রোনালদো বললেন, ‘ইনশা আল্লাহ, আল নাসরের জন্য এ বছরটা ভালো হতে যাচ্ছে’
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসটা তখন গড়িয়ে যাচ্ছিল ২০২৩ সালের জানুয়ারির দিকে। কাতার বিশ্বকাপ শেষে চারদিকে গাওয়া হচ্ছিল লিওনেল মেসির অমরত্বের গান। চারপাশে ‘মেসি মেসি’ স্লোগানটা নিশ্চয়ই তিরের ফলা হয়ে বিঁধছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বুকে।
ক্যারিয়ারজুড়ে যাঁর সঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই করে এসেছেন, কখনো জিতেছেন, কখনো হেরেছেন; তাঁকে এভাবে ‘ওয়াকওভার’ দিতে মনও হয়তো সায় দিচ্ছিল না। মেসির বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তিকে তো নয়ই, আলোচনার দিক বদলানোর মতো মোক্ষম কোনো অস্ত্রও ছিল না রোনালদোর হাতে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে বিদায় বলায় ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা।
কিন্তু নামটা যে রোনালদো, খবরের শিরোনাম তো তিনি হবেনই। অনিশ্চয়তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব ফুটবলে বছরের সবচেয়ে বড় খবরটি উপহার দিলেন পর্তুগিজ মহাতারকা। ঘোষণা দিলেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরে যোগ দেওয়ার। এই এক ঘোষণাতেই আধুনিক ফুটবলে ঘটে যায় অন্য রকম এক বিপ্লব। একজন খেলোয়াড়ের দলবদলে একটি দেশের ফুটবলের ভাগ্যটাই যেন বদলে গেল।
রোনালদোর পর গত দুই বছরে নেইমার–করিম বেনজেমাসহ আরও অনেক তারকা ফুটবলার আলোকিত করেছেন সৌদি ফুটবলের মঞ্চ। ইউরোপীয় শীর্ষ লিগগুলোর সঙ্গে সমানভাবে আলোচনায়ও ছিল সৌদি প্রো লিগ। সৌদি আরবের ফুটবলে নাম লেখানোর দুই বছর পূর্তিতে রোনালদো কথা বলেছেন সৌদি প্রো লিগের সঙ্গে। সেই কথোপকথনে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মাঠ ও মাঠের বাইরে নিজের জীবন নিয়েও আলোকপাত করেছেন। সৌদি লিগের সঙ্গে রোনালদোর আলাপচারিতার চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
রোনালদো খুশি, পরিবারও খুশি
রোনালদো সৌদি আরবে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা ছিল আরব দেশটির পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। আবহাওয়া ও সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের দেশটিতে পাশ্চাত্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা রোনালদো মানিয়ে নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে ছিল যত আলোচনা।
কিন্তু সব দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দুই বছর বেশ আনন্দেই পার করেছেন সাবেক এই রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। সৌদি প্রো লিগের সঙ্গে আলাপচারিতাতেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন রোনালদো, ‘আমি খুশি, আমার পরিবারও খুশি। জীবন ভালো চলছে, ফুটবলও ভালো চলছে।’
আমি খুশি, আমার পরিবারও খুশি। জীবন ভালো চলছে, ফুটবলও ভালো চলছে।
মাঠের লড়াইটা সহজ নয়
ক্যারিয়ারজুড়ে রেকর্ড ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে থাকা রোনালদো সৌদি আরবে এসেও ভেঙেছেন অনেক রেকর্ড। ভেঙেছেন প্রতিযোগিতায় এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডও। ২০২৩–২৪ মৌসুমে গোল্ডেন বুট জয়ের পথে ৩১ ম্যাচে গোল করেছেন ৩৫টি। কিন্তু এত কিছুর পরও লিগে আল হিলালের পেছনেই থাকতে হয়েছে রোনালদোর দল আল নাসরকে। এমনকি এখন পর্যন্ত আল নাসরের হয়ে একটি শিরোপাই জিততে পেরেছেন রোনালদো।
২০২৩ সালে জেতা আরব ক্লাব চ্যাম্পিয়নস কাপের ট্রফিটাই তাঁর একমাত্র অর্জন। দলের এই সাফল্য খরা নিয়ে রোনালদো বলেছেন, ‘আল হিলাল ও আল ইত্তিহাদের মতো দলের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। কিন্তু আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। ফুটবল এমনই। ভালো মুহূর্ত যেমন থাকবে, থাকবে খারাপ মুহূর্তও। কিন্তু আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পেশাদারত্ব বজায় রাখা, পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়া, ক্লাবকে সম্মান জানানো এবং নিজের চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। পাশাপাশি এটা বিশ্বাস করা যে সবকিছু বদলাবে।’
চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে চান ‘কিং অব চ্যাম্পিয়নস লিগ’
রোনালদোকে বলা হয় ‘চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা’। ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে রোনালদো এমন মানদণ্ড তৈরি করে রেখেছেন, যা ছাড়িয়ে যেতে হলে কোনো ফুটবলারকে অবিশ্বাস্য কিছুই করে দেখাতে হবে। সবচেয়ে বেশি গোল (১৪০) ও সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার (১৮৩) মতো অসংখ্য রেকর্ড তাঁর দখলে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা এখন সাফল্য পেতে চান এশিয়ার চ্যাম্পিয়নস লিগেও, ‘(এএফসি) চ্যাম্পিয়নস লিগ এমন কিছু, যা আমি ক্লাবের জন্য জিততে চাই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চেষ্টা করে যাওয়া এবং পেশাদার থাকা।’
মাঠের বাইরেও ‘দৃষ্টান্ত’ রোনালদো
রোনালদো শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও ব্যাপক আলোচিত চরিত্র। গত বছরের জুলাইয়েই ইউটিউবে চ্যানেল খুলে ভেঙে দিয়েছেন অতীতের সব রেকর্ড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা হয় তাঁকে। বৈশ্বিকভাবে শিশু–কিশোরসহ সব বয়সী মানুষের কাছে তাঁর ৭ নম্বর জার্সি ব্যাপক জনপ্রিয়। রোনালদোয় প্রভাবিত হয়েই নেইমারসহ অন্য তারকারা সৌদি আরবে গেছেন। মাঠের বাইরে নিজের এই প্রভাবের কথা বলেছেন রোনালদো নিজেও, ‘মানুষ রোনালদোকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখে। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও।’
মানুষ রোনালদোকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখে। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও।
তাঁকে ঘিরে সৌদি ফুটবল যে বিকশিত হচ্ছে, তা নিয়ে সম্মানিত বোধও করেন, ‘আমার জন্য এটা সম্মানের যে এই লিগ ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। অনেক তারকা এখানে এসে লিগকে আরও ভালো এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলেছে। প্রথম তারকা হিসেবে এখানে আসাটা সম্মানের। কিন্তু আমার চাওয়া, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে লিগটি আরও উন্নতি করুক। শুধু মূল দলগুলোই নয়, একাডেমিগুলোও।’
রোনালদোর স্বপ্নটা অনেক বড়
সৌদি ফুটবলে নাম লিখিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন রোনালদো। কিন্তু স্বপ্নের জালটা তিনি ছড়িয়ে দিতে চান আরও দূরে, ‘আমার স্বপ্ন শুধু সৌদি খেলোয়াড় এবং লিগের ভবিষ্যৎ ঘিরে নয়, বরং দেশটির জন্যও। আমি অন্য লিগের সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে চাই। দেশ (সৌদি আরবের ফুটবল) ও লিগকে আমি সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে সাহায্য করার চেষ্টা করব।’
ট্রফি জেতার মুহূর্তটাই সবচেয়ে পছন্দের
সৌদি আরবে এসে ব্যক্তিগত অনেক রেকর্ড নিজের করে নিলেও আল হিলালকে হারিয়ে আরব ক্লাব কাপ জেতার মুহূর্তটাই তাঁর সবচেয়ে পছন্দের। নিজের পছন্দের মুহূর্ত নিয়ে রোনালদো বলেছেন, ‘সম্ভবত যখন আমরা প্রথম ট্রফিটা জিতি, সে মুহূর্তটা। আপনি যখন ট্রফি জিতবেন, কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে। এখানে এসে প্রথম বছরেই শিরোপা জেতাটা দারুণ ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমি আরও জিততে চাই। আমি আল নাসরকে শিরোপা জেতায় সাহায্য করতে চাই। ইনশা আল্লাহ, আল নাসরের জন্য এ বছরটা ভালো হতে যাচ্ছে।’