রদ্রিগো ও আলভারেজের গোল: রবিনের তির, নাকি ভিঞ্চি–অ্যাঞ্জেলোর তুলি

চ্যাম্পিয়নস লিগে কাল রাতে চোখধাঁধানো গোল করেছেন রদ্রিগো ও হুলিয়ান আলভারেজএএফপি

জর্জো ভাসারি লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ও মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর সমসাময়িক চিত্রকর। ভিঞ্চি ও অ্যাঞ্জেলোর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ‘অপছন্দে’র ব্যাপার ছিল, সেটা তিনিই বলে গেছেন। এক বেনামি পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, রাস্তাঘাটেও তর্কে জড়িয়েছেন দুজন। ভিঞ্চির বিশ্বাস ছিল, সৌন্দর্য বিজ্ঞান থেকে উৎসারিত। অ্যাঞ্জেলো মনে করতেন, সৃষ্টিকর্তাই সব সৌন্দর্যের উৎস।

রদ্রিগো ও হুলিয়ান আলভারেজ ভিঞ্চিও নন, অ্যাঞ্জেলোও নন। ফুটবল খেলার সৌন্দর্য তাঁদের পায়ে আছে বটে, তবে চারুকলায় ভিঞ্চি ও অ্যাঞ্জেলো যে মাপের, ফুটবলের সৌন্দর্যে তাঁরা এখনো সেখানে আসতে পারেননি। কিন্তু মানুষ চাইলে কী না হয়! চেষ্টা এবং খুব করে চাইলে বোধ হয় কখনো কখনো কোনো কোনো রাতে নিজের মধ্যে ভিঞ্চি কিংবা অ্যাঞ্জেলোও নামিয়ে ফেলা যায়!

আরও পড়ুন

রদ্রিগো ও আলভারেজ বোধ হয় তা টের পাননি—সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তাঁদের পা’টা ঠিক যে মুহূর্তে তুলি হয়ে উঠেছিল, তখন কারও কারও চোখে দৃশ্য দুটি ফুটেছে এভাবে, ওটা যেন ভিঞ্চির তুলির টান, অন্যটি অ্যাঞ্জেলোর! কিংবা অন্য ভাবনাও আসতে পারে। রদ্রিগো ও আলভারেজের গোল দুটি দেখে মনে হতে পারে, এ তো রবিনের জোড়া তির! রবিনকে চিনলেন না, সেই যে শেরউড জঙ্গলের রবিনহুড। দুটি গোলই একদম তিরের ফলার মতো লক্ষ্য ভেদ করেছে।

গোলের পর রদ্রিগোর উদ্‌যাপন
এএফপি

কিন্তু রদ্রিগো-আলভারেজের জন্ম যে দুই দেশে, তাতে ভিঞ্চি ও অ্যাঞ্জেলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গই আগে আসে। দুই চিত্রকরের জন্ম ইতালিতে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে রেষারেষির ঝাঁজ ছিল অনেকটাই ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মতো। তেমনি রদ্রিগোর দেশও ব্রাজিল, আলভারেজের আর্জেন্টিনা। তাঁদের ক্লাবও একই নগরের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। আর গোল দুটি হয়েছেও দুটি বিপরীত জায়গা থেকে বিপরীত লক্ষ্যে। ৪ মিনিটে রদ্রিগোর গোলটি মাঠের ডান প্রান্ত থেকে বক্সে ঢোকার পথে আতলেতিকোর এক ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে, আরেক ডিফেন্ডারকে ডজ দিয়ে বাঁ পায়ের চোখধাঁধানো হালকা বাঁকানো শটে। দৌড়ের ওপর অমন ফিনিশিংকে রোলস রয়েসের তীব্র গতিতে ফিনিশিং লাইন ছোঁয়া মনে হতে পারে। বলটা জাল ছুঁয়েছে ডান প্রান্ত থেকে বাঁ প্রান্তের পোস্ট দিয়ে।

আরও পড়ুন

আলভারেজ ঠিক এখানেই বিপরীত। তাঁর শট জাল ছুঁয়েছে বাঁ প্রান্ত দিয়ে ডান প্রান্তের দূরের পোস্টে। সেটাও রদ্রিগোর মুভের একদম বিপরীতধর্মী মুভে। সতীর্থের পাস পেয়ে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার রিয়ালের বক্সে ঢুকেছেন দুলকি চালে। গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা রিয়ালের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা বল কাড়তে পারেননি। তাঁকে পাশে রেখেই আলভারেজের ডান পায়ের শট একটু বাঁক নিয়ে দূরের পোস্ট দিয়ে সোজা জালে। দূরত্ব ও দুরূহ কোণ বিবেচনায় দুটি গোলই অসাধারণ। আলভারেজ বেশি নম্বর পেতে পারেন, কারণ তাঁর শটের দূরত্ব বেশি ছিল, আর গোলটি করেছেন স্রেফ শূন্য সম্ভাবনা থেকে। রদ্রিগো দৌড়ে বক্সের ঢোকার মুহূর্তেই গোলের সুযোগটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

গোলের পর আলভারেজের উদ্‌যাপন
এএফপি

ফুটবলের রোমান্টিক সমর্থকেরা তাই হিসাবটা মিলিয়ে নিতে পারেন, রদ্রিগোর গোল বাঁ পায়ে, আলভারেজের ডান পায়ে, রদ্রিগো যে পোস্ট ঘেঁষে গোল করেছেন, আলভারেজ করেছেন তার বিপরীত পোস্টে, রদ্রিগোর শট ছিল তীব্র গতির ওপর আর আলভারেজ দুলকি চালের মুভ থেকে নেওয়া চকিত শটে—সবকিছুই একটি আরেকটির বিপরীত। ঠিক যেমন রিয়াল-আতলেতিকো, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কিংবা ভিঞ্চি-অ্যাঞ্জেলোর সম্পর্ক। তবে এসব বিবাদে না গিয়ে রোমান্টিক সমর্থকেরা কিন্তু অন্যভাবেও ভাবতে পারেন—দুজনের দুটি শটই তিরের বেগে ঢুকেছে দূরের পোস্ট ঘেঁষে। গোলকিপার ডাইভ দিয়েও যেন বল ঠেকাতে না পারেন, এটাই ছিল ভাবনা এবং ঘটেছেও ঠিক তা–ই। অর্থাৎ কতটা নিখুঁত ছিলেন তাঁরা! কিংবদন্তি বলে, রবিনের তিরও এমন নিখুঁত ছিল।

আলভারেজের সেই ‘তির’–এর ফলা শুধু রিয়াল–সমর্থকদের বুকেই বিদ্ধ হয়নি, তাঁদের বুকটা এঁফোড়-ওফোঁড় করে তা বিঁধেছে ৬৬ বছর আগের এক রেকর্ডেও। আলভারেজের আগে রিয়ালের মাঠ বার্নাব্যুতে ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব প্রতিযোগিতায় আতলেতিকোর হয়ে সর্বশেষ গোলটি স্পেনের সাবেক ডিফেন্ডার চুজোর, ১৯৫৯ সালে। আর রদ্রিগো? ‘তির’ ছুড়তে তাঁর যেন আর তর সয়নি! ৩ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে করা গোলটি আতলেতিকোর বিপক্ষে যেকোনো প্রতিযোগিতার নকআউট ম্যাচে রিয়ালের দ্রুততম গোল।

রদ্রিগোর গোলটির উৎস ছিল ফেদে ভালভের্দের ডিফেন্সচেরা লম্বা পাস। তা নিয়ে স্প্যানিশ টিভিকে ম্যাচ শেষে রিয়াল উইঙ্গার বলেছেন, ‘ফেদের সঙ্গে খেলাটা সুন্দর ছিল। সে আমার মুভমেন্ট বুঝতে পেরেছে, কাট করে ভেতরে ঢুকে বাঁ পায়ের শট নিয়েছি। অনুশীলনে যা চর্চা করি সেটা ম্যাচেও করি।’

আলভারেজের ৩২ মিনিটে করা গোলে অর্জন আছে আরও একটি। চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বে রিয়ালের ঘরে ঢুকে গোল করে এসেছেন মাত্র দুজন আর্জেন্টাইন। একজনকে তো কাল রাতেই দেখলেন। অপরজন? লিওনেল মেসি, ২০১১ সালে।

অবশ্য ঘটনা উল্টোও হতে পারত। আলভারেজ খেলতে পারতেন রিয়ালের হয়েও। মাদ্রিদের ক্লাবটির এক স্কাউট ১১ বছর বয়সী আলভারেজকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্পেনে। প্রায় মাসখানেক ছিলেন রিয়ালের ডেরায়। কিছু ম্যাচ খেলে গোলও করেছিলেন। কিন্তু আলভারেজের পরিবার তখন স্পেনে থাকতে পারেনি, আর রিয়ালের পলিসি ছিল ১৩ বছরের নিচে কাউকে সই করানো হবে না। ব্যস, ঘুরে গেল ভাগ্যের চাকা। সেই আলভারেজ ২০২৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল ফিরতি লেগে রিয়ালের জালে গোল করেন, গোল করলেন এবার শেষ ষোলো প্রথম লেগেও। যদিও এই ম্যাচের ফল নির্ধারণ করেছে অন্য কারও দারুণ গোল—ব্রাহিম দিয়াজ।

কিন্তু ভিঞ্চি-অ্যাঞ্জেলোর ছবি কিংবা ভাস্কর্যের পাশে অন্য কারও দারুণ সৃষ্টিকর্মও লোকে কমই মনে রাখে, ব্যাপারটা নির্মম হলেও বাস্তব। রবিনের সহচর লিটল জনের তির ছোঁড়ার হাতও ঈর্ষণীয় ছিল, তবু লোকে কিন্তু রবিনকেই বেশি মনে রেখেছে!

কারণটা শুধুই সৌন্দর্য কিংবা নিখুঁত হওয়ার জন্য নয়, আসলে কখনো কখনো কোনো কোনো মুহূর্তে ঐশ্বরিক কিছু একটা ভর করে খেলোয়াড়দের মধ্যে, আর তখনই ভিঞ্চি-মাইকেল অ্যাঞ্জেলোরা নেমে আসেন রদ্রিগো-আলভারেজ হয়ে!