মার্তিনেজকে টানছে ‘নিয়তি’, লক্ষ্য এবার বিশেষ কিছু
‘অনেক উত্থান-পতন নিয়েই দুর্দান্ত একটা ক্যারিয়ার কাটছে আমার। আমি বিশ্বাসী মানুষ এবং কঠোর পরিশ্রমী। আর আজ এটাই ছিল আমার নিয়তি।’
নিয়তি? এমিলিয়ানো মার্তিনেজের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেই তাঁর এই কথার পক্ষে যুক্তি মিলবে। আর্সেনালের বয়সভিত্তিক দলে যোগ দিয়েছিলেন ২০১০ সালে। দুই বছর পর সুযোগ পান মূল দলে। কিন্তু ২০২০ সালে অ্যাস্টন ভিলায় যোগ দেওয়ার আগে ৮ বছরে গানারদের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৫ ম্যাচ। এমনকি সে সময় গোলকিপার-সংকট থাকতেও তাঁকে বিবেচনা করা হয়নি।
ভাগ্যটা পাল্টাতে শুরু করে ভিলায় যোগ দেওয়ার পর। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে সুযোগ পান, কোপা আমেরিকা জয়ে রাখেন বড় ভূমিকা। ভালো খেলেন লা ফিনালিসিমাতেও। আর ২০২২ বিশ্বকাপটা হয়ে আসে রূপকথার মতো করেই!
ফাইনালে ১২৩ মিনিটে কোলোমুয়ানির শট ঠেকিয়ে দেন অবিশ্বাস্যভাবে, টাইব্রেকার পেরিয়ে অবশেষে আরেকটি বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। আর মার্তিনেজের হাতে ওঠে সেরা গোলকিপারের পুরস্কার। বড় দলে যোগ দিয়ে ক্যারিয়ারটা আরও বড় করতে আর কী চাই!
ভুল। মার্তিনেজ একটু অন্য ধাতে গড়া মানুষ। বিশ্বকাপ জিতে ফিফার বর্ষসেরা গোলকিপারের পুরস্কার জেতার পর বেশ কিছু বড় ক্লাব থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন। সেসব পাত্তা না দিয়ে মার্তিনেজ গত বছর মার্চেই জানিয়ে দেন, থাকতে চান ভিলা পার্কেই। তখন বলেছিলেন, ‘এই ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর আমার ক্যারিয়ার চূড়া ছুঁয়েছে। আমি সব সময়ই বলে এসেছি, এই ক্লাবের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এবং এখানে থাকতে ভালোবাসি।’
অর্থাৎ ভিলার প্রতি কৃতজ্ঞ মার্তিনেজ তাঁর পছন্দের এই ক্লাবকে কিছু ফিরিয়েও দিতে চান। সেই পথে গতকাল রাতে ভিলাকে বড় একটা ধাপ পার করাতে দারুণ সহায়তা করলেন মার্তিনেজ। ফরাসি ক্লাব লিলের বিপক্ষে ইউরোপা কনফারেন্স লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে অ্যাস্টন ভিলার ম্যাচটি না দেখে থাকলে আন্দাজেও হয়তো ধরে নিতে পারেন, মার্তিনেজের সেই অবদান টাইব্রেকারে!
কারণটাও সম্ভবত আপনার জানা। দেশ ও ক্লাবের হয়ে গতকাল রাতের আগে মার্তিনেজ তাঁর ক্যারিয়ারে সর্বশেষ চারটি টাইব্রেকারেই জিতেছেন। কাল রাতের ম্যাচটিসহ সেটি গিয়ে ঠেকল পাঁচে। আর হ্যাঁ, টাইব্রেকারে মার্তিনেজ পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মানে কোনো না কোনো বিতর্ক—সেই ধারায়ও কিন্তু ছেদ পড়েনি। ব্যাপারটা পূর্ণতাও পেয়েছে ম্যাচটা লিলের মাঠে হওয়ায়। ধরতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? ফরাসি দর্শক!
২০২২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষেই টাইব্রেকার জিতিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ফরাসি দর্শকদের স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন মার্তিনেজ। তারপর থেকেই আর্জেন্টাইন গোলকিপারের প্রতি বেশ ‘অ্যালার্জি’ রয়েছে ফরাসি দর্শকদের। সেজন্য মার্তিনেজের আচরণকেও অনেকাংশে দায়ী করতে পারেন কেউ কেউ।
লিলের মাঠে টাইব্রেকারে দুটি শট ঠেকিয়ে প্রতিবারই গ্যালারির দিকে তাকিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে ফরাসি দর্শকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করেছেন মার্তিনেজ। শুধু কী তাই, দেখেছেন দুটি হলুদ কার্ডও। কিন্তু তাঁকে মাঠ ছেড়ে যেতে হয়নি!
ভিলা পার্কে প্রথম লেগ ২-১ গোলে জিতেছিল স্বাগতিকেরাই। ফিরতি লেগ লিল ২-১ গোলে জেতায় দুই লেগ মিলিয়ে দুই দল ৩-৩ গোলে সমতায় থাকায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে লিলের নাবিল বেনতালেব ও বেনঞ্জামিন আন্দ্রের শট রুখে দেন মার্তিনেজ। টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলের জয়ে ১৯৮২ সালের পর এবার প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কোনো বড় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠল অ্যাস্টন ভিলা। ভাগ্যে বিশ্বাসী মার্তিনেজ নিজের কথায় এই সাফল্যকেই যেন নিয়তি হিসেবে বুঝিয়েছেন!
তবে সেই নিয়তিতে বিতর্কও আছে। সময় নষ্ট করার জন্য ম্যাচের ২৮ মিনিটে হলুদ কার্ড দেখেন মার্তিনেজ। ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ানোর পর স্নায়ুর পরীক্ষা দেওয়ার সে মুহূর্তে নিজের চিরায়ত ‘মাইন্ড গেম’ খেলতেও শুরু করেন আর্জেন্টাইন তারকা—যেমনটা করেছিলেন সর্বশেষ বিশ্বকাপ ফাইনালের টাইব্রেকারেও। বেনতালেব বল স্পটে বসানোর পর মার্তিনেজ বলটি একবার তুলে নিয়ে যান। এরপর বেনতালেব লক্ষ্যভেদেও ব্যর্থ হন। সেই সাফল্যের আনন্দে গ্যালারির দিকে ঘুরে মুখে আঙুল দিয়ে দর্শকদের চুপ থাকার ইঙ্গিত করে রেফারির কড়া শাসানিও শুনেছেন মার্তিনেজ। ফরাসি দর্শকেরাও কিন্তু কম যাননি। তাঁরা ম্যাচে অনেকবারই দুয়ো দিয়েছেন মার্তিনেজকে।
স্লোভাকিয়ান রেফারি ইভান ক্রুজলিয়াকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে এরপরই। টাইব্রেকারের মধ্যেই মাঠের এক কোনায় গিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করছিলেন মার্তিনেজ। তখন তাঁকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। কিন্তু দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখার পরও মাঠ ছেড়ে যেতে হয়নি মার্তিনেজকে। এমনিতে দুটি হলুদ পরিণত হয় লাল কার্ডে। কিন্তু মার্তিনেজ বেঁচে গেছেন ফুটবলের আইনেই। ম্যাচের নির্ধারিত সময় এবং অতিরিক্ত সময়ে দেখা কার্ড টাইব্রেকারে গিয়ে আর যোগ হয় না। ফুটবলের আইন প্রণেতা ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ডের (আইএফএবি) প্রণীত ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘ম্যাচে (অতিরিক্ত সময় সহযোগে) সতর্কবার্তা ও কার্ড পেনাল্টিতে বিবেচিত হবে না। ম্যাচে এবং পেনাল্টিতে (কিকস ফ্রম দ্য পেনাল্টি মার্ক/কেএফপিএম) হলুদ কার্ড দেখা খেলোয়াড় মাঠের বাইরে যাবেন না।’
সে যা হোক, মার্তিনেজ এরপর বেঞ্জামিন আন্দ্রের শটও রুখে দেন। নায়ক হয়েই ভিলাকে তোলেন সেমিফাইনালে। এবার ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় একমাত্র ইংলিশ ক্লাব হিসেবে টিকে থাকা দলও কিন্তু ভিলা। সেটাও তো মার্তিনেজের সৌজন্যেই!
ম্যাচ শেষে মার্তিনেজ নিজের কথায় বুঝিয়েছেন, ভিলার ইউরোপিয়ান-স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাঁর নিয়তিতেই লেখা ছিল। মার্তিনেজ বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে, এবার আমরা বিশেষ কিছুই করব। সেটা চ্যাম্পিয়নস লিগ না কনফারেন্স লিগ—তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমরা ক্লাবকে আরেকটু এগিয়ে নিতে সবটুকুই উজাড় করে দিচ্ছি।’
তবে এ সুযোগে টাইব্রেকারে রেফারির হলুদ কার্ড দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্তিনেজ, ‘আমার এটা নিয়ে দুর্নাম আছে তাই (কার্ড দেখার কারণ)। কারণ অন্য (লিলের) গোলকিপারও সময় নষ্ট করছিল। ৩০ মিনিটের পর (২৮ মিনিট) হলুদ কার্ড দেখেছি। তখন আমরা ম্যাচটি হারের পথে ছিলাম। জানি না রেফারি তখন আমার কাছে কী প্রত্যাশা করছিলেন। এরপর (টাইব্রেকারে) পেনাল্টি স্পটে কোনো বল ছিল না। সে জন্য বল বয়ের কাছে বল চাইতে গিয়ে হলুদ কার্ড দেখতে হলো। আমি নিয়মটাই বুঝতে পারছি না।’