিয়াল করে জরিমানা দিলেই আটক আর্জেন্টাইনদের ছেড়ে দেওয়া হবে। টিওয়াইসি স্পোর্টসের সঙ্গে ইউজেনিও কথা বলার সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকাও উপস্থিত ছিলেন। টিভিতে ঘটনাটা দেখার পর ইউজেনিওর জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি।
তবে ইউজেনিও জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে চান, ‘তারা (ব্রাজিল প্রশাসন) আমাদের সামষ্টিকভাবে বিচার করেছে, যেন আমরা দলবদ্ধ হয়ে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। এটা ভুল। জানি না এমন করা হলো কেন? আমি এখানে (ব্রাজিল) থাকি। বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম। ম্যাচটি দেখতে টাকা দিয়ে টিকিটও কিনেছি। কিন্তু আর কোনো উপায় ছিল না। এখন আমি ব্যবস্থা নিতে চাই, জানি না সেটা রাষ্ট্র না কার বিরুদ্ধে। কারণ, নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে।’