জার্মানি বলের পেছনে ৯০ মিনিট ছুটছে, কিন্তু জিতছে প্রতিপক্ষ
গ্যারি লিনেকারের সেই মন্তব্য এখন ফুটবলের চিরকালীন প্রবাদের অংশ। বহুল ব্যবহারে ক্লিশেও হয়ে পড়েছে। তবু কথাটা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেটা উল্টোভাবে।
ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি বলেছিলেন, ফুটবলে ২২ জন খেলোয়াড় একটা বলের পেছনে ৯০ মিনিট ছোটে আর খেলাটা শেষ পর্যন্ত জার্মানিই জেতে! কিন্তু জার্মান ফুটবলের বর্তমানে তাকিয়ে লিনেকারের কথাটা এভাবেও বানিয়ে নেওয়া যায়—‘ফুটবলে জার্মানির খেলোয়াড়েরা একটা বলের পেছনে ৯০ মিনিট ছোটেন এবং খেলাটা শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষই জেতে!’
নারী বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই চোখ রাখা হচ্ছে? একটা প্রশ্ন করা যায়। বলুন তো, এবার নারী বিশ্বকাপে জার্মানির পারফরম্যান্স কেমন? জানা থাকলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল, তবে তথ্যটা জানা না থাকলে বলে ফেলাই ভালো—দুবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি নারী বিশ্বকাপের ইতিহাসে এবারই প্রথম গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছে। এমনকি এর আগে কখনো তারা দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেও বাদ পড়েনি।
এবার গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে জার্মানি যেন ফুটবল নিয়ে নিজেদের গর্বের বেদিতেই কুঠারাঘাত করেছে! হ্যাঁ, অবশ্যই তা ইচ্ছাকৃত নয়, তবে জার্মান ফুটবলের শক্তি যে কমেছে, সেটি পরিষ্কার। নারী বিশ্বকাপে ‘এইচ’ গ্রুপ থেকে তিন ম্যাচ খেলে শুধু মরক্কোর বিপক্ষে জিতেছে জার্মানি। কলম্বিয়ার বিপক্ষে হার এবং র্যাঙ্কিংয়ে ১৭তম দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলের ড্রয়ে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে র্যাঙ্কিংয়ের দুইয়ে থাকা জার্মানি।
পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, নারীদের ফুটবলে বাজে পারফরম্যান্স নিয়ে কেউ অত ভাবে! ছেলেদের ফুটবলে জার্মানি এখনো মহাপরাক্রমশালী। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাফল্যের বিচারে জার্মানির নামের পাশে ‘জায়ান্ট’ শব্দটা আপনাকে লিখতেই হবে। কিন্তু শব্দটা লিখেই ছেলেদের সর্বশেষ দুটি বিশ্বকাপে জার্মানির ছেলেদের পারফরম্যান্স স্মরণ করে দেখুন। এই দুবারই (২০১৮, ২০২২) জার্মানি গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। চাইলে রসিকতা করে বলতেই পারেন, জার্মানির মেয়েরা তো ছেলেদেরই অনুসরণ করছে!
তবে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিএফবি) কিন্তু এখন মোটেও রসিকতার মেজাজে নেই। দেশের দুটি জাতীয় দলের হাল দেখে ডিএফবি অফিশিয়ালদের এখন ঘাম ছুটছে। চুপ করে নেই জার্মান মিডিয়াও। জার্মান ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে চলছে তুমুল সমালোচনা। যে জার্মানরা ছেলে ও মেয়েদের বিশ্বকাপে একমাত্র জাতি হিসেবে দুটি ইভেন্টেই শিরোপা জিতেছে, আর মেয়েদের ইউরোতেও জার্মানি বরাবরই অবিসংবাদিত ফেবারিট। সর্বোচ্চ আটবার মেয়েদের ইউরো জিতেছে জার্মানি। যেখানে তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নরওয়ে জিতেছে মাত্র দুবার। সেই জার্মানির এমন পতন নিয়ে কথা না ওঠাই তো অস্বাভাবিক!
ডিএফবি নারীদের উইংয়ের ক্রীড়া পরিচালক ইয়োতি চ্যাটজিয়ালেক্সিউয়ের কাছে জার্মানির মেয়েদের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা নেই।’ তবে চ্যাটজিয়ালেক্সিউয়ের নিজের যুক্তি, ‘নারী ফুটবলে আমরা নিজেদের অতীত সাফল্য নিয়ে স্বস্তিতে ছিলাম।’ এদিকে মেয়েদের সর্বশেষ ইউরোয় ফাইনাল খেলা জার্মান ফুটবলের ভিত নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
চ্যাটজিয়ালেক্সিউ জানিয়েছেন, বাজে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে কিছু ব্যবস্থা নেবে ডিএফবি। গত পাঁচ বছরে ‘ছেলে ও মেয়েদের ফুটবলে একটি প্রজেক্ট দাঁড় করিয়েছে’ ডিএফবি, জানিয়েছেন ৪৭ বছর বয়সী চ্যাটজিয়ালেক্সিউয়ের, ‘ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি না।’
চ্যাটজিয়ালেক্সিউ আরও জানিয়েছেন, নারী বিশ্বকাপে ওয়ান-অন-ওয়ান পরিস্থিতিতে জার্মানির মেয়েরা মোটেও ভালো করতে পারেনি, ‘ওয়ান-অন-ওয়ানের পরিসংখ্যান দেখে মনে হয়েছে, টুর্নামেন্টে ভালো করতে আমরা নিজেদের সেরাটা দিইনি।’
জার্মানির ছেলেদের জাতীয় দলের কোচ হান্সি ফ্লিক দেশের বয়সভিত্তিক একাডেমিগুলোর মান নিয়ে আগেও প্রশ্ন তুলেছিলেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় জার্মানির বয়সভিত্তিক একাডেমিগুলো মানে পিছিয়ে বলেই মনে করেন ফ্লিক। বায়ার্ন মিউনিখের ২০ বছর বয়সী অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার জামাল মুসিয়ালার উদাহরণ টেনেছিলেন ফ্লিক। জার্মান ফুটবলের এই ভবিষ্যৎ ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চেলসির বয়সভিত্তিক দলে ছিলেন।
ফ্লিকের যুক্তি, ‘মুসিয়ালা ইংল্যান্ডে অনুশীলন করে বেড়ে উঠেছে, জার্মানিতে নয়।’ গত ডিসেম্বরে কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার পর অনুশীলনেও জোর দিয়েছিলেন ফ্লিক, ‘আমাদের সত্যিই অনুশীলনে বেশি করে জোর দিতে হবে।’
দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ড্রয়ে বাদ পড়ার পর ব্রিসবেনে হোটেলে অবস্থান করেছিলে জার্মানির নারী ফুটবল দল। সেখানে জার্মানির ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড’-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় অধিনায়ক আলেক্সান্দ্রা পোপ জানিয়েছেন, নির্ঘুম একটি রাতের পর তাঁর কাছে এমন বিদায়ের কোনো ব্যাখ্যা নেই। জার্মানি নারী দলের এই অধিনায়ক কারও সমালোচনা করতে চাননি। সবার আগে খেলোয়াড়দের নিজেদের পারফরম্যান্সে তাকানো উচিত বলেই মনে করেন আলেক্সান্দ্রা পোপ, ‘আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকানো উচিত। সমালোচনার চোখে নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিত সেরাটা দিয়েছি কি না।’
জার্মান সংবাদমাধ্যম মনে করছে, কাতার বিশ্বকাপে ছেলেদের মতো নারীরাও এবার অহংকার ও আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে। দেশটির সংবাদমাধ্যম ‘কিকার’ সোজাসাপ্টাই লিখেছে, গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে দল এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল যে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় বাদ দিন, গ্রুপে দ্বিতীয় হলে ভ্রমণ পরিকল্পনা কী হবে—সেসবও ঠিক করা ছিল না। জার্মান ফুটবলের (ডিএফবি) প্রধান বের্নাদ নয়েনডর্ফ তো শেষ ষোলোয় জার্মানির ওঠা নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে এই পর্বের টিকিটও কেটে রেখেছিলেন। কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব জার্মানির সব ম্যাচেই গ্যালারিতে ছিলেন নয়েনডর্ফ।
নয়েনডর্ফ এখন ২০২৪ ইউরোয় তাকিয়ে, যার আয়োজক জার্মানি। ডিএফবি-প্রধানের বিশ্বাস, আগামী বছরের ইউরো দিয়েই পথে ফিরবে জার্মান ফুটবল, ‘আমি মনে করি, উচ্ছ্বাসের সময় সামনেই। আমাদের কিছু অর্জন দরকার, জিততে হবে।’ আজ জার্মানির নারী দলের কোচ পদ ছাড়তে পারেন মার্টিনা ফস-টেকলেনবুর্গ। কিন্তু তিনি দায়িত্ব ছাড়ুন কিংবা না ছাড়ুন, জার্মান ফুটবলের সমস্যার মূল যে আরও গভীরে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।