স্কালোনি কেন আর্জেন্টিনা দলের দায়িত্ব ছাড়তে চান

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লিওনেল স্কালোনিছবি : টুইটার

মারাকানায় বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা ম্যাচ শেষে আলোচনার কেন্দ্রে তখন গ্যালারির সংঘাত ও মাঠের উত্তাপ। ম্যাচ শুরুর আগে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের ওপর ব্রাজিল পুলিশের হামলা নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা, সঙ্গে ছিল ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচ জেতার আনন্দও। আর ব্রাজিলিয়ানদের ক্ষোভ ম্যাচ হারা নিয়ে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আলোচনার বিষয়টা বদলে দেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি। ঐতিহাসিক সেই জয়ের পর সবাইকে চমকে তিনি দেন বিদায়ের ইঙ্গিত। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্য নায়কের কাছ থেকে এমন খবর ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তাঁর দেওয়া সেই খবরটি ছিল আর্জেন্টিনা দলের কোচের দায়িত্ব ছাড়া নিয়ে।

স্কালোনি সে সময় বলেন, ‘আর্জেন্টিনার এমন এক কোচ প্রয়োজন, যাঁর সম্ভাব্য সব রকম প্রেরণা আছে এবং তিনি...আমার এখন বলটা থামিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, এ সময়ে আমার অনেক কিছুই ভাবার আছে। এই খেলোয়াড়েরা কোচিং স্টাফকে অনেক কিছু দিয়েছে। এখন আমি কী করব, সেটা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। বিদায় বা এমন কিছু বলছি না। তবে আমাকে ভাবতে হবে। কারণ, প্রত্যাশার মাত্রাটা অনেক উঁচুতে, আর এভাবে চালিয়ে যাওয়া এবং জয়ের পথে থাকাও বেশ জটিল কাজ।’

আরও পড়ুন

তাঁর এই কথাগুলো আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জন্য ছিল বাজ পড়ার মতোই। টানা সাফল্যহীনতার মধ্যে থাকা আর্জেন্টিনা দলের বদলে যাওয়া তাঁর হাত ধরেই। শুরুটা স্বচ্ছন্দের না হলেও পরে সেই স্কালোনিই বদলে দেন সমীকরণ। লিওনেল মেসির নেতৃত্বে দলকে তৈরি করেন বিশ্বকাপের জন্য। যাঁরা পরে স্কালোনির ‘ব্লুপ্রিন্ট’ বাস্তবায়ন করে দেশকে শিরোপাও এনে দেন। এমনকি বিশ্বকাপ জয়ের পরও দলকে সঠিক পথে পরিচালিত করে একের পর এক জয় এনে দিয়েছেন এই কোচ। যে কারণে এমন একজন কোচের সম্ভাব্য বিদায়ের ঘোষণা দলকে বড় ধাক্কা দেবে, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন স্কালোনি এমন আকস্মিক বিদায়ের ঘোষণা দিলেন? কী এমন ঘটেছে, যা তাঁকে এ ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে চালিত করেছে?

স্কালোনির এই ঘোষণা সামনে আসার পর থেকে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যমগুলো এর নানা ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ বলেছে, বিশ্বকাপের পর থেকে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের (এএফএ) সঙ্গে স্কালোনির সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। তাঁর চুক্তি বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার বিষয়টিও নাকি মেনে নিতে পারেননি স্কালোনি। পাশাপাশি টিওআইসি স্পোর্টসের খবর অনুযায়ী স্কালোনি, তাঁর সহকর্মী এবং আর্জেন্টিনা দলের খেলোয়াড়েরা নাকি বিশ্বকাপ বোনাসও এখন পর্যন্ত পাননি।

লিওনেল স্কালোনি ও লিওনেল মেসি
এএফপি

এর আগে ২০১৮ সালে হোর্হে সাম্পাওলির বিদায়ের পর দায়িত্ব নেন স্কালোনি। তখন থেকে এএফএ সভাপতি ক্লদিও তাপিয়ার সঙ্গে স্কালোনির সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য বলেই মনে হচ্ছিল। এমনকি ফেডারেশন সভাপতি মরিসিও পচেত্তিনো, দিয়েগো সিমিওনে এবং মার্সেলো গালার্দোর মতো হাইপ্রোফাইল কোচদের পরিবর্তে বেছে নেন অখ্যাত স্কালোনিকেই। এ কারণে বেশ চাপেও ছিলেন তাপিয়া। আর্জেন্টিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে স্কালোনির অভিজ্ঞতা ছিল সহকারী কোচ এবং বয়সভিত্তিক দলের দায়িত্ব পালনের। তাপিয়ার সেই সিদ্ধান্তের যথার্থতাও অবশ্য প্রমাণ করেছেন স্কালোনি।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে বিশ্বকাপ জিতে স্কালোনি তাঁর অবস্থান নিরঙ্কুশ করেছেন মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু তেমনটা ছিল না। কারণ, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা সব সময় দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে এসেছে, আর্জেন্টিনাও যার ব্যতিক্রম নয়। স্কালোনির আকস্মিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে সেই রাজনীতিই। টিওয়াইসি স্পোর্টসের একটি খবরে বলা হয়েছে, আর্জেন্টিনার জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশটি অর্থমন্ত্রী ও বামপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সের্হিও মাসা জাতীয় দলের সঙ্গে একটি ছবি তোলার অনুরোধ করেন। এই মাসা আবার তাপিয়ার খুব ঘনিষ্ঠও বটে। কিন্তু খেলোয়াড়েরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, ফুটবলাররা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে চান না। তাপিয়া তখন খেলোয়াড়দের রাজি করাতে স্কালোনিকে চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।

খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি না তুলেই নির্বাচনে নামতে হয় মাসাকে। ব্রাজিল ম্যাচের ঠিক আগের দিন অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ডানপন্থী প্রার্থী হ্যাভিয়ার মিলেইয়ের কাছে হেরে যান মাসা, যা মানসিকভাবে চাপ তৈরি করেছে স্কালোনির মধ্যে।
এদিকে দলের সঙ্গে আলাপ না করে স্কালোনির এমন সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আনার বিষয়টি নাকি মানতে পারছেন না মেসিও। বুয়েন্স এইরেসভিত্তিক রেডিও ১০ স্কালোনির সংবাদ সম্মেলেনের পরদিন জানায়, দলের সঙ্গে আলোচনা না করে ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কথা বলা পছন্দ করেননি মেসি।

বিশ্বকাপ হাতে স্কালোনি
টুইটার

স্কালোনি–মেসির মধ্যে টানাপোড়েন নাকি ব্রাজিল ম্যাচের আগেই শুরু হয়েছিল। ম্যাচে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের ওপর ব্রাজিলিয়ান পুলিশদের হামলার প্রতিবাদে দল নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার আগে নাকি মেসি স্কালোনির সঙ্গে আলাপ করেননি। মেসির এই সিদ্ধান্ত নাকি স্কালোনি এবং দলের স্টাফদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি করেছে।

মেসি–স্কালোনির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের খবর সত্যি হোক বা না হোক, এটা সত্য যে আর্জেন্টিনা দলকে ঘিরে পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো স্কালোনির মধ্যে বিরক্তি এবং ক্লান্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। আর এমন নয় যে এই প্রথম স্কালোনি দল পরিচালনায় নিজের সংগ্রামের কথা বলেছেন। এর আগে ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জয়ের পর আর্জেন্টিনা যখন কাতার বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ম্যাচ খেলছিল, তখনো চাপ থেকে মুক্তি পেতে পরিবারের কাছে যাওয়ার আকুতির কথা বলেছিলেন স্কালোনি। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমি শুধু ঘরে যেতে চাই। আমি অনেক দিন আমার পরিবারকে দেখিনি। বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবার জন্য আমি এই মুহূর্তে ইতিবাচক পারিবারিক সময় পার করতে করছি না। আমি যেতে চাই। এই মাসগুলো আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। আমি আর কিছু ভাবতে চাই না।’

আরও পড়ুন

এরপর বিশ্বকাপ বাছাইটা ভালোভাবে কাটলেও টুর্নামেন্টের শুরুটা একেবারে ভালো হয়নি স্কালোনির। গ্রুপপর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচের পর আর্জেন্টিনা একরকম খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল। শুধু নিজেদের জন্যই নয়, মেসিকে যেন খালি হাতে বিশ্বকাপ শেষ করতে না হয়, সেই চাপও স্কালোনি এবং দলের খেলোয়াড়দের বহন করতে হয়েছিল। এসব ঘটনাও স্কালোনিকে ক্লান্ত করেছে।

বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও স্কালোনি কতটা আবেগপ্রবণ, সেই প্রমাণ পাওয়া যাবে ফাইনালে গনসালো মন্তিয়েলের সেই ট্রফি নিশ্চিত করা গোলের পর। সেদিন অঝোর কেঁদেছিলেন এই আর্জেন্টাইন কোচ। এরপর ‘বোবো ভিয়েরি টক শো’ নামের পডকাস্টে আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ার চাপ নিয়েও কথা বলেছেন স্কালোনি। খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের সাবেক লাৎসিও সতীর্থ ক্রিস্টিয়ান ভিয়েরি এবং ক্রিস্টিয়ান ব্রোচ্চির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই টক শোতে স্কালোনি জানান, উদ্বেগের কারণে বিশ্বকাপ ফাইনালের মাসখানেক পর থেকে পেটে র‍্যাশের সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন তিনি।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তাপিয়া
টুইটার

সব মিলিয়ে এই চাকরি স্কালোনির মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক দুই দিক থেকেই প্রচুর চাপ ও উদ্বেগ তৈরি করে। বিষয়টা এতই ক্ষতিকর যে বিশ্বের এক নম্বর দল হওয়া কিংবা বিশ্বকাপজয়ী লিওনেল মেসির কোচ হওয়াও ২০২৬ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার জন্য স্কালোনির কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। যে কারণে ব্রাজিল ম্যাচের পর পুরো বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার কথা বলেছিলেন স্কালোনি।

সেই পডকাস্টে ব্রোচ্চি মজা করে স্কালোনিকে বলেন, তাঁর এবং স্কালোনির উচিত লাৎসিওর দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবটিকে নতুন করে সাজানো। মজা করে বললেও বাস্তবতাও কিন্তু স্কালোনির ভবিষ্যৎ ক্লাব ফুটবলের দিকেই ইঙ্গিত করছে। ৪৫ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইনের হাতে এখন বিশ্বকাপ ট্রফি আছে। যদি আর্জেন্টিনা দল ছেড়ে দেন, তবে ক্লাব ফুটবলের দুনিয়ায় তাঁকে নিয়ে চাহিদাও থাকবে তুঙ্গে। ইউরোপিয়ান ফুটবলে প্রবেশের জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ স্কালোনির সামনে পরে না–ও আসতে পারে।

আরও পড়ুন

এরই মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নামও শোনা যাচ্ছে। আগামী মৌসুমে রিয়ালের বর্তমান কোচ কার্লো আনচেলত্তির ব্রাজিলে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেটি বাস্তবায়িত হলে স্কালোনির সামনে দারুণ একটি দুয়ার খুলবে। রিয়ালের দায়িত্ব নিয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবলের দুনিয়ায় প্রবেশের চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে। আর স্প্যানিশ ফুটবল দুনিয়া সম্পর্কে তাঁর জানাশোনাও ভালো। দেপোর্তিভো লা করুনাসহ কয়েকটি স্প্যানিশ ক্লাবে লম্বা সময় খেলার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। দায়িত্ব পালন করেছেন সেভিয়ার সহকারী কোচেরও। এ ছাড়া স্পেনের বাইরে ইতালিও হতে পারে স্কালোনির অন্য গন্তব্য। সেখানেও অনেক দিন ফুটবল খেলেছেন তিনি।

আরও পড়ুন

তবে এর আগে অবশ্যই ক্লাব ফুটবলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্কালোনি নিশ্চয় আরও ভাববেন। এর মধ্যে সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে আগামী কোপা আমেরিকা হয়তো তাঁর জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপলক্ষ হয়ে আসতে পারে। সেই টুর্নামেন্টে সাফল্য বা ব্যর্থতাই হয়তো ঠিক করে দেবে স্কালোনির ভবিষ্যৎ। কোপা আমেরিকা অবশ্য শুধু স্কালোনির নয়, মেসির জন্যও ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার টুর্নামেন্ট। কে জানে, হয়তো দুজনই সেই আসর দিয়ে নিজেদের আর্জেন্টিনা ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন। তবে শিরোপা ধরে রাখতে পারলে সেই সিদ্ধান্ত উল্টো দিকেও ঘুরে যেতে পারে। এখন শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা জানতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতেই হবে।

* দ্য অ্যাথলেটিক অবলম্বনে