বিদায়, জাস্ট ফন্টেইন
এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করা ফরাসি কিংবদন্তি জাস্ট ফন্টেইন আজ মারা গেছেন। সংবাদ সংস্থা এএফপিকে খবরটি নিশ্চিত করেছে তাঁর পরিবার। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে একাই ১৩ গোল করে অমরত্ব পাওয়া এই কিংবদন্তিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন মেহেদী হাসান
বাদ রইলেন শুধু ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
হিসেবটা সবার জন্য নয়। এই হিসেব নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের। যাঁদের কাছে ইন্টারনেট ছিল না। ক্লিক করলেই খেলার জগৎ হাতের মুঠোয় আসেনি। চোখ রাখতে হয়েছে বিভিন্ন সাময়িকী কিংবা তা না হলে বাংলাদেশের ডায়েরি। ইউরোপের ক্লাব ফুটবল তখনো এই দেশে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। আগ্রহটা বিশ্বকাপ ফুটবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই আগ্রহের খোরাক মেটাতে গিয়ে কিশোর চোখগুলো বারবার চারটি নামে আটকে গেছে—পেলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, জাস্ট ফন্টেইন ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
নব্বই দশকের সেসব কিশোর আজ বড়দের কাতারে। বড় মানে অভিজ্ঞ, আর অভিজ্ঞ মানেই পোড়া চোখ—সেসব পোড়া চোখ খেলাধুলার জন্যও ভিজেছে মাঝেমধ্যে। এই তো ২০২০ সালে চলে গেলেন ম্যারাডোনা। পেলে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন গত ডিসেম্বরে। জাস্ট ফন্টেইনের কি তখন থেকেই মনটা উড়ু উড়ু করছিল?
জীবনের প্রায় সব রকম অভিজ্ঞতা পেতে ৮৯ বছর বয়স তো কম না। তাই বুঝি এই নীরব পলায়ন! আজ চলে গেলেন অন্যলোকে, পেলে-ম্যারাডোনাদের কাছে। একা রেখে গেলেন বেকেনবাওয়ারকে। বেকেনবাওয়ার ফন্টেইনকে বিদায় জানাতে গিয়ে অভিমানে বলতে পারেনই, ওখানে তবু পেলে-ম্যারাডোনাকে পাবে, কিন্তু এখানে যে আমি মৃত্যুর মতোই নিঃসঙ্গ, একা!
নব্বইয়ের প্রজন্মের কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে কারণ, শৈশবে এ চারজনের নাম শুনতে শুনতে অবচেতন মনেই তাঁরা কীর্তিমানের আসন পেয়েছিলেন। নামগুলো শুনলেই মনে হতো তাঁরা রক্ত–মাংসের মানুষ হয়েও রূপকথার নায়ক। মেয়াদ পূরণ হওয়ায় ভোরের শিউলি ফুলের মতো ‘নায়কেরা’ এখন ঝরে পড়ছেন। আর নব্বইয়ের প্রজন্ম থেকে বাকি সব প্রজন্মের ভক্তরাও যেন সেসব ‘শিউলি’ কুড়িয়ে জমা রাখছেন মনের গোপন কুঠুরিতে। আজ তেমনই একটি ‘শিউলি’ জমা পড়ল—জাস্ট ফন্টেইন! কীর্তিমান মারা গেছেন।
ফন্টেইন—নামটা শুনলে সবার আগে চোখে ভাসে একটি অমর রেকর্ড। এক বিশ্বকাপে একাই ১৩ গোলের অবিশ্বাস্য কীর্তি। পেলে যে বিশ্বকাপে নিজের আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছিলেন, সেই ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফরাসি কিংবদন্তির গড়া ১৩ গোলের সৌরভ আজও তাজা।
রেকর্ডটি কেউ ভাঙতে পারেনি, কখনো ভাঙবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেন কেউ কেউ। সেই সন্দেহে যুক্তিও আছে। মাত্র তিনজন ফুটবলার বিশ্বকাপে ফন্টেইনের চেয়ে বেশি গোল করেছেন—জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা (১৬), ব্রাজিলের রোনালদো (১৫) এবং জার্মানির গার্ড মুলার (১৪)।
ক্লোসাকে সে জন্য খেলতে হয়েছে চারটি বিশ্বকাপ। রোনালদোকে তিনটি (১৯৯৪ বিশ্বকাপে মাঠে নামেননি) মুলারকে দুটি। আর ফন্টেইন? মাত্র একটি বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ খেলেই ১৩ গোল! কাতারে বিশ্বকাপ জিতে অনেকের চোখে ‘সর্বকালের সেরা’ তকমা পাওয়া লিওনেল মেসিকেও ১৩ গোল করতে খেলতে হয়েছে পাঁচটি বিশ্বকাপ। ১৩ সংখ্যাটা তাই সব সময় ‘দুর্ভাগ্য’ নয়, কারও জন্য পরম সৌভাগ্যও। ফন্টেইনের এই অমরত্বের ‘চাবি’ পাওয়া কতটা কঠিন তা ’৫৮ বিশ্বকাপের পর থেকে হিসেব করলেই টের পাওয়া যায়।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের পর এ পর্যন্ত ১৬টি বিশ্বকাপ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচবার ফন্টেইনের এক বিশ্বকাপে গড়া সেই রেকর্ডের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে বেশি গোল দেখা গেছে—আর তাতেই মিলেছে ‘গোল্ডেন বুট’। আর সর্বশেষ ১২টি বিশ্বকাপ হিসেব করলে এক টুর্নামেন্টে ফন্টেইনের সেই রেকর্ডের অর্ধেক কিংবা তার বেশি গোল করে ‘গোল্ডেন বুট’ জেতার নজির আছে দুটি—২০০২ বিশ্বকাপে রোনালদো (৮) ও ২০২২ বিশ্বকাপে কিলিয়ান এমবাপ্পে (৮)। ফন্টেইনের ১৩ গোলের তাৎপর্য কিছু বোঝা গেল!
ফরাসিরা আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘ক্যানন’—অর্থাৎ গোলন্দাজ। কিন্তু জন্ম ফ্রান্সের মাটিতে হয়নি। ফরাসি বাবা ও স্প্যানিশ মায়ের কোলে মরক্কোর মারাক্কেশে জন্ম। কাসাব্লাঙ্কার একটি স্থানীয় ক্লাবে খেলতেন। ২০ বছর বয়সী ফন্টেইনের দুই পায়ে ফিনিশ করার ক্ষমতা দেখে ১৯৫৩ সালে তাঁকে ফ্রান্সে উড়িয়ে আনে নিস।
তিন বছর পর যোগ দেন রিমে, যেখানে ফ্রান্সের আরেক সোনার ছেলে রেমন্ড কোপার সঙ্গে যোগ দিয়ে ক্লাবটির কিংবদন্তি বনে যান। ফ্রান্সের জার্সিতে ফন্টেইনের অভিষেক আরও বর্ণিল। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৫৩ সালে লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকে শুরু।
দুর্ভাগ্য, চোটের কারণে ফ্রান্স দলের জার্সি খুলতে হয় মাত্র ৭ বছর পর, যখন ফন্টেইনের বয়স মাত্র ২৭ বছর! দুই বছর পর অবসর নেন পেশাদার ফুটবল থেকে। দুবার পা ভেঙে নিয়েছিলেন। তাই ফ্রান্সের হয়ে ক্যারিয়ার বেশি দূর না এগোলেও অবসর নেওয়ার সময় তাঁর নামের পাশে ছিল ২১ ম্যাচে ৩০ গোল—ফ্রান্সের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড, যা পরে হাতবদল হয়েছে। কিন্তু অন্তত ৩০টি আন্তর্জাতিক গোল আছে, এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে ফন্টেইনের প্রতি ম্যাচের গড় গোলের (১.৪৩) রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেননি।
খেলা ছাড়ার পর ফ্রান্স, মরক্কো ও পিএসজি কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই দায়িত্বে কোনো অর্জন না থাকলেও স্ট্রাইকার ফন্টেইন ২০০৪ সালে পেলের গড়া ‘১২৫ জন জীবিত কিংবদন্তি ফুটবলার’–এর তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। আর ২০০৩ সালে ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের (এফএফএফ) বিচারে গত ৫০ বছরের সেরা ফরাসি খেলোয়াড়—ভুলে গেলে চলবে না জিনেদিন জিদানের জাদুতে ফ্রান্স সে সময়ের মধ্যে প্রথম বিশ্বকাপের দেখা পেয়ে গেছে। তবু সেরা হিসেবে মাত্র ২১ ম্যাচ খেলা ফন্টেইনকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল।
১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির স্যান্ডর ককসিসের গড়া ১১ গোলের রেকর্ড ভাঙতে তৃতীয়স্থান নির্ধারনী ম্যাচে তিন গোল করতে হতো ফন্টেইনকে। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে সে ম্যাচে ফন্টেইন এক গোল বেশি করলেন। আর তাতেই ছুঁয়ে ফেলেন ককসিসকে। সেটি গোলের হিসেবে নয় হ্যাটট্রিকে—এক বিশ্বকাপে দুটি হ্যাটট্রিকের নজির তখন পর্যন্ত ছিল শুধু ককসিস ও ফন্টেইনের। তবে ’৫৮ বিশ্বকাপে ফন্টেইনের গোল আরও বাড়তে পারত।
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে দুবার পোস্ট কাঁপিয়েছেন, আর পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে নিজে পেনাল্টি না নিয়ে কোপাকে দিয়ে গোল করিয়েছেন। এমন নিঃস্বার্থ মানুষটি সুইডেন বিশ্বকাপ শেষে কিন্তু এখনকার মতো ‘গোল্ডেন বুট’ উপহার পাননি। তখন এসবের রেওয়াজ ছিল না। স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে একটা এয়ারগান পেয়েছিলেন।
নামটা ‘গোলন্দাজ’ বলেই সম্ভবত। ৪০ বছর পর ‘গোল্ডেন বুট’–এর ইতিহাস নিয়ে এক টিভি অনুষ্ঠানে ফন্টেইনের হাতে স্মারক সোনার জুতা তুলে দিয়ে ইতিহাসের দায় মিটিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার।
বয়স ৭০ পেরোনার পর তুলুজে বসবাস করতেন। ফ্যাশন হাউস লাকোস্তের দুটি দোকান ছিল। সেখানে সময় দেওয়ার পাশাপাশি অবসরে খেলা দেখতেন। তখন গোল করা সহজ ছিল—এমন কথার উত্তরে ফন্টেইন একবার বলেছিলেন, ‘সে সময় বলের অবস্থা, ওপরের আবরণ—সবই খুব জটিল ছিল। আমি অন্যের বুট পরেও খেলেছি। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, রেফারিরা এখন স্ট্রাইকারদের রক্ষা করেন। আমাদের সময়ে এতটা ছিল না। তাই ১৩ গোল অবিশ্বাস্য বড় অর্জন। এই রেকর্ড ভাঙবে? আমার মনে হয় না।’
ফন্টেইনের জীবনে দুঃখও ছিল। একবার বলেছিলেন, ‘সবাই আমার ওই রেকর্ডটি নিয়ে কথা বলে। কিন্তু আরও পাঁচ বছর খেলার বিনিময়ে আমি রেকর্ডটি হাতবদল করতে রাজি। ফুটবল যে আমার প্যাশন।’
ফ্রান্সের এই সোনার ছেলে সেই ‘প্যাশন’ বুকে বয়ে নিয়ে একটি বৃত্ত পূরণ করেছিলেন। যেখানে জন্ম, ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছেন সেখানেই—১৯৮০ আফ্রিকান নেশনস কাপে মরক্কোকে তৃতীয় স্থান পাইয়ে দিয়েছিলেন। তার পর থেকে তুলুজে বসবাস করছিলেন নীরবে–নিভৃতে। আজ ওপর থেকে ‘রেফারি’র খেলা শেষের বাঁশি বাজায় উড়াল দিলেন জীবননান্দের সেই ‘বুনো হাঁস’ কবিতার লাইন মনে করিয়ে—
‘বুনো হাঁস পাখা মেলে—সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার;
এক—দুই—তিন—চার—অজস্র—অপার—’
হ্যাঁ, ফরাসি এই ‘বুনো হাঁস’ যখন পাখা মেলে নামলেন পেলে–ম্যারাডোনার দুয়ারে, তখন আমরা নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর গোল গুনছি, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ...তেরো।