আমরা বাংলাদেশের জয় চাই। বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই সবখানে, সব ক্ষেত্রে, সব বিষয়ে। কেউ যদি আমাদের জিজ্ঞেস করেন, প্রথম আলোর লক্ষ্য কী, আমরা জবাব দিই—বাংলাদেশের জয়।
সাফ মানে সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপের নারী টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের জয়ে আমরা তাই আনন্দিত, গৌরবান্বিত। ক্রিকেটে বাংলাদেশ জিতলে আমরা খুশি হই, ফুটবলে জিতলে খুশি হই, গণিত অলিম্পিয়াডে জিতলেও প্রথম আলো পত্রিকা হিসেবে, আর প্রথম আলোর কর্মীরা নাগরিক হিসেবে খুবই উৎফুল্ল বোধ করি। আমাদের সে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ পত্রিকায় এবং অনলাইনে আপনারা দেখতে পান।
কিন্তু সাফ নারী টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের অদম্য মেয়েরা আমাদের কেবল আনন্দিত বা গৌরবান্বিত করেননি, আশা দিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন, আমাদের আশ্বস্ত করছেন, প্রেরণা দিচ্ছেন যে বাংলাদেশ বিজয়ী হবে।
কথাটা কেন বলছি?
এই মেয়েদের জন্ম কোথায়? শৈশব কোথায় কেটেছে? মানে এঁদের শিকড় কোথায়? বাড়ি কোথায়? এঁরা সবাই এসেছেন গ্রাম থেকে। জাতীয় নারী ফুটবল দলের আটজন কলসিন্দুর গ্রামের। এই গ্রাম কোথায়? ময়মনসিংহ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে, গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। একেবারেই প্রান্তিক একটা গ্রাম। সাবিনার বাড়ি সাতক্ষীরা, কৃষ্ণা রানী সরকারের বাড়ি টাঙ্গাইল। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন রুপনা আর ঋতুপর্ণা। সবারই গ্রাম থেকে উঠে আসা, এঁদের সবার গায়ে মাটির ঘ্রাণ, চোখে গ্রামের সবুজ সরলতা।
সেই কথাটাই লিখেছিলেন সানজিদা, তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রামবাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না–মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।
আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব।’ বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল বিক্রি করে এবং পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে—এই কথাগুলো খেয়াল করুন।
আমরা রুপনা চাকমার বাড়ির ছবি দেখেছি ফেসবুকে। রুপনা চাকমা বলেছেন, শুধু বাড়িটা এ রকম তা–ই নয়, তাঁদের বাড়ি যাওয়ার কোনো রাস্তাও নেই। এসব কোনো অগৌরবের কথা নয়, বরং এখানেই আমাদের গৌরব, এখানেই আমাদের আশা।
ক্রিকেটার মোস্তাফিজ এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে। তাঁর ভাই তাঁকে মোটরসাইকেলে করে রোজ ৪০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমিতে নিয়ে যেতেন, ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য। মেহেদী হাসান মিরাজ এসেছেন খুলনা থেকে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট জেতানো এই মিরাজের বাড়ির ছবি আমাদের কাগজে ছাপা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাবা-মাকে বাড়ি করে দিয়েছিলেন। মাশরাফি এসেছেন নড়াইল থেকে, সাকিব মাগুরা থেকে।
গ্রামই আমাদের আশা। গ্রামের ধানখেতের আল দিয়ে, বাঁশঝাড়ের ছায়াপথে সার বেঁধে ইউনিফর্ম পরা মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। কোটি কোটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখছে। তারাই আমাদের শক্তি, ভরসা, বর্তমানের আশা, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। তারা আমাদের হারতে দেবে না।
আমাদের বাংলাদেশকে চালিয়ে নিচ্ছেন কারা? এগিয়ে নিচ্ছেন কারা? আজকে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে, সবজি উৎপাদনে, ফল উৎপাদনে, মাছ উৎপাদনে যে বিশ্ব রেকর্ড করছে, যাঁরা সেরা কাজগুলো করছেন; রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক... এর সবই করছেন গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ, তাঁদের অভূতপূর্ব সৃজনশীলতা, আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুই উৎস পোশাকশিল্প আর অভিবাসী শ্রমিক—দুটোই চালাচ্ছেন গ্রামগঞ্জ থেকে আসা নারী–পুরুষেরা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।
গ্রামই আমাদের আশা। গ্রামের ধানখেতের আল দিয়ে, বাঁশঝাড়ের ছায়াপথে সার বেঁধে ইউনিফর্ম পরা মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। কোটি কোটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখছে। তারাই আমাদের শক্তি, ভরসা, বর্তমানের আশা, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। তারা আমাদের হারতে দেবে না।
বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই আমরা দেখি, গ্রাম থেকে আসা মানুষই নেতৃত্ব দিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ায়। রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, খেলাধুলা—কোনো কিছুই এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা প্রাণঢালা অভিনন্দন, টুপিখোলা অভিবাদন জানাই আমাদের সাফজয়ী মেয়েদের, আমাদের জয় এনে দেওয়ার জন্য, গৌরবের উপলক্ষ দেওয়ার জন্য এবং একই সঙ্গে দেশের সার্বিক জয়ের ব্যাপারে আমাদের আশাবাদী করার জন্য, আত্মবিশ্বাস জোগানোর জন্য।
সেই গ্রামই আজকে আবার আমাদের বিজয় এনে দিচ্ছে। সেই গ্রামের পুরুষদের সঙ্গে এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভূমিকা রাখছেন নারীরা। তাঁরা ঘরের কাজ করছেন, মাঠের কাজ করছেন, কারখানায় কাজ করছেন, লেখাপড়া করছেন, ক্রিকেট থেকে ফুটবল, ভারোত্তোলন থেকে তির ছোড়া—কত বিচিত্র ক্ষেত্র থেকে আমাদের জন্য এনে দিচ্ছেন জয়।
রংপুরের তারাগঞ্জের সাদেকা বেগমের রোকেয়া সমিতি পুরো গ্রামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছে, তার সদস্যরা সবাই নারী। গ্রামের কিশোরীরা জোট বেঁধে বাল্যবিবাহ রোধ করছে। ছোট্ট মেয়ে তাসমিনা ঘোড়া চালানোর প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করছে। তেঁতুলিয়া থেকে সাতক্ষীরার মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশকে ঠেকিয়ে রাখবে—এই সাধ্য কার? বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
সাবিনা, কৃষ্ণা, শামসুন্নাহার, সানজিদারা আমাদের সেই বিশ্বাসকে কেবল জোরদার করেননি, সামনে এগিয়ে এনেছেন। সেই কারণে মেয়েদের সাফ বিজয়ের উপলক্ষটাকে আমরা দ্বিগুণভাবে উদ্যাপন করছি।
এই মেয়েদের অনেককে আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ২০১৫ সালে কলসিন্দুরের মেয়েদের আমরা সংবর্ধনা দিয়েছিলাম, প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাঁরাই ছিলেন প্রধান আকর্ষণ এবং অতিথি। বাংলাদেশের মেয়েরা বয়সভিত্তিক এএফসি কাপে চ্যাম্পিয়ন হলে জাতীয় দলের খেলোয়াড়সহ কলসিন্দুর গ্রামের মোট ২৫ জনকে বৃত্তি দিয়েছিল প্রথম আলো।
এঁদের অনেকেরই সংগ্রামের খবর আমরা প্রকাশ করেছি। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবার, দরজি পরিবারগুলোয় এই মেয়েরা হয়তো সুদিনের সুবাতাস বইয়ে দিতে পেরেছেন।
একই সঙ্গে তাঁরা বিজয়ী করেছেন বাংলাদেশকে। যে নারীরা সমিতি করে নিজের পরিবারের সচ্ছলতা আনছেন, তাঁর পরিশ্রমের সুফল যেমন বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করছে, তেমনি আমাদের নারী ফুটবলারদের বিজয়ের সুফল তাঁর পরিবারে দিনবদল ঘটাচ্ছে, কলসিন্দুরের মতো গ্রাম বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে, আবার সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাফ জয়ের আনন্দে বাংলাদেশের সব মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠছে।
কাজেই আমরা প্রাণঢালা অভিনন্দন, টুপিখোলা অভিবাদন জানাই আমাদের সাফজয়ী মেয়েদের, আমাদের জয় এনে দেওয়ার জন্য, গৌরবের উপলক্ষ দেওয়ার জন্য এবং একই সঙ্গে দেশের সার্বিক জয়ের ব্যাপারে আমাদের আশাবাদী করার জন্য, আত্মবিশ্বাস জোগানোর জন্য।
একটা ট্রেন যে চলে, তার কারণ, সামনে থাকে ইঞ্জিন। একটা জাতি যে এগোয়, তার কারণ, তার সামনে থাকে আশা। আমাদের মেয়েরা আমাদের আশা দিচ্ছেন, ভরসা দিচ্ছেন। তাঁদের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা, অভিনন্দন, ভালোবাসা।
অপরাজিতাদের নিয়ে এই বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের মাধ্যমে সবার পক্ষ থেকে খেলোয়াড়, কোচ, সামনের এবং নেপথ্যের সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই।