২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সালাহ: দ্য ম্যান, দ্য মিথ, দ্য লিজেন্ড

লিভারপুলের জার্সিতে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছেন সালাহইনস্টাগ্রাম

গল্পটি সাদামাটা ঘর থেকে উঠে আসা এক কিশোরের। মিশরের প্রাচীন শহর নাগরিক থেকে ১৫ ঘণ্টা ভ্রমণ করে ৫ বা ৬টি মাইক্রোবাস বদলে ৯০ মাইল পাড়ি দিয়ে রোদ–বৃষ্টি–ঝড় উপেক্ষা করে যে কিনা ফুটবল অনুশীলন করতে যেত কায়রোতে। ২০১৭–১৮ সালের পর থেকে এটি আর নিছক কোনো ঘটনা হয়ে থাকেনি।

মিসরের অলি–গলিতে এই ঘটনাটি ধীরে ধীরে মিথ বা পুরাকাহিনির আকার নিতে শুরু করে। ভিন্ন ভিন্ন কথকের বর্ণনার সঙ্গে বদলে যেতে শুরু করে মাইক্রোবাসের সংখ্যা, ভ্রমণের সময় কিংবা দূরত্বের হিসাবনিকাশও। ঘটনার মাহাত্ম্য বাড়াতে সবাই গল্পের ডালপালা ছড়িয়ে দিতেন।

আরও পড়ুন

সবার চেষ্টা ছিল এই ঘটনাকে যতটা সম্ভব অতিমানবীয় করে তোলা যায়! অবশ্য এটি তো আর সাধারণ কোনো মানুষের গল্প নয়। তাই গল্পটি কতটা সত্যি বা মিথ্যা, তা জানার আগ্রহও নেই কারও। বরং যে নামকে ঘিরে এই ঘটনা বা গল্পের বিস্তার, সেই নামটিই তাঁদের জন্য সব। পৃথিবীর সুন্দর সব বিশেষণ কিংবা রূপকথাকে তাঁরা পারলে জড়িয়ে দিতে চান সে নামের সঙ্গে। এ নাম যে তাঁদের জন্য সাহস এবং অনুপ্রেরণারও।

সেই মানুষটিকে এখন আদর করে কেউ কেউ ডাকেন ‘ইজিপশিয়ান কিং’—যেন রূপকথার কোনো এক গল্পের রাজা। শুরুতে অবশ্য তাঁকে ‘ইজিপশিয়ান মেসি’ বলেও ডাকতেন অনেকে। তবে ‘মেসি’ নামের ছায়া থেকে বেরিয়ে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন, ‘দ্য ম্যান, দ্য মিথ, দ্য লিজেন্ড’। ফলে তাঁর জীবনের ঘটনা যে রূপকথার গল্প হয়ে উঠবে, তা তো বলাই বাহুল্য। ওহ, এত সব গল্পকথার ভিড়ে তাঁর আসল নামটিই তো বলা হয়নি! সেটি অবশ্য এতক্ষণে আন্দাজ করেই ফেলেছেন। সেই কিংবদন্তিটি যে মোহাম্মদ সালাহ—তা বোধহয় না বললেও চলত।

মাইলফলক স্পর্শ করা গোলের পর সালাহ
ইনস্টাগ্রাম

প্রশ্ন হচ্ছে, সালাহকে নিয়ে এমন রূপকথার কী প্রয়োজন? মিথের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মিথবিষয়ক বিখ্যাত লেখক জোসেফ ক্যাম্পবেল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, জীবন কাটাতে চান কাটিয়ে দিন। জীবন সত্যি সুন্দর। আপনার পুরাকাহিনির কোনো প্রয়োজন নেই। একটা বিষয়কে প্রয়োজনীয় বলে প্রচার করা হয়েছে বলেই আপনাকে সে বিষয়ে উৎসাহী হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। আমি মনে করি, একটা বিষয়ে আপনি কোনো না কোনোভাবে যদি জড়িয়ে পড়েন তবে উৎসাহ দেখাবেন।’

ঠিক একইভাবে ২০১৭–১৮ মৌসুম থেকে ফুটবল রোমান্টিকদের ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে সালাহ নামের ‘মিথ’। তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় ব্যাপক উৎসাহ। সেই উৎসাহ কেমন, একটি তথ্যে বোঝা যেতে পারে। ২০১৯ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সালাহর কারণে লিভারপুল অঞ্চলে ‘ইসলামোফোবিয়া’ (ইসলাম ধর্মবালম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ‘হেট ক্রাইম’ (ঘৃণাজনিত অপরাধ) ১৮.৯ শতাংশ কমার কথা বলা হয়।  

আরও পড়ুন

লিভারপুলে নক্ষত্রের মর্যাদা পাওয়া সালাহ নিজ দেশ ও অঞ্চলের মানুষের জন্য হয়ে ওঠেন বিশাল এক অনুপ্রেরণার আধার। নাগরিক অঞ্চলের মানুষদের জন্য আধুনিক মিসরের রূপকথার গল্পের নায়কও তিনি। পাশাপাশি একই সময়ে ফুটবল দুনিয়া মজেছে সালাহর বাঁ পায়ের জাদুতেও। যাঁর পায়ে বল মানে অবিশ্বাস্য কিছুর সম্ভাবনা কিংবা জাদুকরের থলে থেকে বের করা কোনো চমক।

যদিও সালাহর শুরুটা মোটেই এমন মসৃণ ছিল না। ২০১৭–১৮ মৌসুমে ইয়ুর্গেন ক্লপ যখন সালাহকে লিভারপুলে নিয়ে আসেন, অনেকের চোখ তখন কপালে উঠেছিল। কেউ কেউ বাজে সাইনিং বলে তাচ্ছিল্যও করেছিলেন। এসব সমালোচনা মোটেই অযৌক্তিক ছিল না। এর আগে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চেলসিতে ছিলেন সালাহ।

স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ছাড়ার সময় নামের সঙ্গে বাড়তি বোঝা হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘চেলসি–ফ্লপ’ তকমাও। তথাকথিত এই ‘বাতিল’ খেলোয়াড়কে ক্লপ কীভাবে খেলাবেন, সেদিকেই চোখ ছিল সবার। সে সব সমালোচকদের তাক লাগিয়ে প্রথম মৌসুমেই সালাহ ইতিহাস গড়ে করলেন ৪৪ গোল। এরপরও সমালোচকদের মন ভরল কই! নামের পাশে এবার তাঁরা লাগিয়ে দিলেন ‘এক মৌসুমের বিস্ময়’ ট্যাগ।

নেতিবাচক তকমাগুলো শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে ফিরেছে সেই সব সমালোচকদের দিকেই। প্রতি মৌসুমে সালাহর ব্যর্থতার কামনা করে যে মানুষগুলো অপেক্ষায় থেকেছেন, নত মাথায় হতাশার আখের গুছিয়ে প্রতিবার ফিরতে হয়েছে তাঁদের। অন্য দিকে এক মৌসুমের বিস্ময় সালাহ প্রতি মৌসুমে উপহার দিতে শুরু করেন নতুন নতুন চমক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ গতকাল রাতে লিভারপুলের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ৭ মৌসুম ২০ বা তার বেশি গোল করার অনন্য এক কীর্তি গড়েছেন সালাহ। ইউরোপা লিগের দ্বিতীয় লেগে স্পার্তা প্রাগের বিপক্ষে লিভারপুলের ৬–১ গোলের জয়ে তৃতীয় গোলটি করে এ মাইলফলক স্পর্শ করেন ‘মিসরের রাজা’। এর আগে গত মৌসুমে টানা ৬ মৌসুমে ২০ বা তার বেশি গোল করে সালাহ স্পর্শ করেছিলেন লিভারপুল কিংবদন্তি ইয়ান রাশকে। এবার তিনি সে রাশকেও পেছনে ফেললেন।  

১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সালে লিভারপুলের সোনালি সময়ের অন্যতম সারথি ছিলেন রাশ। সে সময় লিভারপুলের হয়ে গোলের পর গোল করেছেন ওয়েলশের সাবেক স্ট্রাইকার। মাঝে লিভারপুল ছেড়ে জুভেন্টাস চলে না গেলে টানা গোলের রেকর্ডটি আরও বড় করার সুযোগ ছিল তাঁর। জুভেন্টাস থেকে ফিরে এসে অবশ্য আরও তিন মৌসুম ২০ বা বেশি গোল করেছিলেন রাশ।

লিভারপুলের জার্সিতে সালাহ প্রায় দেখা যায় এমন উদ্‌যাপনে
ইনস্টাগ্রাম

লিভারপুলে দুই মেয়াদে ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে রাশ ক্লাব রেকর্ড গড়ে গোল করেন ৩৪৬টি। এই রেকর্ড ভাঙা অবশ্য সালাহর জন্য বেশ কঠিনই। তবে এরই মধ্যে ২০৬ গোল করে সেরা পাঁচে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন সালাহ। যে তালিকায় তিনি পেছনে ফেলেছেন স্যার কেনি ডাগলিশ এবং রবি ফাওলারের মতো ক্লাব কিংবদন্তিদেরও। তবে এই তালিকার সেরা দশে থাকা একমাত্র নন–ব্রিটিশ খেলোয়াড় কিন্তু সালাহই।

আরও পড়ুন

গুঞ্জন আছে, এ মৌসুম শেষেই লিভারপুল ছেড়ে যাবেন সালাহ। গুরু ক্লপের বিদায় ঘোষণার পর সালাহরও নাকি আর মন বসছে না। তবে সালাহ যদি চলেও যান, অ্যানফিল্ডের আত্মায় এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন এ ফারাও। লিভারপুল এবং সালাহ এখন আর বিচ্ছিন্ন কিছু নন। অনেক বছর পর মার্সেসাইড অঞ্চলের গাছ–লতা–গুল্ম–পাতাগুলোও শোনাবে তাঁর রেখে যাওয়া রূপকথার গল্প। যে গল্পে নাগরিক থেকে দৌড়ে মাইক্রোবাস ধরা একটি ছেলে লিভারপুল রোডে এসে অমর হয়ে যাবেন!