মেসির হাতে অগ্নিস্নানে শুচি, মেসির পথেই ইয়ামাল

স্পেন উইঙ্গার লামিনে ইয়ামাল। স্পেন ফাইনালে ওঠার পর তার উল্লাসএএফপি

‘স্পিক নাউ!’, ‘স্পিক নাউ!’

মিউনিখে তখন শেষ বাঁশি বেজেছে। ১৬ বছর বয়সী ছেলেটির উচ্ছ্বাসেও যেন জোয়ার নামল। বালকসুলভ মুখখানিতে ফুটল বিশ্বজয়ের হাসিও। ক্যামেরা দেখে নিজেই দুই কদম এগিয়ে সে বারবার ওই কথাটি বলছিল। কণ্ঠের আবেগটা রাখলে বাংলা অর্থে একটু কর্কশই লাগে—‘বলো! কত পারো এখন বলো!’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনার গ্যালারিতে স্প্যানিশ সমর্থকেরা ততক্ষণে জেনে গেছেন ছেলেটির ওই কথার কী হেতু। তবু আবেগের দমকে দু-একজন স্প্যানিশ হয়তো ভেবে নিয়েছেন, এ তো সাক্ষাৎ দেবশিশু! নাহ, অন্য কিছু হতেই পারে না!

আরও পড়ুন

দেবশিশু? সেটাও আবার এখনকার এই উত্তর–আধুনিক দুনিয়ায়? ‘মহেশ’ গল্পের তর্করত্ন বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, শখ কত! মানুষ জোটে না দেবশিশুর শখ! স্প্যানিশ সমর্থকেরাও তখন হয়তো নাছোড় হয়ে পাল্টা বলতেন, হ্যাঁ, লামিনে ইয়ামাল রক্তমাংসের মানুষই। কিন্তু তাঁর জীবনপথে সৃষ্টিকর্তা এবং ‘দেবতা’র যে অদ্ভুত অলৌকিক স্পর্শ তার কী ব্যাখ্যা? ব্যাপ্টিজম অব ফায়ার? মানে অগ্নিস্নানে শুচি?

কথাগুলো হায়ারোগ্লিফিক মনে হলে গল্পটা আগে বলা ভালো। এই গল্প ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’কে বলেছেন ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী হুয়ান মনফোর্ত। এমনিতেই বলেননি। গত সপ্তাহে লামিনে ইয়ামালের বাবা নিজের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলে একটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দিয়েছিলেন, ‘দুই কিংবদন্তির যাত্রা শুরু’। কোন সে ছবি নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন।

প্লাস্টিকের একটি বড় গামলার মধ্যে ছয় মাস বয়সী একটি শিশু। লিওনেল মেসি সেই গামলার পাশে আয়েশ করে বসে শিশুটিকে গোসল করাচ্ছেন। এমন আরও কিছু ছবি আছে। গোসল করানোর পর মেসির কোলে শিশুটির ছবিও প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই শিশু কে—এত দিনে সেটাও আপনার জানা। কিন্তু কীভাবে দুটি চরিত্র ছবিতে একসূত্রে গাঁথা পড়ল, তা এ পৃথিবীর অলৌকিক সব গল্পের মতোই বিস্ময়। পার্থক্য একটাই—ওগুলো গল্প আর এটা বাস্তবতা। কথায় যেমন আছে, সত্য কখনো কখনো গল্পকেও হার মানায়!

মনফোর্ত সেই অলৌকিক সত্যকেই দেখেছেন সবচেয়ে কাছ থেকে। সেটা ২০০৭ সালের হেমন্ত। বার্সেলোনার মাঠ ক্যাম্প ন্যুর ভিজিটর্স লকাররুমে একটি ফটোশুটের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘দারিও স্পোর্ত’ এবং ইউনিসেফের পরিচালনায় বার্ষিক চ্যারিটির অংশ হিসেবে ক্যালেন্ডারের জন্য বার্সার খেলোয়াড়েরা বেশ কয়েকটি পরিবারের শিশুদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। এর মধ্যে মেসি দাঁড়িয়েছিলেন ইয়ামাল এবং তাঁর মায়ের পাশে।

আরও পড়ুন

কেউ বলে দেয়নি কিংবা কোনো নির্দেশনাও ছিল না। প্রকৃতিই দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। মনফোর্ত এরপর বলেছেন গল্পের সবচেয়ে আশ্চর্যকর অংশটুকু—ফটোশুটের শিশু বেছে নিতে ‘ইউনিসেফ লটারির আয়োজন করেছিল রোকা ফোন্দা অঞ্চলে, যেখানে লামিনের পরিবার বাস করত। ক্যাম্প ন্যুতে বার্সার খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিজের বাচ্চার ছবি তুলতে তারাও লটারিতে অংশ নেয় এবং জিতেছিল।’

এবার একটি রচনামূলক প্রশ্ন—ইয়ামালের বেড়ে ওঠার পথটা আপনার জানা। মেসির মতোই উঠে এসেছেন বার্সার ফুটবল খামার ‘লা মাসিয়া’ থেকে। প্রতিভার দ্যুতি ছড়ানোয় খুব অল্প বয়সেই বার্সার মূল দলে তাঁকে তুলে আনেন সাবেক কোচ জাভি হার্নান্দেজ। তারপর থেকে ইয়ামাল মাঠে নামলেই যেন টুপটাপ করে হেমন্তের ঝরাপাতার মতো খসে পড়ে রেকর্ড! বার্সেলোনা ও স্পেন দলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়, ইউরোয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়—চাইলে ইয়ামালের নামের পাশে এমন আরও কিছু সর্বকনিষ্ঠের রেকর্ড যোগ করা যায়। খুব অল্প বয়সে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে নেমে পড়ায় কেউ কেউ বলেন, এসব রেকর্ড তো সে জন্যই। বটে! ওই যে নেমে পড়াটা—সেটা কিন্তু অমিত প্রতিভার বলেই। মেসিরও তা–ই। ১৭ বছর আগে ইয়ামালকে মেসি যখন গোসল করাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২০ বছর। তত দিনে সর্বকনিষ্ঠের বেশ কিছু রেকর্ড তাঁর হয়েছে, লোকেও বলাবলি করছে নির্ঘাত কিংবদন্তি হওয়ার পথে। পরে তো মেসি কারও কারও চোখে ফুটবলের ‘দেবতা’ও হলেন। এখন প্রশ্ন হলো, এটা কি শুধুই ভাগ্যের খেল? নাকি কল্পনার মানসপটে তাকিয়ে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত একটি বার্তাও ধরে ফেলা সম্ভব?

অনেকটাই খ্রিষ্টধর্মে ‘ব্যাপ্টিজম’–এর মতো। ব্যাপারটি আরও ভালো করে বুঝতে কল্পনার ঘুড়ি আরেকটু ওড়াতে হবে। খ্রিষ্টধর্মে পাদরি বাচ্চাকে গোসল করিয়ে তাকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। ফুটবলীয় ভাষায় ইয়ামালের সেই গোসলকে তাই এভাবেও দেখা যায়, সৃষ্টিকর্তা অনুচ্চারে তাঁর ‘ফুটবল-দেবতা’কে দিয়ে ইয়ামালকে গোসল করিয়ে দেবশিশুর মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু তবু তো ইয়ামালের নামের পাশে ‘শিশু’ শব্দটি থাকছেই। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল আর যা–ই হোক শিশুদের জায়গা নয়।

আরও পড়ুন

ইয়ামালকে তাই বড় হতেই হতো। কিন্তু ফুটবল মাঠে ‘বড়’ হয়ে উঠতে প্রয়োজন বড় মঞ্চে বড় কীর্তি। মেসির মতো। পেছন ফিরে তাকালে দেখবেন, মেসি কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথে স্মরণীয় কিছু ম্যাচ উপহার দিয়েছেন। হেতাফের বিপক্ষে সেই ‘সলো’ রানে গোল কিংবা ২০১৮ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে অসাধারণ ফিনিশ। এমন প্রচুর আছে তাঁর ক্যারিয়ারে। ইয়ামালও সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়তে গড়তে তার প্রায় এক বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় মঞ্চটা পেয়েছিলেন গতকাল রাতে মিউনিখে—ইউরোর সেমিফাইনাল! সেখানে কি দেখা গেল?

সেখানে যা দেখা গেল, সেই বিবরণীতে যাওয়ার আগে পটভূমিও তো তাৎপর্যপূর্ণ। সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ ফ্রান্সের মিডফিল্ডার আদ্রিয়াঁ রাবিও ম্যাচের আগে একটু চাপেই ফেলেছিলেন ইয়ামালকে। ১৬ বছর বয়সী ছেলেটির জন্য ইউরোর সেমিফাইনাল তার ওজনের চেয়ে বেশি হয়ে যায় কি না—এমন প্রশ্নে রাবিও বলেছিলেন, ‘অবশ্যই...ফাইনালে উঠতে হলে সে এখন পর্যন্ত যা করেছে, তার চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে।’ ইয়ামাল এই কথা শুনে ভড়কে গেলে আজ আর এত কল্পনার ঘুড়ি ছোটানোর কসরত করতে হতো না। বয়সে খাটো হলেও মাথাটা যে বেশ চিকন, সেটি ম্যাচের আগেই বুঝিয়ে দেন স্প্যানিশ উইঙ্গার। ইনস্টাগ্রামে করা পোস্টে লিখেছিলেন, ‘নিঃশব্দে এগিয়ে যাও। কথা বলো শুধু চেক মেটের সময়।’

রাবিও সম্ভবত জানতেন না, ফ্রান্সের জালে এই ছেলেটির বাঁকানো ‘মিসাইল’ ছোড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। গত বছর হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে ডান প্রান্তে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের বাঁকানো শটে চোখধাঁধানো গোল করেছিলেন ফ্রান্সের জালে। এক বছর পর সেই ছেলেটিই ফ্রান্সের মূল দলের বিপক্ষে ওই গোলেরই যেন ‘কপি-পেস্ট’ উপহার দিল!

এবার অবশ্য পুরোপুরি ডান কোনা থেকে নয়, বক্সের ডান দিকে একটু পেছনে ছিলেন। দূরত্ব প্রায় ২৭ গজ। সেখান থেকে তাঁর বাঁ পায়ের শট ধনুকের মতো বেঁকে ফরাসি গোলকিপারের জীবন বাজি রাখা ডাইভকেও ফাঁকি দিয়ে দূরের পোস্ট দিয়ে জালে! গোলটি দেখে কি বার্সেলোনায় মেসির সোনাঝরা দিনগুলো মনে পড়েছে? সেই তো একই কাট-ইন, একই রকম বাঁ পায়ের বাঁকানো বিষাক্ত শট!

ইয়ামাল সম্ভবত এবার ইউরোর সেরা গোলটি করেছেন বলেই মেসির হাতে গোসলের সেই ছবির গল্পে কল্পনার ঘুড়ি ছুটিয়ে দেবতা ও দেবশিশুর মধ্যে পরম্পরা বিনিময় নিয়ে কথা হচ্ছে। বড় মাপের খেলোয়াড়েরা সমর্থকদের কল্পনাশক্তিকে এভাবেই নিজ গুণে বাঁকিয়ে ফেলেন। এটা তাঁদের সামর্থ্য। আর তাই গতকাল রাতে ইয়ামালের গোলটি কারও কারও কাছে মানুষরূপী আর্জেন্টাইন ফুটবল-দেবতার সেই গোসল করানোর প্রতি অর্ঘ্য। বাঁকানো রংধনুর মতো সেই অর্ঘ্য (বল) দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ারটাই বোঝানো সম্ভব। কিক নেওয়ার পর বলের যাত্রার শুরুটুকু যদি হয় স্বপ্ন, মাঝপথটুকু তবে সামর্থ্য আর জাল ছোঁয়াটা রীতিমতো দুঃসাহসের প্রকাশ!

ফুটবলের ভাষায় এটাই হয়তো সমতাসূচক গোল, কিন্তু রাবিও-এর জন্য তো অন্য কিছু। চেক মেট! তবে ইয়ামাল কিন্তু কথা রেখেছেন। কোনো কথা না বলে একদম শেষ বাঁশি বাজার পর বলেছেন ‘বলো! এখন বলো!’ কাকে? সেটা আপনি জানেন।

শুধু রাবিও কেন, গোলটি দেখে ম্যাচ শেষেও তো অনেকে মূক ও বধির! রেশ যে কাটেনি। রাবিও নিজেও জানেন, আজ থেকে বহু বছর পর যখন এই ম্যাচের গল্প উঠবে, তখন সেই গল্পের শিরোনাম স্পেন নয়, ইয়ামালের অবিশ্বাস্য সেই গোলটি। কারণটা বিবিসি ওয়ান-কে বলেছেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার, ‘একজন মহাতারকার জন্ম হলো। (গোলটি) এটা ম্যাচের সেরা মুহূর্ত, সম্ভবত টুর্নামেন্টেরই সেরা মুহূর্ত।’ স্পেন কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তে সেরেছেন আরও অল্প কথায়, ‘আ টাচ অব জিনিয়াস!’

কিন্তু ফুটবলে জিনিয়াস কম নেই। ঝাঁকের কইয়ের মতো প্রতি মৌসুমেই আসছে। সেই মিছিলে ইয়ামালের প্রতিভার স্ফুরণ কেন তাঁকে আলাদা করে চেনাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে উঠে আসে আরেকটি প্রশ্ন আন্তর্জাতিক ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে কিংবা মহাদেশীয় মঞ্চে খুব অল্প বয়সে অমিত প্রতিভাধর খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গ উঠলে কার নামটা সবার আগে উঠে আসে? পেলে! ছেলেদের বড় টুর্নামেন্টে এত দিন সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ডটি ছিল প্রয়াত ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির দখলে (১৭ বছর ২৩৯ দিন)। ইয়ামাল ইউরোর ইতিহাসে গতকাল রাতে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি পেছনে ফেলেন পেলেকেও। গোলটি যে করেছেন ১৬ বছর ৩৬২ দিন বয়সে!

অবিশ্বাস্য গোলের পর সতীর্থদের সামনে উদ্‌যাপনে মত্ত ইয়ামাল
২০২৪ ইউরো এক্স হ্যান্ডল

অর্থাৎ, বার্লিনে ইউরো ফাইনালের আগের দিন ১৭তম জন্মদিনের কেক কাটবেন। ইউরোয় খেলতে জাতীয় দলের সঙ্গে জার্মানিতে উড়াল দেওয়ার পর তাঁর স্কুল পরীক্ষার ফল বাসার চিঠির বাক্সে জমা পড়েছে। ১৬ বছর বয়সে ছেলেপুলে যেখানে স্কুলের পরীক্ষার ফল নিয়ে ভেবে ভেবে জীবন জেরবার করে, ইয়ামালকে সেখানে ভাবতে হচ্ছে দেশ নিয়ে। দৃষ্টিপাতটা আরও গভীর করলে সেই ভাবনাটা আসলে ভার—দেশের মানুষের স্বপ্নকে নিজ কাঁধে বহনের ভার।

যেমনটা করেছেন পেলে থেকে মেসি। ইয়ামালও নেমেছেন সেই পথে। বাকিটা তিনি জানেন!