যাঁকে নিয়ে ৮ কোটি ইউরোর বাজি রিয়ালের
বার্নাব্যুকে শুরুতেই চমকে দিয়েছেন অরেলিয়াঁ চুয়ামেনি। অবশ্য তাঁর দলবদলের পুরো ব্যাপারটাই চমক জাগানো। মূলত রক্ষণের জন্য পরিচিত এক মিডফিল্ডারের জন্য রিয়াল মাদ্রিদ এককালীন আট কোটি ইউরো খরচ করেছে, শর্তসাপেক্ষে যা ১০ কোটি ইউরো হয়ে যেতে পারে। নেইমারের দলবদল-উত্তর যুগেও অঙ্কটা বাড়াবাড়ি ঠেকছিল অনেকের কাছে। এ মৌসুমের দলবদলে দামের হিসাবে তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আর কারও নেই বললেই চলে।
গত ১৪ জুন এই ফরাসি মিডফিল্ডারকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের খেলোয়াড় বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে রিয়াল। এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে একটা কথা এখন আর শোনার অপেক্ষা করেন না সাংবাদিকেরা। আগে থেকেই লিখে রাখেন, ‘চুয়ামেনি বললেন, “আমি রিয়াল মাদ্রিদের ভক্ত। ছোটবেলা থেকে এই ক্লাবে খেলার স্বপ্ন দেখছি।”’ এটা যেকোনো বড় দলের ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক।
চুয়ামেনি ওসবের ধার ধারেননি, প্রথম সংবাদ সম্মেলনে স্প্যানিশ ভাষায় নিজের দক্ষতা দেখিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বের সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে আমার গল্প শুরু করতে পেরে খুবই খুশি। এই ক্লাবে আরও অনেক শিরোপা এনে দিতে কঠোর পরিশ্রম করব।’ আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেই যে শুধু এটা বলেছেন, তা নয়। প্রথম দিনে সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে ক্লাবভবন ঘুরে দেখতে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি রাখা রুমেও গিয়েছিলেন। ১৪টি ট্রফি দেখে পেরেজকে নাকি বলেছেন, রুমটা আরেকটু বড় করা দরকার, কারণ আরও কিছু ট্রফি রাখতে হবে!
লিভারপুল ও পিএসজির ডাক উপেক্ষা করে চুয়ামেনির রিয়াল মাদ্রিদকে বেছে নেওয়ার পেছনে এই চ্যাম্পিয়নস লিগই ভূমিকা রেখেছে, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের আগেই রিয়াল মাদ্রিদ ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। পিএসজি, সিটি ও চেলসির সঙ্গে প্রত্যাবর্তনগুলো দেখার পর আমি এখানেই আসতে চেয়েছি। আমার এজেন্টকে বলেছিলাম, যেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।’
২০২২ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ রিয়াল যেভাবে জিতেছে, তাতে ২২ বছর বয়সী কোনো তরুণ ফুটবলারের মাথা ঘুরে যেতেই পারে। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ কেন একজন মিডফিল্ডারের পেছনে এত অর্থ ব্যয় করছে, যিনি পেশাদার ফুটবলের কোনো মৌসুমেই ৫টির বেশি গোল করতে পারেননি। সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোতেও যে খুব খ্যাতি আছে, এমন নয়। ক্লাব ফুটবলে তিন মৌসুমে সতীর্থদের মাত্র আটটি গোলে সহযোগিতা করেছেন।
মাঝমাঠে আছেন লুকা মদরিচ, টনি ক্রুস, কাসেমিরো। বিকল্প হিসেবে ফেদেরিকো ভালভার্দে ও এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা আছেন, যারা চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রতিটি প্রত্যাবর্তনেই নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। এমন এক দল কেন চুয়ামেনির পেছনে এত বিনিয়োগ করল?
রিয়াল মাদ্রিদ স্কোয়াডে যদি সত্যিকার অর্থেই কারও বিকল্প না থাকে, তিনি কাসেমিরো। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার দলে না থাকলে সে জায়গা পূরণ করতে পারেন না কেউ। কামাভিঙ্গাকে সে দায়িত্ব দিয়ে কোনো ফল পাননি কোচ কার্লো আনচেলত্তি। ক্রুস বা ভালভার্দেও ঠেকায় পড়ে এ কাজ করতে কখনো স্বচ্ছন্দ নন। চুয়ামেনিকে এ দায়িত্ব দিতেই এনেছে রিয়াল।
কাসেমিরো ও চুয়ামেনির মধ্যে দারুণ মিল আছে। দুজনই কঠোর পরিশ্রমী এবং নিজেকে ভালো করার জন্য যা যা দরকার, সব করতে আগ্রহী। প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বুঝতে পরিসংখ্যানভিত্তিক একটি অ্যাপ ব্যবহার করেন কাসেমিরো। ওদিকে চুয়ামেনি প্রতিদিন নিজের খেলার ভিডিও দেখেন, বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন; কোথায় ভুল হলো, কোথায় আরও ভালো করা দরকার।
নিজেকে সেরা বানাতে আদর্শ বেছে নিতে চুয়ামেনি তাই শুধু ফুটবলে আটকে থাকেননি, বাস্কেটবলের মাইকেল জর্ডান ও কোবি ব্রায়ান্টদেরও অনুসরণ করেন। নিজেকে নিখুঁত করার ইচ্ছা থেকেই তো শৈশবেই ইংরেজি ভাষায় নিজেকে সাবলীল করেছেন, শিখেছেন স্প্যানিশও। এ কারণেই বিশ্বকাপের আগে নিয়মিত খেলা জরুরি জেনেও দলবদলের ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি তিনি।
স্প্যানিশ ক্লাবে কোথায় খেলতে চান, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন প্রথম দিনেই, ‘রিয়ালে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়েরা আছেন, তাই অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু আমি শরীর ও মাথা কাজে লাগিয়ে বল পুনরুদ্ধার করতে পারি। আমি সাধারণত ডাবল পিভটে (দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নিয়ে সাজানো ফরমেশন) খেলি, কিন্তু রিয়ালে ৪-৩-৩ ফরমেশনে আমাকে নম্বর ৬ হতে হবে। আমি অতীতে এ ভূমিকায় খেলেছি। কে জানে, আমি হয়তো ৮ নম্বরের ভূমিকাও নিতে পারি। যে ভূমিকাই হোক, আমার জন্য কোনো সমস্যা না।’
রিয়াল চুয়ামেনিকে পেতে এত খরচ কেন করেছে, সেটা বুঝতে হলে স্কোয়াডের দিকে তাকাতে হবে। মদরিচ সবাইকে এখনো মায়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছেন, ক্রুস এখনো আস্থার প্রতীক, আর কাসেমিরো তো আছেনই রক্ষণকে বিপদমুক্ত করতে। কিন্তু আগামী সেপ্টেম্বরে ৩৭ হবে মদরিচের। ৩২ বছর হলেও ক্রুস এরই মধ্যে অবসর নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।
মাঝমাঠে নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যাটন তুলে দিতে চাইছে রিয়াল। ২৩ বছর বয়সী ভালভার্দে ও ১৯ বছর বয়সী কামাভিঙ্গা গত মৌসুমে লিগে ও চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজ নিজ দায়িত্ব দারুণভাবে সামলেছেন। ভালভার্দে তো চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের একাদশে জায়গা দিতে আনচেলত্তিকে বাধ্যই করেছেন, ভিনিসিয়ুসকে দিয়ে শিরোপা এনে দেওয়া গোল করিয়েছেন। আর ফাইনালের পথে পিএসজি, চেলসি ও সিটির বিপক্ষে প্রতিটি প্রত্যাবর্তনে প্রভাবক ছিল বদলি হিসেবে কামাভিঙ্গার মাঠে নামা।
মদরিচ-ক্রুস-কাসেমিরোর পরিপূর্ণ বিকল্প খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। চেলসির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের ফিরতি লেগে পায়ের বাইরের দিক দিয়ে মদরিচের জাদুকরী সে পাস অন্য কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। নিখুঁত পাস দিয়ে পুরো মাঠে পাসের জাল বিছানোয় ক্রুসের তুলনা খুব কম। আর কাসেমিরো তো বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারই। বর্তমানে কোনো মিডফিল্ডারই আর এই ব্রাজিলিয়ানের মতো এত দারুণভাবে রক্ষণকে ভরসা দিতে পারেন না।
রিয়াল তাই অন্য উপায়ে এগিয়েছে। খেলোয়াড়টি যদি জিদান-ইনিয়েস্তা বা মদরিচ না হন, তবে মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সাধারণত তিনটি কাজ চাওয়া হয়। বল প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া, বল হারিয়ে ফেললে সেটা আবার পুনরুদ্ধার করা এবং সে বল প্রতিপক্ষের রক্ষণে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। একজন মিডফিল্ডারকে তিনটিই পারতে হয়। তবু একেকজনের দক্ষতা একেকদিকে বেশি থাকে। গত মৌসুমের পরিসংখ্যান বলছে, ট্যাকল করায় বা বল কেড়ে নেওয়ায় কামাভিঙ্গা ৯৯ পার্সেন্টাইলে আছেন (অর্থাৎ এ কাজে তাঁর চেয়ে ভালো মাত্র ১ ভাগ মিডফিল্ডার আছেন)। ওদিকে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ঢোকার ক্ষেত্রে ভালভার্দে আছেন ৯৭ পার্সেন্টাইলে। বল পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কামাভিঙ্গা বেশ ভালো হলেও এ ক্ষেত্রে রীতিমতো অবিশ্বাস্য চুয়ামেনি। গত মৌসুমে ম্যাচপ্রতি গড়ে ১১ বারের বেশি বল পুনরুদ্ধার করেছেন চুয়ামেনি! শীর্ষ পাঁচ লিগে তাঁর ধারেকাছে নেই কেউ।
মদরিচ-ক্রুস-কাসেমিররা মাঝমাঠে যেমন একে অন্যের ঘাটতি পূরণ করে দেন, ঠিক সেটাই ভালভার্দে, কামাভিঙ্গা ও চুয়ামেনিকে দিয়ে করতে চাইছে রিয়াল। অর্থাৎ, চুয়ামেনিকে দিয়ে আসলে ‘মিডফিল্ড-সেট’ পূরণ করে নিয়েছে রিয়াল। আর এ কারণেই তাঁকে ক্লাবের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় বানাতেও পিছপা হয়নি।
দলবদলের অঙ্কটা যে বেশি, সেটা জানেন চুয়ামেনিও, ‘যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, সেটা বর্তমান বাজার ও দুই ক্লাবের মধ্যকার ব্যাপার। এ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।’ তবে এই আট কোটি ইউরোর দলবদলকেও একসময় সস্তা বলে মনে করানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন চুয়ামেনি, ‘আমি জানি সর্বনিম্নটা দিয়ে কখনো সাফল্য পাব না। এ কারণে আমি সব সময় সর্বোচ্চটাই দিই।’