রিয়ালের গ্যালারিতে এক টুকরা বাংলাদেশ এবং পেরেজের হাতে যেভাবে নকশিকাঁথা

বাংলাদেশের রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ দলের বিশেষ জার্সি হাতে তুলে দেওয়া হয় ক্লাবটির সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকেপেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সৌজন্যে

‘১২ নম্বর জার্সি আবেগের ঝোড়ো বাতাসকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত করতে পারে, যা ঘুমিয়ে পড়া বলকেও দুরন্ত গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে। দলের ১১ জন খেলোয়াড় জানে, ভক্তরা না থাকলে তাদের খেলাটা নিছকই বাজনা ছাড়া নাচার মতো ব্যাপার হবে।’—গ্যালারি উন্মাতাল করা সমর্থকদের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়া সাহিত্যিক ও লেখক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো লিখেছিলেন এই কথাগুলো।

সমর্থন বা সমর্থক এমনই! ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা যেমনটা বলেছিলেন, ‘তুমি বাড়ি, গাড়ি, ধর্ম, রাজনীতি কিংবা নারী বদলাতে পারো, কিন্তু কখনো প্রিয় ফুটবল দল বদলাতে পারো না।’ ফুটবলের প্রতি এই আবেগই খেলাটিকে বৈশ্বিকভাবে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। আর সমর্থনের সেই টানই বাংলাদেশের একদল সমর্থককে ঢাকা থেকে নিয়ে গেছে ৫ হাজার ২৩৫ কিলোমিটার দূরের শহর জেদ্দায়। যেখানে গ্যালারিতে বসে প্রিয় দল রিয়াল মাদ্রিদের স্প্যানিশ সুপার কাপের খেলা উপভোগ করেছেন ক্লাবটির চার বাংলাদেশি সমর্থক।

আরও পড়ুন

এই চার সমর্থক বাংলাদেশে রিয়ালের সমর্থকগোষ্ঠী পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সংগঠকও বটে। রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিই মূলত এই সমর্থকদের জন্য গ্যালারিতে বসে খেলা উপভোগ করার এবং রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যে চার সমর্থক এই সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা হলেন পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সভাপতি মো. তানবীর হোসেন, সম্পাদক সিফাত জসিম, কাজী ফারহান শাহরিয়র ও সামিয়া রহমান।

সৌদি আরব স্প্যানিশ সুপার কাপ আয়োজন শুরু করার পর থেকেই সেখানে গিয়ে রিয়ালের খেলা দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তবে এবার ছয় মাসে আগে থেকেই সংগঠনের কর্তারা যেকোনো মূল্যে খেলা দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই লক্ষ্যে এক মাস আগে পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রিয়ালকে টিকিটের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এরপর গত ১২ ডিসেম্বর রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষ থেকে পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের জন্য চারটি টিকিট বরাদ্দ করা হয়।

বাংলাদেশের রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক দল পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সভাপতির হাতে রিয়ালের বিশেষ জার্সি তুলে দেন ক্লাবটির সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ
পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সৌজন্যে

টিকিট নিশ্চিত হওয়ার পর অপেক্ষা ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। তবে কে জানত, জেদ্দায় রিয়াল সমর্থকদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও বড় চমক। সাধারণত সমর্থকদের মিলনমেলার অনুষ্ঠানগুলোতে পেরেজ নিজে উপস্থিত থাকেন না। এরপরও বাংলাদেশি সমর্থকদের মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে পেরেজের সঙ্গে দেখা হতেও পারে। যে কারণে অন্যান্য উপহারের সঙ্গে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের নাম লেখা বাংলাদেশের একটি জার্সিও সঙ্গে নিয়ে যান তাঁরা।

ইভেন্টের দিন সংগঠনের সভাপতি মো. তানবীর হোসেন প্রথমে পেরেজের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি পেরেজকে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর হাতে বিশেষভাবে তৈরি করা জার্সিটি উপহার দেন। সেই সময় বাংলাদেশের মাদ্রিদিস্তাদের পক্ষ থেকে পেরেজকে একটি নকশিকাঁথাও উপহার দেওয়া হয়। বিপরীতে রিয়ালের বিশেষ একটি জার্সি পেরেজ তুলে দেন পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সভাপতি তানবীর হোসেনকে।

২০১১ সালের ১১ জুন ৬০ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিয়াল সমর্থকগোষ্ঠীদের সংগঠন পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা।

গ্যালারিতে বসে রিয়ালের খেলা দেখার অনুভূতি জানতে চাইলে পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সিফাত জসিম বলেছেন, ‘গ্যালারিতে বসে প্রিয় ক্লাব রিয়ালকে সমর্থন জানানোর অভিজ্ঞতা ছিল আবেগে ভরপুর এবং অবিস্মরণীয়। মাঠে থাকা হাজার হাজার সমর্থকের সঙ্গে একত্রে গলা মিলিয়ে ক্লাবের স্লোগান দেওয়া, প্রতিটি আক্রমণ এবং গোলের মুহূর্তে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া—এমন অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন। মাঠের পরিবেশ, গ্যালারির উত্তেজনা এবং খেলোয়াড়দের একদম কাছ থেকে দেখা, এগুলো সবকিছুই আমাদের জন্য নতুন এবং অনন্য ছিল।’

রিয়ালের গ্যালারিতে এক টুকরা বাংলাদেশ
পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সৌজন্যে

এই অভিজ্ঞতা চিরকাল হৃদয়ে জায়গা করে নেবে জানিয়ে জসিম আরও বলেছেন, ‘এই অভিজ্ঞতা শুধু একটি খেলা দেখা নয়, বরং এটি ছিল আমাদের ভালোবাসার ক্লাবের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের একটি অসাধারণ স্মৃতি। এটি এমন একটি দিন, যা আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থাকবে।’

মাঠে বসে রিয়ালের খেলা দেখার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর নিজেদের পরবর্তী লক্ষ্য নিয়ে জসিম বলেন, ‘পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের পরবর্তী লক্ষ্য সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে গিয়ে রিয়ালের খেলা দেখা। পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের রিয়াল সমর্থকগোষ্ঠীদের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এ ছাড়া স্প্যানিশ সুপার কাপ যত দিন সৌদি আরবে হবে, প্রতিবারই যাওয়ার ইচ্ছা আছে আমাদের।’

পেরেজের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে নকশিকাঁথা
পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সৌজন্যে

২০১১ সালের ১১ জুন ৬০ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিয়াল সমর্থকগোষ্ঠীদের সংগঠন পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা। সে সময় তাঁদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মাদ্রিদ সমর্থকদের সংঘবদ্ধ করা। যাত্রা শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অবলম্বন করে ডানা মেলতে শুরু করে সংগঠনটি। বর্তমানে সংগঠনটির নিবন্ধিত সদস্যসংখ্যা ৪৫০। শুরুতে ফেসবুক গ্রুপ ও বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে গেট টুগেদার, ম্যাচ স্ক্রিনিং এবং অন্যান্য ইভেন্টের মাধ্যমে জোটবদ্ধ হতে থাকেন সংগঠনের সদস্যরা। শুরু থেকেই সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল রিয়ালের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া।

আরও পড়ুন

নানা চ্যালেঞ্জিং পথ পেরিয়ে অবশেষে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর রিয়ালের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশ। বর্তমানে মাদ্রিদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংগঠনটির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের ফুটবলের জন্য কিছু করতে চায় পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশ। রিয়ালের কাছ থেকে বিশেষভাবে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা নিয়ে দেশের ফুটবল একাডেমিগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পরিকল্পনাও আছে তাদের।

পেরেজের সঙ্গে পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সিফাত জসিম
পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের সৌজন্যে

পেনিয়া মাদ্রিদিস্তা বাংলাদেশের লক্ষ্য শুধু দেশের ফুটবল উন্নতিতে সহায়তা করাই নয়, বরং তরুণ প্রতিভাদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছানোর সুযোগও তৈরি করতে চায় তারা। তাদের স্বপ্ন, রিয়ালের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের ফুটবলও নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করুক।