মেসির জন্য মরতে গিয়ে তিনি আর্জেন্টিনাকে ‘জীবন’ দিলেন
মাঠেই উপুড় হয়ে চুপচাপ পড়ে ছিলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। যেন চারপাশের উদ্বাহু নৃত্য দেখবেন না! আকাশি-সাদা জার্সিতে তখন উৎসবের ঢেউ লেগেছে। মার্তিনেজ জানতেন, সেই ঢেউয়ের পেছনে তাঁর অবদান কম নয়।
টাইব্রেকারে দুটি শট সেভ করেছেন। জয়ের উন্মত্ত শিহরণের মধ্যেও লিওনেল মেসি তা কী করে ভুলবেন! ছুটে চলে এলেন মার্তিনেজের পাশে। মাটি থেকে তুলে টেনে নিলেন বুকে। কোথাও যেন বলা হলো, ‘বন্ধু, তোমার দুটি হাত শুধু আমার স্বপ্ন-ই বাঁচায়নি, আর্জেন্টাইন এবং সমর্থকদের স্বপ্নকেও জীবন্ত করেছে।’
অথচ, মেসির জন্য মরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল মার্তিনেজের। গত বছর কোপা আমেরিকা জয়ের পর বলেছিলেন, ‘আমি জীবনটা ওকে দিতে চাই। ওর জন্য মরতেও পারি।’ সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে ৩টি পেনাল্টি সেভ করে আর্জেন্টিনাকে কোপার ফাইনালে তুলেছিলেন মার্তিনজেই। আর ফাইনালে শেষ বাঁশি বাজার পর আন্তর্জাতিক ময়দানে ২৮ বছরের শিরোপাখরা কাটিয়েছিল আর্জেন্টিনা।
আর কাল রাতে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও আর্জেন্টিনার ত্রাতা সেই মার্তিনেজই। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচটা টাইব্রেকারে গড়ানোর পর তাঁর দুটি হাতেই তাকিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। বাজপাখির মতো উড়ে করা দুটি সেভ জীবনসঞ্চার করেছে মেসির শেষ স্বপ্ন, আর্জেন্টাইনরা সম্ভবত বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, হ্যাঁ, এবার সম্ভব। এবারই হয়তো কাটবে বিশ্বকাপে ৩৬ বছরের খরা!
মেসির জন্য মার্তিনেজের জীবন দানের ইচ্ছা যে শুধু মুখের কথা ছিল না, তা টের পাওয়া যায় কাল টাইব্রেকার এবং তার পরবর্তী মুহূর্তে। মার্তিনেজের ওপর কী কিছু ভর করেছিল! পোস্টের নিচে অতিমানব হয়ে ওঠার পর ছুটে গেছেন ডাচ ডাগ আউটের দিকে। কয়েক কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। ম্যাচের শেষ দিকে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে উত্তেজনাকর মুহূর্তে আর্জেন্টিনার জন্য, মেসির জন্য সেভাবে ভূমিকা রাখতে না পারার ক্ষোভ মিটিয়েছেন? হতে পারে।
গোলকিপারদের এই এক সমস্যা। মাঠে উত্তেজনাকর কিছু ঘটলে দৌড়ে গিয়ে সব সময় সতীর্থদের পাশে দাঁড়াতে পারেন না, ধাক্কাধাক্বি ও কথা–কাটাকাটিতে সাহায্য করতে পারেন না! নিজের কাজটা ঠিকমতো করার পর তাই হয়তো ডাচদের প্রতি অমন বিদায় সম্ভাষণ। কিন্তু তারপর সেই মার্তিনেজই আবার মোমের মানুষ। আবেগে থরথর হয়ে শুয়ে পড়লেন মাটিতে। কিছুক্ষণ আগে দুই হাতে যে ইতিহাস তিনি লিখেছেন, তা যে সবাই পারে না, এমনকি মেসির মতো কিংবদন্তিও না। মেসিকেই বরং চেয়ে থাকতে হয়েছে তাঁর দুটি হাতে।
শুধু মেসি কেন, মার্তিনেজ জানেন, গোটা আর্জেন্টিনাই তাঁর দিকে চেয়ে ছিল। আর্জেন্টিনার বাইরে এই বিশ্বসংসারে মেসিদের আরও যত সমর্থক, তাঁদের সবার হয়ে ডাচ ‘শেল’ রুখতে হয়েছে তাঁকে। স্বপ্নটাকে বাঁচানোর পর লুসাইল স্টেডিয়ামে মার্তিনেজের মাথায় প্রথম কোন ভাবনাটা এসেছে জানেন? না, মেসি না। আর্জেন্টিনার কথা, দেশের মানুষের কথা!
ভেজা চোখে মার্তিনেজ বলেছেন, ‘সবার আগে বাঁধভাঙা আবেগে ভেসে গেছি। এটা দেশের সাড়ে চার কোটি মানুষের জন্য। আর্থিকভাবে দেশ খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এর মধ্যে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারার চেয়ে সন্তষ্টির আর কিছু হয় না।’ দেশের সমর্থকেরা এবং সতীর্থদের জন্য কিছু করতে মার্তিনেজ কতটা মরিয়া ছিলেন, সেটাও বোঝা যায় তাঁর কথায়। টাইব্রেকার জেতার পরই বলেছেন, ‘আরও সেভ করতে পারতাম।’
মার্তিনেজ কোথায় পান এমন আত্মবিশ্বাস? আগের ম্যাচেই টাইব্রেকারে ব্রাজিলের গোলকিপার একটাও সেভ করতে পারেননি। বিশ্বকাপ নকআউটের টাইব্রেকার কত চাপের, তা চাইলে আলিসনের কাছ থেকে শুনে নেওয়া যায়। অথচ, মার্তিনেজের কিছু মনে হলো না! কীভাবে সম্ভব?
তাঁর মুখে সে ব্যাখ্যা শোনার আগে একবার স্মরণ করে নিন, মোট ১২০ মিনিটে খেলা ২-২ গোলে অমীমাংসিত থাকার পর গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, ‘সতীর্থরা ক্লান্ত ছিল। ওরা আমাকে ৯০ মিনিট দিয়েছে। কিন্তু ৯০ মিনিটের মধ্যে ওদের জন্য কিছু করতে পারিনি। তাই তখন (টাইব্রেকার) কিছু একটা করতেই হতো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে দুটি সেভ করতে পেরেছি। আমি আরও সেভ করতে পারতাম।’
তার আর দরকার হয়নি। টাইব্রেকারে ৪–৩ গোলের জয়টা আর্জেন্টিনার সেমিফাইনালের টিকিট পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এই যে কিছু একটা করার তাড়না—মার্তিনেজের এই পথের চূড়ান্ত হয়তো মেসির জন্য মরে যেতে চাওয়া, সতীর্থদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যা যা সম্ভব সব কিছু করা।
মানুষ কিন্তু এভাবেই অতিমানব হয়ে ওঠে।