টাইব্রেকারে সমতার পর টস—ফুটবল কি এর আগে দেখেছে এমন ঘটনা
এমন ফুটবল ম্যাচ কি আগে কখনো দেখেছে কেউ!
কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে কাল রাতে যা ঘটেছে, সেটি ফুটবল ইতিহাসেই আগে কখনো ঘটেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচ নির্ধারিত সময়ে ১–১ গোলে অমীমাংসিত থাকার পর সাফের বাইলজ অনুযায়ী শিরোপা নির্ধারণে সরাসরি টাইব্রেকার যাওয়া হয়েছিল। সেই টাইব্রেকার পাঁচ শট থেকে ১১ শটে গড়াল। তারপরও তা ১১–১১ গোলে অমীমাংসিত। কারণ, দুই দলের গোলকিপাররা পর্যন্ত পেনাল্টিতে গোল করেছেন।
এর পরই শুরু হলো মহানাটক। অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অচিন্তনীয় সব দৃশ্যের মঞ্চায়ন।
টাইব্রেকারের নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত ৫টি করে পেনাল্টির পরও যদি অমীমাংসিত থাকে, তাহলে সাডেন ডেথে দুই দল একটি করে পেনাল্টি শট নিতে থাকে। এটি চলতে থাকে যতক্ষণ ফল নির্ধারিত না হচ্ছে, ততক্ষণই। এটাই আন্তর্জাতিক নিয়ম। সারা দুনিয়াতে ফুটবলের অমীমাংসিত টাইব্রেকারে এভাবেই ফল নির্ধারিত হয়। কিন্তু এদিন কমলাপুরে হলো অন্য কিছু। নেপালি রেফারি রাজ অঞ্জনা সাডেন ডেথ চালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। বল স্পটেও বসিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার আবারও পেনাল্টি নিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই শ্রীলঙ্কার ম্যাচ কমিশনার ডি সিলভা জয়সুরিয়া দিলান হঠাৎ করেই শিরোপা নির্ধারণে টস করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দুই দলের অধিনায়ককে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ দ্রুতই সেই টস করেও ফেলেন। টসে জিতেই ভারত শিরোপা জয়ের উদ্যাপন শুরু করে দেয়। টসে কেন ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হবে—দর্শকের মনে জেগে ওঠা এই প্রশ্নের মধ্যেই বাংলাদেশ দলের কর্মকর্তারা রেফারি আর ম্যাচ কমিশনারের কাছে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।
এদিকে ভারতীয় দলের খেলোয়াড়েরা দর্শকভর্তি গ্যালারির সামনে গিয়ে উদ্যাপন করতে থাকলে দর্শক ক্ষিপ্ত হয়ে মাঠে বোতল ছোড়া শুরু করেন। ভারতীয় মেয়েদের দলকে দ্রুতই সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঠিক এই সময়ই সবাইকে আবারও অবাক করে দিয়ে আসে ম্যাচ কমিশনারের নতুন ঘোষণা—টস করাটা তাঁর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আবারও সাডেন ডেথ হবে। এই ঘোষণায় ভারত বেঁকে বসে। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পুরো দল মাঠ ত্যাগ করে।
কোনো ম্যাচে এমন বিভ্রান্তিতে দর্শক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগে কখনোই পড়েননি। অন্তত কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ, যেখানে দুটি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী দল মুখোমুখি। ম্যাচ রেফারি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মাঠ ত্যাগ করা ভারতীয় দলের মাঠে ফেরার জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা হবে। বাংলাদেশ দল এ সময় মাঠেই অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ভারতীয় দল এরপর আর মাঠে আসেনি। অপেক্ষার ৩০ মিনিট ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে যায় দুই ঘণ্টারও বেশি। এই পর্যায়ে চলতে থাকে কর্মকর্তা পর্যায়ের তৎপরতা। ভারতীয় দল অবশ্য এ সময় ড্রেসিংরুমেই ছিল। তাদের আবারও মাঠে নামানোর তৎপরতার পুরোটা সময় বাংলাদেশ দল ছিল মাঠেই। আফঈদা, সাগরিকারা সবাই মিলে নিজেদের মধ্যে মেতেছিলেন খুনসুটিতে। চলছিল দেদার আড্ডা। গ্যালারিতে ফুটবলপ্রেমী দর্শকেরও অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। সব অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে, যখন মাঠে মঞ্চ সাজানো শুরু হয়। যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান বাফুফে ও সাফের কর্তাদের নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার নাটক আর বিতর্কের পর যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ–ভারত দুই দলকেই।
অথচ গল্পটা হতে পারত ফুটবল নিয়েই। কিন্তু ম্যাচ কমিশনারের একটা ভুল সাফ অনূর্ধ্ব–১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালটায় কালিমা লেপে দিল বিতর্ক আর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি।
ম্যাচের পর স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল। তিনি বলেছেন, ‘পুরো ব্যাপারটিই ঘটেছে ম্যাচ কমিশনারের অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভুলে। এর দায় সাফ নেবে না।’
যুগ্ম চ্যাম্পিয়নশিপ ঘোষণা করার আগে নিজেদের তৎপরতা সম্পর্কেও বলেছেন সাফ সাধারণ সম্পাদক, ‘দীর্ঘ আলোচনার পর ভারতকে যুগ্ম বিজয়ী হিসেবে রাজি করা গেছে। আমরা তাদের সামনে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব রেখেছিলাম। এক, আবার সাডেন ডেথে অংশ নেওয়া। দুই, যুগ্ম চ্যাম্পিয়নশিপ। তিন, ফাইনালটি আবারও খেলা। সাফের স্বার্থে তারা যুগ্ম শিরোপার ব্যাপারটি মেনে নিয়েছেন।’
যুগ্ম চ্যাম্পিয়নের ব্যাপারটা যে সাফের বাইলজে নেই, এটা জানিয়ে আনোয়ারুল বলেছেন, বৃহত্তর স্বার্থে তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।