১৩৫ বছরে যা হয়নি, এবার কি তা করতে পারবে গার্দিওলার সিটি
প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয় থেকে আর মাত্র এক ধাপ দূরে ম্যানচেস্টার সিটি। শেষ ধাপটি পেরোতে পারলে ১৩৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা চার লিগ শিরোপা জেতার ইতিহাস গড়বে পেপ গার্দিওলার দল। এর আগে ইংল্যান্ডের কয়েকটি ক্লাব ৫ মৌসুমের মধ্যে চারটি শিরোপা জিতলেও টানা চার শিরোপা জিততে পারেনি কোনো দলই। ১৮৯০–এর দশকে অ্যাস্টন ভিলা এবং ১৯৮০ দশকে লিভারপুল পাঁচ মৌসুমের মধ্যে চারবার লিগ শিরোপা জেতার কীর্তি গড়েছিল।
এ ছাড়া হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতার কৃতিত্ব আছে হাডার্সফিল্ড টাউন (১৯২৬–২৭), আর্সেনাল (১৯৩৫–৩৬), লিভারপুল (১৯৮৪–৮৫) এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের (২০০১–০২ এবং ২০০৯–১০)। কিন্তু গার্দিওলার দলের সামনে ইতিহাস নতুন করে লেখার হাতছানি।
সেই দলগুলোর ইতিহাস গড়তে না পারার কিছু কারণও আছে। তবে গার্দিওলার সিটি সেই ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়েই এখন ইতিহাস গড়ার অপেক্ষায় আছে। যদিও আরেকটি বাধা পেরোতে হবে তাদের। প্রশ্ন হচ্ছে, এর আগে যে দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে, তাদের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল? খেলাধুলাভিত্তিক পোর্টাল দ্য অ্যাথলেটিক সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে সেই কারণগুলো অনুসন্ধান করেছে।
কোচ বদল
ফুটবলে সাফল্য ও ব্যর্থতার অনেকটাই নির্ভর করে কোচদের ওপর। একজন যোগ্য ও কৌশলী কোচ একটি গড়পড়তা মানের দলকে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিতে পারেন। চলতি মৌসুমে অজেয় বায়ার লেভারকুসেনের দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যাবে। যেখানে জাবি আলোনসো একাই ইতিহাস বদলে দিয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে তেমনই কিংবদন্তি কোচ ছিলেন হাবার্ট চাপম্যান। যিনি ১৯২১ সালে হাডার্সফিল্ডের কোচ হয়ে এসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন।
তাঁর হাত ধরেই ক্লাবটি একপর্যায়ে সাফল্যের শিখর ছুঁয়েছিল। তাঁর অধীনেই হাডার্সফিল্ড ১৯২৩–২৪ ও ১৯২৪–২৫ মৌসুমে শিরোপা জিতেছিল। এরপর আর্সেনাল চাপম্যানকে কিনে নিলেও তাঁর পদছাপ অনুসরণ করে হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতেছিল হাডার্সফিল্ড। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটিই হাডার্সফিল্ডের সর্বোচ্চ লিগে শেষ শিরোপা হয়ে আছে। মূলত চ্যাপমানে আসা ও যাওয়াতেই হাডার্সফিল্ডের ভাগ্যের সঙ্গে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। যে কারণে জেতা হয়নি টানা চতুর্থ শিরোপাটিও।
ইউনাইটেড অবশ্য ভিন্ন এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। ১৯৯৯ ঐতিহাসিক ট্রেবল জেতে স্যার আলেক্স ফার্গুসনের ইউনাইটেড। এরপর ১৯৯৯–২০০০ সালে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জেতে দলটি। পরে পূরণ করে লিগ জেতার হ্যাটট্রিকও। সেবার লিগ জেতার পর এক দ্রুত অবসরে যাওয়ার সিদ্ধাান্তের কথা জানান ফার্গুসন। এই ঘোষণা পুরো দলকে অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। যার প্রভাব পড়ে মাঠের পারফরম্যান্সেও। ফলে পরের মৌসুমে আর লিগ জিততে পারেনি দলটি। এভাবে বিভিন্ন সময় কোচদের সিদ্ধান্ত ও দলবদলের প্রভাবে দলের সাফল্যও নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যেখান সিটির সাফল্যের মূলে রয়েছে গার্দিওলার থেকে যাওয়া।
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ক্লাব ছেড়ে যাওয়া
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা একটি ক্লাবকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ১৯৮০–এর দশকে সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছিল লিভারপুল। আর ‘অল রেড’দের এই সাফল্যের অন্যতম বড় কারিগর ছিলেন গ্রায়েম সোনেস। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে লিভারপুলের হয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপাসহ ৫টি লিগ জেতেন সোনেস। কিন্তু ১৯৮৪ সালে লিভারপুল ছেড়ে সাম্পাদোরিয়ায় চলে যান এই মিডফিল্ডার। যার প্রভাব পড়ে লিভারপুল পারফরম্যান্সেও। পরের মৌসুমে আর শিরোপা জেতা হয়নি ক্লাবটির।
ফলে জেতা হয়নি টানা চতুর্থ শিরোপাটিও। লিভারপুলের বিপরীতে সিটিতে গার্দিওলার সাফল্যের দিকে তাকালে আমরা দেখব দলের মূল তারকাদের বেশির ভাগই সিটির সঙ্গেই থেকে গেছেন। গত ছয় মৌসুমে সিটির হয়ে পাঁচ শিরোপা জেতা এদেরসন, কেভিন ডি ব্রুইনা, জন স্টোনস ও বের্নার্দো সিলভা দলের সঙ্গেই আছে। এ ছাড়া হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতা একাধিক খেলোয়াড়ও আছেন সিটির সঙ্গে। ফলে দলের মূল খেলোয়াড়দের নিয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয়নি গার্দিওলাকে।
অন্য শিরোপার প্রভাব
ফার্গুসনের অধীনে ইউনাইটেড ১৩টি লিগ শিরোপা জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে মাত্র ২টি। নিজের সময়ে আরও বেশি ইউরোপিয়ান শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ আছে ফার্গুসনের। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতায় মরিয়া মনোভাবে দলটির ঘরোয়া পারফরম্যান্সেও প্রভাব ফেলেছে। ২০০৯–১০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালে অ্যাওয়ে গোলের কারণে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে বিদায় নেয় ইউনাইটেড।
সেই ধাক্কা এসে পড়ে লিগ ম্যাচেও। তিন দিন পর ব্ল্যাকবার্নের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে তারা। সেই ড্রই পরে চেলসির কাছে এক পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে শিরোপা হারানোর কারণ হয়। এর ফলে টানা চার শিরোপাও আর জেতা হয়নি ক্লাবটির। সিটিও অবশ্য একই ধরনের অভিজ্ঞতা পেতে পারত। চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে তারা। তবে এই বিদায় গার্দিওলার দলের মনঃসংযোগে কোনো চিড় ধরাতে পারেনি। সর্বশেষ ৮ লিগ ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে এখন শিরোপার দ্বারপ্রান্তে তারা।
নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব
১৯৩৫–৩৬ মৌসুমে আর্সেনালের সম্ভাব্য চতুর্থ শিরোপাটি নিজেদের দখলে নেয় স্যান্ডারল্যান্ড। সেটি ছিল ১৯১২–১৩ মৌসুমের পর তাদের প্রথম শিরোপা। এমনকি ১৯৩৪–৩৫ মৌসুমেও পয়েন্ট তালিকার ছয়ে শেষ করে তারা। নতুন এই শক্তির আবির্ভাব সামলানোর জন্য প্রস্তুত ছিল না গানাররা। ফলে জেতা হয়নি টানা চতুর্থ শিরোপাটিও। হাডার্সফিল্ডকেও একই ধরনের ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল। ১৯০৮–০৯ সালের পর সেবারই প্রথম শিরোপা জিতেছিল নিউক্যাসল। সেটি অবশ্য এখন পর্যন্ত তাদের শেষ শিরোপা হয়ে আছে। আর নিউক্যাসলের কারণে ১৯২৬–২৭ মৌসুমে চতুর্থ শিরোপা অধরা থেকে যায় হাডার্সফিল্ডের।
১৯৮৪–৮৫ মৌসুমে লিভারপুলকে চতুর্থ লিগ ট্রফিতে হাত রাখতে দেয়নি এভারটন। তারাও অনেকটা আকস্মিক উত্থানে লিগ শিরোপা জিতেছিল সেবার। ১৯৬৯–৭০ মৌসুমের পর যেটি ছিল এভারটনের প্রথম শিরোপা। গার্দিওলার সিটিকে অবশ্য এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে অন্যভাবে। ২৯ বছর পর ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল ২০১৯–২০ মৌসুমে শিরোপা না জিতলে এত দিনে টানা ছয়টি লিগ শিরোপা জেতা হয়ে যেত সিটির। এর মধ্যে আরও দুবার শেষ দিনে গিয়ে মাত্র এক পয়েন্টের জন্য লিগবঞ্চিত হয়েছে লিভারপুল। এবার সিটি যদি শেষ দিনে ওয়েস্টহামের কাছে পয়েন্ট হারিয়ে আর্সেনালকে ২০ বছর পর লিগ শিরোপা উদ্ধারের সুযোগ করে না দেয়, তবে এখনো না হওয়া ইতিহাসটায় লেখা হবে তাদের নাম।