ব্রাজিলিয়ানদের আরব্য রজনীর গল্প শুরু যাঁর হাত ধরে

আল হিলালের সঙ্গে চুক্তি করার পর সৌদি আরবের রিয়াদে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রিভেলিনোছবি: টুইটার

প্রথমেই একটি গল্প। সত্যি না মিথ্যা, তা নির্ণয় প্রায় অসম্ভবই। তাই গল্প বলাই শ্রেয়। ২০১৯ সালে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘ইউওএল’–এর ব্লগে সেই ‘গল্প’ই বলেছিলেন ব্রাজিলের সংবাদকর্মী মিল্টন নেভেস। তাঁর শুরুটা ছিল এমন ‘কথিত আছে...।’ এখন যা ‘কথিত’ বা লোকমুখে প্রচলিত, তাকে সত্য বলে দাবি করাটা যেমন যৌক্তিক হয় না, তেমনি মিথ্যা বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বরং তা কথিত হিসেবেই থাক এবং গল্পটা শোনা যাক।

রিভেলিনো তখন সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলালে। স্ত্রী মায়শা ও বন্ধুদের নিয়ে একদিন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। এমন সময় এক আরব এসে পরিচয় দেন, তিনি প্রিন্স খালেদের দূত। রিভেলিনোকে আরব লোকটি বলেন, আল হিলালের মালিক (প্রিন্স খালেদ) প্রচুর টাকার বিনিময়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গ রাত কাটাতে চান। বলা বাহুল্য, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ‘অ্যাটমিক কিক’খ্যাত রিভেলিনো রাগে ফেটে পড়েছিলেন এবং সেই দূতকে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে দেন।

ট্রান্সফারমার্কেট জানাচ্ছে, আল হিলালে মোট ৩১ জন ব্রাজিলিয়ান খেলেছেন। কিছু সংবাদমাধ্যমের দাবি ৩০ জন। সংখ্যাটা যা–ই হোক, প্রথম তো রিভেলিনোই, সেখান থেকে তাঁকে কেউ কখনো নড়াতে পারবে না। শুধু আল হিলালে প্রথম কেন, পেশাদার ফুটবল খেলতে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া প্রথম ব্রাজিলিয়ানও রিভেলিনো, যা পরে দক্ষিণ আমেরিকান অনেক খেলোয়াড় ও কোচদের দ্বার খুলে দিয়েছিল।

কিছুদিন পরের কথা। আল হিলালের অনুশীলন সেশনে ছিলেন রিভেলিনো। রাগটা পুষে রেখেছিলেন আর তা মেটানোর সুযোগও পেয়ে গেলেন সেদিনই! অনুশীলনের সময় খেয়াল করলেন গ্যালারিতে বসে আছেন স্বয়ং প্রিন্স খালেদ। আর যায় কোথায়! প্রিন্সকে তাক করে কামান দাগার মতো দাগলেন ‘অ্যাটমিক কিক’। শুটিংয়ে রিভেলিনোর অব্যর্থ নিশানা নিয়ে কখনোই সন্দেহ ছিল না, আর এ যাত্রায়ও তিনি হতাশ করলেন না। কিন্তু বিপদটা বুঝতে পেরেছিলেন। সৌদি আরবে কিছু বন্ধু জুটেছিল। তাঁদের সহায়তায় ব্রাজিলে ফিরে আসেন। কিন্তু ক্লাবের মালিক প্রিন্স খালেদ তাঁকে ছাড়েননি। আল হিলালে থাকতে সাও পাওলোয় খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন রিভেলিনো। যেতে পারেননি প্রিন্স খালেদের জন্য। অগত্যা ৩৫ বছর বয়সে আল হিলালেই অবসর নিতে হয়।

ছেলেকে কোলে নিয়ে মাঠে রিভেলিনো। যখন তিনি আল হিলালে খেলতেন
ছবি: টুইটার

কথিত এই ঘটনার সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করবেন ফুটবলের ইতিহাসবেত্তারা। তবে ব্যাপারটি মাথায় রেখে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাকালে কারও কারও মনে খটকা লাগতে পারে। নেইমার আল হিলালে যোগ দেওয়ার পর তাঁকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন রিভেলিনো, ‘গ্রেট নেইমার, আমি যে ক্লাবে তিন বছর সুখে ছিলাম, সেখানে পৃথিবীর সব সুখ তোমার জন্য কামনা করি। আশা করি, তুমি খুব সুখেই থাকবে এবং নিজের স্বপ্নটা কী, তা বুঝতে পারবে। সেখানকার অসাধারণ সমর্থকদের তুমি আনন্দে রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, আল হিলালে অমন স্মৃতি থাকলে রিভেলিনো কেন ‘আমি যে ক্লাবে তিন বছর সুখে ছিলাম’ কথাটা বলবেন? নিছক সৌজন্যতা? হতে পারে। তবে আল হিলালের ভক্তরা রিভেলিনোকে মনে রেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি দাবি উঠেছে—আল হিলালের সমর্থকেরা রিভেলিনোর নামে হ্যাশট্যাগ দিয়ে এ দাবিটা তুলেছেন। শনিবার নেইমারকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে আল হিলাল। সেদিন সৌদি ক্লাবটিতে খেলা প্রথম ব্রাজিলিয়ান (রিভেলিনো) ফুটবলারটি যেন নিজে উপস্থিত থেকে নেইমারকে এই ক্লাবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, সেই দাবি তুলে প্রচারণা চালাচ্ছেন আল হিলালের সমর্থকেরা। রিভেলিনোর ‘ওজন’টা তাঁরা জানেন বলেই হয়তো সেদিন তাঁরা তাঁকে ক্লাবে দেখতে চান। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের এই ‘গোঁফওয়ালা’ কিংবদন্তিকে নিয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় ব্রাজিলের খেলা দেখার সময় পেলেকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমি দেখতাম মাঠের অন্য প্রান্তে রিভেলিনোকে। আমি যেমন ফুটবলার হতে চেয়েছি, তার সবকিছু রিভেলিনোর মধ্যে ছিল।’ এককথায়, রিভেলিনোকে আদর্শ মানতেন প্রয়াত আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি।

ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ১৯৭৮ সালে সেই দলবদলে আল হিলালে মাসে ১০ হাজার ডলার পেতেন রিভেলিনো। আর দলবদল ফি হিসেবে ফ্লুমিনেন্সে পেয়েছিল ৭ লাখ ডলার, রিভেলিনোও পেয়েছিলেন ৭ লাখ ডলার। শুধু কি তাই, রিভেলিনো প্রিন্স খালেদের যে বাসভবনে থাকতেন, তার সব খরচ প্রিন্স নিজেই দিতেন এবং ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির বাচ্চাদের স্কুলের খরচও দিয়েছেন। আর ম্যাচে ভালো খেললে তো উপহার ছিলই। জোড়া গোল কিংবা ফ্রি–কিক থেকে গোল করলে অথবা আল হিলালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে গোল করলে অনুশীলনের পর রিভেলিনো আবিষ্কার করতেন, তাঁকে স্বর্ণ ও হীরকখচিত ঘড়ি পাঠানো হয়েছে!

’৭০ বিশ্বকাপজয়ী রিভেলিনো বাঁকানো ফ্রি–কিক, দূরপাল্লার শুটিং, নিখুঁত পাস, দূরদর্শিতা, ক্ষুরধার ড্রিবলিং ও অবিশ্বাস্য বল নিয়ন্ত্রণের জন্য খ্যাতি কুড়িয়েছেন। এখন ‘ইলাস্টিকে’ বা ‘ফ্লিপ ফ্ল্যাপ’ নামে যে ড্রিবলিং, সেটা ১৯৬৪ সালে করিন্থিয়ানসে থাকতে জাপানি বংশোদ্ভূত ব্রাজিলিয়ান সের্হিও ইশিগোর কাছ থেকে শিখে নিখুঁত বানিয়েছিলেন রিভেলিনো। তাঁর পায়েই জনপ্রিয় হয়েছিল এই ড্রিবলিং, যা পরে অনুকরণ করেছেন রোমারিও, রোনালদো, ম্যাজিকো গঞ্জালেস, রোনালদিনিও থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরা। আর ১৯৭০ বিশ্বকাপে চেকোশ্লোভাকিয়ার বিপক্ষে গোলার গতিতে ফ্রি–কিকে গোল করার পর মেক্সিকান সমর্থকদের কাছ থেকে ‘পাতাদা আতোমিকা’ (অ্যাটমিক কিক) তকমাটা পেয়েছিলেন। ’৭৪ ও ’৭৮ বিশ্বকাপেও খেলেছেন রিভেলিনো। সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় তাঁর নামটা সহজেই উঠে আসে। দৃষ্টিনন্দন ফুটবলারদের তালিকায় থাকে ওপরের দিকে। ২০০৪ সালে ফিফার সর্বকালের সেরা ১০০ জীবিত ফুটবলারের তালিকায় রিভেলিনোকে রেখেছিলেন পেলে।

আল হিলালের হয়ে কিং কাপ জিতেছিলেন রিভেলিনো
ছবি: টুইটার

সে যাহোক, ১৯৭৮ বিশ্বকাপের পর রিভেলিনোর ফ্লুমিনেন্স ছেড়ে আল হিলালে যোগ দেওয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ‘বুড়ো নেকড়ে’খ্যাত মারিও জাগালো। ১৯৭৯ সালের ৫ জানুয়ারি জাগালো আল হিলালের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই রিভেলিনোকে সৌদি আরবে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছিলেন। তার মাত্র কয়েক বছর আগে (১৯৭৬) পেশাদার লিগ শুরু করেছিল সৌদি আরব। দেশটিতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে রিভেলিনোকে চেয়েছিলেন প্রিন্স খালেদ বিন আল সৌদ। ফ্লুমিনেন্সে রিভেলিনো যে বেতন পেতেন, তার সাত গুণ বেশি বেতনের সঙ্গে তখনকার সুপারসনিক কনকর্ড বিমানে চড়িয়ে সৌদি আরবে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁকে। রিভেলিনো সুযোগ বুঝে এসবের সঙ্গে আরও একটি ‘আবদার’ করেছিলেন, ‘একট মার্সিডিজের স্বপ্ন ছিল। সই করার আগে কথাটা বলতেই...তারা হেসে ফেলে। কারণ, তাদের কাছে বিষয়টি এমন ছিল যে আমি ‘ফুসকা’ (ব্রাজিলে ভক্সওয়াগনের সস্তা বিটল গাড়ির ডাকনাম) চাচ্ছি।’

বলা বাহুল্য, রিভেলিনোকে শুধু মার্সিডিজের মডেল ও রং পছন্দ করা ছাড়া আর কিছুই করতে হয়নি। ৩২ বছর বয়সী রিভেলিনো সৌদি আরবে পা রাখার পর তাঁকে অনেকটাই রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় বরণ করে নেওয়া হয়েছিল। রোলস রয়েসে চড়িয়ে মোটর শোভাযাত্রা হয়েছিল। রাস্তার দুই পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে নিজের চোখে রিভেলিনোকে দেখে বিশ্বাস করেছিলেন, হ্যাঁ, বিশ্বের অন্যতম সেরা এক খেলোয়াড় সৌদি আরবে খেলতে এসেছেন! আর রিভেলিনোর থাকার জায়গা ছিল সৌদি বাদশাহ খালেদের ভাতিজা প্রিন্স খালেদ আল সৌদের বাসভবন। ব্রাজিলিয়ান সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল, ‘রিভেলিনোর এক হাজার এক আরব্য রজনী।’

ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ১৯৭৮ সালে সেই দলবদলে আল হিলালে মাসে ১০ হাজার ডলার পেতেন রিভেলিনো। আর দলবদল ফি হিসেবে ফ্লুমিনেন্সে পেয়েছিল ৭ লাখ ডলার, রিভেলিনোও পেয়েছিলেন ৭ লাখ ডলার। শুধু কি তাই, রিভেলিনো প্রিন্স খালেদের যে বাসভবনে থাকতেন, তার সব খরচ প্রিন্স নিজেই দিতেন এবং ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির বাচ্চাদের স্কুলের খরচও দিয়েছেন। আর ম্যাচে ভালো খেললে তো উপহার ছিলই। জোড়া গোল কিংবা ফ্রি–কিক থেকে গোল করলে অথবা আল হিলালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে গোল করলে অনুশীলনের পর রিভেলিনো আবিষ্কার করতেন, তাঁকে স্বর্ণ ও হীরকখচিত ঘড়ি পাঠানো হয়েছে!

আল হিলালের জার্সি গায়ে নেইমার
ছবি: এএফপি

বিনিময়ে সৌদি আরবের ফুটবলে চার বছর থেকে আল হিলালকে দুই হাত ভরে দিয়েছিলেন রিভেলিনো। আল হিলাল তাঁর হাত ধরে প্রথমবারের মতো টানা দুবার লিগ জিতেছিল। ১৯৮০ সালে জিতেছিল কিংস কাপও। আল হিলালের হয়ে ৫৭ ম্যাচে ২৩ গোল করা রিভেলিনো আল নাসরের বিপক্ষে শিরোপা নিষ্পত্তির ম্যাচে বাঁ পায়ে হাফ ভলিতে দূরপাল্লার দুর্দান্ত একটি গোল করেছিলেন। সৌদির ক্লাব ফুটবলে তা আজও স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর একটি। সৌদি আরবের ফুটবলপ্রেমীদের সেই স্মৃতি মনে আছে বলেই কি ৭৭ বছর বয়সী রিভেলিনোর জন্য এখনো তাদের মন পোড়ে?

সৌদিরা আদর করে তাঁকে দুটি নামে ডাকতেন—‘রিভা’ ও ‘রিভো’। তাঁদের প্রিয় ‘রিভো’ সে সময় জানতেন না, সৌদি আরবে যে ‘দরজা’ তিনি খুলে দিলেন, সেই দরজা দিয়ে পরবর্তী সময়ে একে একে আরও ৩০ জন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় নাম লেখাবেন আল হিলালে। ট্রান্সফারমার্কেট জানাচ্ছে, আল হিলালে মোট ৩১ জন ব্রাজিলিয়ান খেলেছেন। কিছু সংবাদমাধ্যমের দাবি ৩০ জন। সংখ্যাটা যা–ই হোক, প্রথম তো রিভেলিনোই, সেখান থেকে তাঁকে কেউ কখনো নড়াতে পারবে না। শুধু আল হিলালে প্রথম কেন, পেশাদার ফুটবল খেলতে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া প্রথম ব্রাজিলিয়ানও রিভেলিনো, যা পরে দক্ষিণ আমেরিকান অনেক খেলোয়াড় ও কোচদের দ্বার খুলে দিয়েছিল।

নেইমার সে ‘দ্বার’ দিয়েই আল হিলালে যোগ দিয়ে বলেছেন, ক্রীড়াঙ্গনে নতুন ইতিহাস গড়তেই সৌদি আরবে গিয়েছেন। আল হিলালে রিভেলিনো ব্রাজিলিয়ানদের যে ‘আরব্য রজনীর গল্প’ শুরু করেছিলেন, নেইমার তাতে আরও কত গল্প যোগ করতে পারবেন, সময়ই বলে দেবে। আপাতত রিভেলিনোর শুভেচ্ছা বার্তাই সত্যি হোক—‘আশা করি সুখেই থাকবে।’