২০ বছরের অপেক্ষা শেষ যে জয়ে
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় কোনটি?
দেশের ফুটবলের মোটামুটি খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, সবারই উত্তরটা জানার কথা। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে (এখন এসএ গেমস) মালদ্বীপকে ৮–০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। দেশের ফুটবলের ‘সোনালি অতীতের’ বিজ্ঞাপন বলতে পারেন ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখনকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাওয়া সেই জয়টাকে।
’৮৫’র সেই ম্যাচটি ছিল মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দ্বৈরথ। আগের বছরই কাঠমান্ডুর সাফ গেমসে মালদ্বীপকে ৫–০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ঢাকার সাফ গেমসের পর মালদ্বীপ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের যেকোনো দলের জন্যই গোল–উৎসবের উপলক্ষ। যদিও এরপর বাংলাদেশের জাতীয় দল অনেক দিন মালদ্বীপের সঙ্গে খেলেনি। কিন্তু দেশটির শীর্ষ ক্লাবগুলোকে বাংলাদেশের আবাহনী, মোহামেডান বেশ কয়েকবারই বড় ব্যবধানে হারিয়েছে।
সেই মালদ্বীপই বাংলাদেশের জন্য বড় এক ধাক্কা হয়ে আসে ১৯৯৩ সালে। সেবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে মালদ্বীপ। কায়সার হামিদের পেনাল্টি মিসের জন্য আজও হতাশার হয়ে আছে সেই ম্যাচ। ৯০ মিনিটজুড়ে গোলের জন্য মরিয়া বাংলাদেশের আক্রমণগুলো আটকে যাচ্ছিল মালদ্বীপের রক্ষণে।
মালদ্বীপ সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল ফুটবলে তারা উঠে আসছে। এর আরও নমুনা দেখা গেল ১৯৯৫ সালের মাদ্রাজ সাফ গেমস ও ১৯৯৭ সালের কাঠমান্ডু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশের পরের দুই ম্যাচে। দুই ম্যাচেই পিছিয়ে পড়েও বাংলাদেশের সঙ্গে ১–১ গোলে ড্র করেছিল মালদ্বীপ।
১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে তো বাংলাদেশকে ২–১ গোলে হারিয়েই দিয়েছিল মালদ্বীপ। দেশের ফুটবলের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এসেছিল সেই হার। অবশ্য পরের তিন ম্যাচে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ ফুটবলে সোনা জিতেছিল। কিন্তু সাফ গেমস ফুটবলে প্রথমবারের মতো সোনা জয়ের আনন্দ কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছিল মালদ্বীপের বিপক্ষে সেই হার।
২০০৩ সালে ঢাকার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে গ্রুপপর্বে প্রবল লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছিল ১–০ গোলে। ফাইনালেও মালদ্বীপের বিপক্ষে টাইব্রেকারে জিতেছিলেন আলফাজ–আমিনুল–কাঞ্চনরা। কিন্তু নিয়মানুযায়ী নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে অমীমাংসিত ম্যাচকে ড্র–ই ধরা হয়।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে পরের জয়টি তুলে নিতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০ বছর। হ্যাঁ, আজ বেঙ্গালুরুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে ৩–১ গোলের দারুণ জয়টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দুই দশক পর বাংলাদেশের প্রথম জয়। যে মালদ্বীপকে একসময় ৮–০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ, তাদের বিপক্ষেই একটা নির্দিষ্ট টুর্নামেন্টে জয় পেতে ২০ বছর লেগে গেল বাংলাদেশের!
এই দুই দশকে ফুটবলে তরতর করে এগিয়ে গেছে মালদ্বীপ। আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি করে নিজেদের রুগ্ণ অতীতকে পেছনে ফেলেছে ছোট্ট এই দেশটি। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে নিজেদের ফুটবলকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ২০০৩ সালের পর মালদ্বীপের সঙ্গে সাতটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ হেরেছে পাঁচটিতেই। জয় একটিতে, অন্য ম্যাচটি হয়েছে ড্র। হারগুলোর মধ্যে দুটি ৩–১ গোলে, দুটি ২–০ গোলে আর একটি ৫–০ গোলে উড়ে গিয়ে। ড্র ম্যাচটি ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল, যেটিতে টাইব্রেকারের ভাগ্য পরীক্ষায় শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে মালেতে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে মালদ্বীপ বাংলাদেশকে হারায় ৫–০ গোলে। ফুটবলে বাংলাদেশের অধোগতি আর মালদ্বীপের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোটা আরও স্পষ্ট হয়েছিল সেই ম্যাচেই।
একসময়ের ‘সহজ প্রতিপক্ষ’ মালদ্বীপ এখন বাংলাদেশের প্রবল প্রতিপক্ষ। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কায় চার জাতি টুর্নামেন্টে মালদ্বীপকে ১৮ বছর পর ২–১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জয়ের আনন্দে ভেসেছিলেন জামাল ভূঁইয়ারা। কিন্তু গত বছর মালেতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে আবারও হার।
বেঙ্গালুরুতে আজ সাফ চ্যাম্পিয়নে মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটি ছিল বাঁচা–মরার লড়াই। সেই পরীক্ষায় কী দুর্দান্তভাবেই না উতরে গেল বাংলাদেশ! ১–০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ৩–১ গোলের জয় যেন বাংলাদেশের ফুটবলের ঘুরে দাঁড়ানোরই ইঙ্গিত। আক্রমণাত্মক ও পরিকল্পিত ফুটবল খেলেই রাকিব হোসেন, তারিক কাজী আর মোরসালিন আহমেদের গোলে মালদ্বীপের বিপক্ষে এসেছে এই জয়।
আর সেটি দেশের ফুটবল নিয়ে দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন।